পরজীবী হলেও আমাদের চয়েস ছিল, গৃহপালিত হয়ে সেটাও হারিয়েছি: জি এম কাদের

পরজীবী হলেও আমাদের চয়েস ছিল, গৃহপালিত হয়ে সেটাও হারিয়েছি: জি এম কাদের
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের | ছবি: টেলিভিশন থেকে নেওয়া

জাতীয় পার্টি দুটি সংকটের কারণে 'সঠিক' রাজনীতির পথে হাঁটতে পারছে না বলে মন্তব্য করেছেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

নিজের জন্মদিন উপলক্ষে আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর বনানীতে দলীয় কার্যালয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

বায়ান্নর ইতিহাস তুলে ধরে জি এম কাদের বলেন, 'ভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং বৈষম্যের প্রতি সংগ্রাম; শহীদ যারা হয়েছিলেন, তারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শহীদ হয়েছিলেন। ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তারা বৈষম্যকে দূর করার জন্য—আমরা মাতৃভাষায় যদি কাজ করতে না পারি, আমাদের উর্দু ভাষায় কাজ করতে হয়, তাহলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা ভালো চাকরি পাবে না। ব্যবসায়ীরা ভালো ব্যবসা করতে পারবে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের কোনো মর্যাদা থাকবে না।'

তিনি বলেন, 'আমরা ভাষাকে নিশ্চয়ই মূল্য দেবো, আমাদের মাতৃভাষা কিন্তু বৈষম্য; যার জন্য রক্ত দেওয়া হয়েছে, সেই জিনিসটাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আমি মনে করি, আমরা শহীদ মিনার করে করে, এখন ঘরে ঘরে শহীদ মিনার করছি, স্কুল, যেখানে-সেখানে শহীদ মিনার করছি কিন্তু শহীদদের আত্মত্যাগের যে মূল বিষয় ছিল, সেটা হলো বৈষম্য। সেই বৈষম্য কি আমরা দূর করতে সক্ষম হয়েছি?

'ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাংলাদেশে প্রতিদিন বাড়ছে। এটা বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? এটা কি অন্যায় নয়? একইসঙ্গে দলীয়করণের বৈষম্য। সরকারি দল করলে এক ধরনের নিয়ম-কানুন। সরকারি দল করলে এক রকম সুযোগ-সুবিধা, এক ধরনের মানুষকে যেটা দেওয়া হচ্ছে, আরেকজনকে সরকারি দল না করলে দেওয়া হচ্ছে না। এটা বৈষম্য, বৈষম্য মানে অন্যায়। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভাষা শহীদরা সংগ্রাম করেছিলেন। সেই অন্যায় এখনো হচ্ছে। সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একুশে আমাদের ডাক দেয়,' যোগ করেন তিনি।

জি এম কাদের আরও বলেন, 'আমরা এটা ভুলে যাই। আমরা শুধু মাতৃভাষা ভালো, মাতৃভাষাকে সম্মান দিতে হবে—এটাই সব না! মাতৃভাষাকে নিশ্চয়ই আমরা সম্মান দেবো কিন্তু আসল যে মেসেজ, যার জন্য মানুষ বুকের রক্ত দিয়েছে সেটা হলো বৈষম্যমুক্ত সমাজ। সেই সমাজকে বর্তমান সরকার আরও বেশি করে বৈষম্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্যের শিকার করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো চাকরি-বাকরি করতে গেলে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তুমি আওয়ামী লীগ করো কি না? তোমার পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগ করে কি না? এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই তো একুশের সংগ্রাম।'

একুশের আসল চেতনাকে আমরা ভূ-লুণ্ঠিত করছি বলেও এ সময় মন্তব্য করেন তিনি।

ভাষা প্রতিষ্ঠার পরে বৈষম্যমুক্ত সমাজ দরকার ছিল মন্তব্য করে জাপা চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'এই ধারাবাহিকতায় ছয় দফা আন্দোলন এসেছে, এই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা আন্দোলন এসেছে এবং এই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হয়েছি, যেটাকে আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ মানে বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুক্তি। সেই মুক্তিযুদ্ধে কি আমরা জয়ী হয়েছি? মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয়ী হই নাই—স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি।'

জাতীয় পার্টি নব্বইয়ের পরে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। ক্ষমতার বাইরে থাকলে আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো টিকতে পারে না। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা বিভিন্নভাবে জুলুম-নির্যাতন, বঞ্চনা করে আমাদের রাজনীতি করতে দেয়নি। ফলে দলে যারা ছিলেন, আস্তে আস্তে দল থেকে চলে গেছেন।'

কাদের বলেন, 'অনেক লোক দল করতে আসেন নিজের স্বার্থের জন্য। তারা দলের স্বার্থও দেখে না, দেশ ও জাতির স্বার্থ তো দেখেই না। সেসব লোক আস্তে আস্তে সরে গেছে। আমি মনে করি, এক সময় এটা স্বাভাবিক গতিতেই কমে গেছে। ২০০৮ সালে আমরা যখন মহাজোট করেছি, তার পরবর্তীতে অনেকে বলেছে আমরা পরজীবী হয়ে গেছি। একজন সাংবাদিক সেদিন একটা লেখায় লিখেছেন, জাতীয় পার্টি পরজীবী হয়েছে। কেন? অন্যের ওপর ভর করা ছাড়া তারা জিততে পারে না। তারা হয়তো কারও সঙ্গে জোট করলে আসন পায়।

'এই পরজীবীটা আমাদের জন্য বড় সুযোগ ছিল। বড় দুটি রাজনৈতিক শক্তির অল্প ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। সেই অল্প ভোটটি আমরা দিতে পারতাম সব আসনে। আমাদেরকে নেওয়ার জন্য, আমাদেরকে পরজীবী করার জন্য প্রতিযোগিতা ছিল। সেটার জন্য আমাদের একটা বার্গেনিং পাওয়ার ছিল। আমরা বার্গেনিং করে অনেক কিছু আদায় করতে পারতাম। সেটা ছিল আমাদের রাজনৈতিক শক্তি,' বলেন তিনি।

জাপা চেয়ারম্যান বলেন, '২০১৪ এর পর থেকে আমরা সেটা হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমরা সম্পূর্ণভাবে সেটা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা এখন হয়েছি গৃহপালিত রাজনৈতিক দল। এটা বাস্তবতা। এটা করা হয়েছে, সরকারি দল থেকে। আমাদের ভেতরে তাদের এজেন্ট ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে বিভিন্নভাবে। তারা আমাদের দল করে কিন্তু রাজনীতি করে আরেক দলের—সরকারি দলের। তারা আমাদের দলের সুযোগ-সুবিধা নেয়, পদ-পদবি নেয়, আমাদের দলের বার্গেনিংয়ের কারণে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায় কিন্তু দল করার সময়, রাজনীতি করার সময় তারা সরকারি দলের রাজনীতি করে। সরকারি দলের স্লোগান দেয়, সরকারি দলের কথা বলে। ফলে আমরা যখনই কোনোভাবে সঠিক রাজনীতি করতে যাই, তখনই দল ভেঙে আরেকটা দল সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। সরকার করে, সব সময় করেছে। যেন আমরা স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে না পারি।

'আগে পরজীবী হলেও আমাদের একটা চয়েস ছিল, আমরা এখানে যেতে পারি, আমরা আরেকখানেও যেতে পারি। সেটাই ছিল আমাদের বার্গেনিং পয়েন্ট; তোমরা যদি আমাদেরকে ভালোভাবে না দেখো, আরেকজনের কাছে যাব। সে যদি ভালোভাবে না দেখে তোমার কাছে আসব। এখন আমরা বন্দি হয়ে গেছি, একজনের কাছে ছাড়া যেতে পারব না,' বলেন তিনি।

কারণ হিসেবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, 'আমাদের আরেকজন লোক পাশে বসে থাকবেন, উনি একটা ডাক দেবেন এবং সরকার তাকে মদদ দেবে, মিডিয়া তাকে বিভিন্নভাবে কভারেজ দেবে, আর আমাদের দল ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে বলে ভেঙে দেওয়া হবে। আইন-কানুনে মাধ্যমে আমাদের লাঙ্গল-টাঙ্গল সব নিয়ে যাওয়া হবে—এই ধরনের ধামকি দেওয়া হবে। তার ফলে, দল বাঁচাব না রাজনীতি বাঁচাব? এই সমস্যা জাতীয় পার্টি সব সময় বহন করে যাচ্ছে। কারণ আমাদের দুর্বলতা। কারণ, আমরা লোভ-লালসা থেকে দূরে থাকতে পারি না।

'আমাদের দলে থেকে যারা আরেক দলের রাজনীতি করে, তাদের আমরা দল থেকে বের করে দিতে পারি না এবং ঝুঁকি নিতে পারি না। সামনের দিনে যদি রাজনীতিকে বাঁচাতে হয়, আমাদের এই ঝুঁকি নিতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের দুর্বল করার সরকার সব সময় আমাদের পেছনে একটি জোট বানিয়ে রাখবে। যখনই আমরা সত্যিকার অর্থে আমাদের রাজনীতি করব, জনগণের রাজনীতি করব, তখনই তারা বাধা দিয়ে আমাদের দলকে ভেঙে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সরকার করছে এটা। কাজেই এটাকে বাঁচাতে হলে সব নেতাকর্মীকে জাতীয় পার্টি করতে হবে, যারা জাতীয় পার্টি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অন্য দল করতে চায়, তাদের দল থেকে বের করে দিতে হবে। যদি করতে পারেন দল টিকবে, যদি করতে না পারেন দল টিকবে না,' নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন তিনি।

দেশ ও জাতির কাছে গৃহপালিত দলের প্রয়োজনীয়তা নেই উল্লেখ করে এই রাজনীতিক বলেন, 'পরজীবী দলের প্রয়োজনীয়তা দেশের কাছে আছে। যেহেতু আমরা ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর, আমাদের কথা শুনতে বাধ্য হয় সরকার। আমাদের কথা শুনতে বাধ্য হয় যে কোনো দল। সেটুকু পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা আছে। যে মুহূর্তে আমরা একজনের কাছে বন্দি হয়ে গৃহপালিত হবো এবং উনি যেভাবে চাইবেন সেভাবে কথা বলবো, তখন জনগণের কাছে আমাদের কোনো দরকার নেই। তাহলে এই দলের জন্য জনগণ কেন ভোট দেবে? জনগণ কেন এগিয়ে আসবে? এই সমর্থন দেবে? এটা আমাদের বুঝতে হবে।'

নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, 'দলকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে গৃহপালিত থেকে বেরিয়ে আসেন। দরকার হলে পরজীবী থাকব। পরজীবী থেকে আমরা স্বনির্ভর হবো। আমাদের সেদিকে এগিয়ে যেতে হবে। যারা গৃহপালিত হওয়ার জন্য দায়ী, তাদের বর্জন করতে হবে।'

এ সময় নেতাকর্মীদের একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান কাদের।

সরকারের উদ্দেশে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, 'আমরা গৃহপালিত থাকতে চাই না। সরকারকে অনুরোধ করব, এভাবে দেশের রাজনীতিকে নষ্ট করবেন না। রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করতে দেন। সবাইকে ধ্বংস করে আপনারা একক রাজনীতি করবেন সেট দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না।'

Comments

The Daily Star  | English

NBR revises VAT, SD on 9 items following public outcry 

The tax authority brought down the indirect taxes two weeks after the government hiked rates of nearly 100 goods and services drawing opposition from criticisms that the spike would stoke inflation which has been staying over 9 percent since March 2023

26m ago