গল্পটা শুধু সরফরাজ খানের নয়, নওশাদ খানেরও
সূর্যকুমার যাদবের একটা মেসেজ এলো নওশাদ খানের কাছে। পরদিন ছেলে সরফরাজ খানের অভিষেক হয়ে যেতে পারে। সূর্য জানতে চাইলেন নওশাদের কাছে- কাল কি যাচ্ছেন আপনি মাঠে? নওশাদ বললেন- বাবাকে দেখে ছেলের খেলায় যেন কোন গড়বড় না হয়, সে কারণে তিনি যেতে চান না। সূর্য বোঝালেন তাকে, দিনটা কত বড় তাদের জন্যে। মেনে নিলেন নওশাদ। মুম্বাই থেকে রাজকোট যাবেন, টিকেট পেলেন মাত্র একটা। স্ত্রীকে রেখে তাই ছুটে গেলেন একাই। ছেলেকে দেখলেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখতে, সেই আরাধ্য ভারতের জার্সি গায়ে। জার্সির পেছনের সংখ্যাটা- ৯৭।
সরফরাজের জীবনে এই সংখ্যার আলাদা মাহাত্ম্য আছে। বাবার নাম নওশাদ। হিন্দিতে নয়ের মানে নও, সাতের মানে তো সাতই। দুটি মিলে নওশাত, অনেকটা নওশাদের মতোই। সংখ্যাটা বেছে নেওয়ার মূলে কারণ সেটিই। এই সংখ্যায় সবসময় যেন সরফরাজের সঙ্গেই থাকেন বাবা। আদতেই সরফরাজের ক্রিকেট জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে তার বাবা। গল্পটা শুধু সরফরাজ খানের নয়, নওশাদ খানেরও।
নিজের বড় স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে খেলা। সেই স্বপ্ন পূরণ না হলেও মুম্বাইয়ে ক্লাব ক্রিকেট খেলতেন। রেলওয়েতে চাকরি করতেন। সেসব ছেড়ে লেগে গিয়েছিলেন ক্রিকেট কোচিংয়ে। এরপর তার স্বপ্নে জাতীয় দল থাকলো, কেন্দ্রীয় চরিত্র বদলে গেল শুধু। ছয় বছর বয়স থেকেই সরফরাজকে নিয়ে যেতে থাকলেন অনুশীলনে। সরফরাজের জীবনটাও হয়ে গেল- ক্রিকেট, ক্রিকেট, শুধুই ক্রিকেট।
সরফরাজ তো এক সাক্ষাৎকারে শুনিয়েছিলেন তার রুটিন- ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠো, ৬টায় রওয়ানা মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দানের উদ্দেশ্যে, ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত নেটে ব্যাটিং। এরপর ম্যাচ, বিকালে আবার ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত নেট, রাত নয়টায় ঘুম। ঘোরাঘুরি, ফুর্তি- সেসবের জায়গা ছিলই না বলতে গেলে। সরফরাজ তো একবার বলেছিলেন, মাঝেমধ্যে মিলিটারি জীবন মনে হতো তার।
ধীরে ধীরে সরফরাজের কাছে নওশাদের 'বাবা' পরিচয় আড়াল হয়, 'কোচ' পরিচয়ই বড় হতে থাকে। সরফরাজ যেমন বলেন, 'বাবা'কে পাই না, ২৪ ঘণ্টা আমার 'কোচ'কেই পাই। নওশাদকে নিয়ে আরেকবার বলেছিলেন- তিনি আমার কোচ ৯৭ শতাংশ, বাবা ৩ শতাংশ। ছেলের ক্রিকেট নিয়েই তো নওশাদের সব ধ্যানজ্ঞান ছিল।
কখনো কখনো দিনে তিন সেশন প্র্যাকটিস করতে হতো সরফরাজকে। তখন আজাদ ময়দান থেকে বাসায় যাতায়াতে সময় নষ্ট হবে ট্রাফিক জ্যামে। সেটা ভেবে বাবা নওশাদ মাঠেই ছেলের ঘুমানো ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিতেন। কাপড়-চোপড় সঙ্গে নিয়ে সেখানেই গোসল। এরকমই গ্রীষ্মের দুই মাস ধরে চলত তার রুটিন। ক্রিকেটেই জান-প্রাণ ঢেলে দেওয়া- এই গল্পই তো পুরোটা বুঝিয়ে দেয়।
ঘরের সামনে নওশাদ বানিয়ে ফেলেছিলেন নেট। এস্ট্রোটার্ফের উইকেটে থ্রো-ডাউন করেই যেতেন নওশাদ। আজাদ ময়দান, ঘর- দিনে সবমিলিয়ে ৬০০-৭০০ বল করে খেলতেন সরফরাজ। কিশোর বয়সে একবার নওশাদ দেখলেন তার ছেলে সুইংয়ে ভুগছে। এতদিন ধরে সরফরাজ অনুশীলন করতেন সন্ধ্যার সময়ে, তাই সেরকম সুইংয়ের মুখোমুখি হতেন না। নওশাদ করলেন কী, পরদিন থেকেই সরফরাজের অনুশীলন শুরু করিয়ে দিলেন সাঝ-সকালে সুইংময় কন্ডিশনে।
কোনও রকমের ফাঁকফোকর রাখা যাবে না। বর্ষার দিন, অফ-সিজনে প্র্যাকটিসে সমস্যা? তো কী! চলে যেতেন নওশাদ উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। নওশাদের ছোট ছেলেও ধীরে ধীরে তার স্বপ্নের পরিধিতে ঢুকে যান। ২০২৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে যে মুশীর খান ৩৬০ রান করে রানের তালিকায় থেকেছেন দুইয়ে। মুম্বাইয়ের অফ-সিজনে দুই ভাইকে বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে একের পর এক ম্যাচে নামিয়ে দিতেন নওশাদ।
মুম্বাইয়ে নজরে আসতে হলে বড় স্কোরের দরকার। সরফরাজ ১২ বছর বয়সেই বিস্ময়বালক রূপে আগমন করেছিলেন, ৪৩৯ রানের বিশাল ইনিংস খেলে। হ্যারিস শিল্ডে (স্কুল ক্রিকেট) সেই ইনিংস খেলে ভেঙে দিয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের ৩৪৬ রানের রেকর্ড। এরপর বয়সভিত্তিক দলের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের পর ২০১৬ সালেও খেলেছিলেন। সেই ২০১৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পথে ৩৫৫ রান করে রানের তালিকায় ছিলেন দুইয়ে। বড়সড় শিরোনাম তো আদতে হয়েছিলেন মাত্র ১৭ বছর বয়সেই আইপিএলে দল পেয়ে। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে কয়েকটি ইনিংস (২১ বলে অপরাজিত ৪৫, ২১ বলে ৩১) খেলে তখনই নজরে এসেছিলেন।
অবশ্য ২০১৬ সালের আইপিএলের সময়েই বিরাট কোহলি তাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ফিটনেসে উন্নতি আনতে হবে নয়তো তুমি খেলতে পারছো না। তরুণ তারকার সাফল্যের বেলুন ধীরে ধীরে চুপসে যেতে থাকলো। মাঝখানে মুম্বাই ছেড়ে উত্তর প্রদেশে গিয়েছিলেন। নিয়মিত খেলতে না পেরে সেখানের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। আবার মুম্বাইয়ে এসে এরপর পুনর্জাগরণই যেন ঘটেছে।
শেষ কয়েক বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটে এমনই পারফরম্যান্স করেছেন, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভিনদেশেও নজর কেড়েছেন। ২০১৯-২০ মৌসুমে ৯ ম্যাচে রঞ্জি ট্রফিতে করেছিলেন ১৫২ গড়ে ৯২৮ রান৷ পরের মৌসুমে ৯৮২ রান৷ ২০২২-২৩ রঞ্জিতেও থামেননি ৫৫৬ রানের কমে। এমন গড়ে ব্যাটিং করছিলেন, প্রথম শ্রেণীতে ডন ব্রাডম্যানের পেছনেই একটা সময়ে ছিলেন। কিন্তু এত এত পারফরম্যান্স, তবু সুযোগ মিলছে কই!
এক সিরিজ যায়। আসে না সুযোগ। কেউ দল থেকে বাদ পড়েন। ইনজুরিতে পড়েন কেউ। সরফরাজের সুযোগ তবু আসে না। পরিশ্রমের ফল মিলছে না বলে নওশাদের তখন মনে পড়তো এক শায়েরী (কবিতা)-
"আমার যা স্বপ্ন, তা চোখের অংশ হয় না কেন
বাতি তো আমিও জ্বালাই, ঝলমলে হয় না কেন!"
শায়েরীর বড় শখ নওশাদের। প্রায় সময়ই অনুপ্রেরণা দিতে ব্যবহার করেন। নিজেরই তো দরকার পড়ত অনুপ্রেরণার। এতকিছুর পর 'ভারত' অপেক্ষার শেষ হচ্ছে না কেন, নিজের শায়েরীতেই খুঁজে নিতেন তা-
"রাতকে চলে যাওয়ার সময়টা দাও, সূর্য তার সময়েই উঠবে।"
নওশাদ-সরফরাজের সূর্য অবশেষে উঠে যায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চলমান ভারতের সিরিজের তৃতীয় টেস্টে। শ্রেয়াস আইয়ার ইনজুরিতে ছিটকে গিয়েছিলেন, সেখানে জায়গা মিলে যায় সরফরাজের।
সরফরাজের স্বপ্ন ছিল- বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় অন্তত একবার হলেও যেন ভারতের জার্সিটা তার গায়ে উঠে। সেই স্বপ্ন রাজকোটে সত্যি হওয়ার পর সরফরাজের মনে হল- একটা বোঝা যেন পিঠ থেকে সরে গেল।
রবিবার শেষ হওয়া রাজকোট টেস্টের স্কোরকার্ডে লেখা থাকবে- সরফরাজ খান প্রথম ইনিংসে ৬২ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে করেছেন ৬৮ রান। তবে টেস্টটা শুধুই সরফরাজের নয়, নওশাদ খানেরও। বাবা না থাকলে যে কিছুই হতো না সরফরাজের, 'জীবনভর মাঠে আমাকে নিয়ে কষ্ট করেছেন। দিনভর দৌড়ে চলেছেন এদিকে, ওদিকে। কখনো তো আমার নিজের কাছেও লাগত, কেন করছেন এসব? আর বাদ দিয়ে দেওয়া উচিত। জীবনে কতবার মনে হয়েছে, আমি শেষ। কিন্তু আব্বু আমাকে শেষ হতে দেননি। যদি তিনি থাকতেন না, তাহলে কে জানে আমার কী হতো!'
একটিবার ভারতের জার্সি গায়ে নেমে বাবাকে দেখানো- সরফরাজের সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। বলা যায়, রাজকোট টেস্ট ছিল বাবার নামেই। অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাদবাকি পথচলায়ও বাবা থাকবেন তার সঙ্গে- সেই সংখ্যার ভেতরে লুকিয়ে। ৯৭।
[রিফাত বিন জামাল- অতিথি লেখক]
Comments