মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা, গ্যাস সংকটে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত
দীর্ঘায়িত গ্যাস সংকট, অস্থিতিশীল বিনিময় হার এবং উচ্চ উৎপাদন খরচ অনেক কারখানাকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য করায় বাংলাদেশের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হোম টেক্সটাইল খাত রপ্তানি বাজারে জৌলুস হারাচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে, যা তার আগের বছরের তুলনায় ৪৯ দশমিক ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
হোম টেক্সটাইল পণ্যের মধ্যে বিছানার চাদর, দরজা-জানালার পর্দা ও বিভিন্ন ধরনের টেরিটাওয়েল আছে। পরের বছরও রপ্তানির ধারা অব্যাহত ছিল। রপ্তানি ৪৩ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়ে ১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
স্থানীয় উৎপাদন কমা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি কমে যাওয়া এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার উল্লেখযোগ্য পতন এবং গ্যাস সংকটে সরবরাহকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গত অর্থবছরে এ প্রবণতা হ্রাস পায়।
ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি ৩২ দশমিক ৪৭ শতাংশ কমে ১ দশমিক ০৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেও নিম্নমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারির মধ্যে শিপমেন্ট ৩৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ কমে ৪৫৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
চাহিদা কমে যাওয়াতেই ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। কারখানা মালিকেরা বলছেন, এতে করে হোম টেক্সটাইল মিলগুলোতে এর প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে মাত্র আটটি মিল সক্রিয়ভাবে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করছে, যা কয়েক বছর আগেও ছিল ৩৮টি।
বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অস্থিতিশীলতা এ খাতের সর্বশেষ আঘাত। গত দুই বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকা প্রায় ৩০ শতাংশ দুর্বল হয়েছে, যা রপ্তানিকে সস্তা এবং আমদানিকে ব্যয়বহুল করেছে।
এই খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হোম টেক্সটাইল বেশিরভাগই মৌসুমি ব্যবসা। তবে ইতিবাচক দিক ছিল আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ডগুলো বর্তমান সংকট তৈরি হওয়ার আগে দুই থেকে তিন বছর অর্ডার দিয়েছিল।
কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সরকার প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করার পর মিলাররা দীর্ঘ সময়ের জন্য অর্ডার বুক করেনি। এটি তাদের উৎপাদন ব্যয় তাৎক্ষণিকভাবে এবং বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।
হোম টেক্সটাইলের পণ্য তৈরিতে স্টিম বয়লার ও কাপড় রং করার জন্য প্রচুর গ্যাসের সরবরাহ দরকার।
তবে বিপদ এখানেই শেষ হয়নি কারণ জ্বালানির দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না কারণ সরকার তার কোষাগারের ওপর চাপ কমাতে ভর্তুকি ব্যয় কমানোর চাপে আছে।
ফলস্বরূপ, আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ডগুলো হোম টেক্সটাইলের জন্য পাকিস্তানের বাজারে ভিড় করতে শুরু করেছে৷ নিজস্ব তুলা উৎপাদনের কারণে হোম টেক্সটাইল সরবরাহের ক্ষেত্রে দেশটি বেশ শক্তিশালী যেখানে বাংলাদেশকে সুতা তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামালের চাহিদা মেটাতে বাইরের বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়।
ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি মুদ্রাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রতি মার্কিন ডলার ২৭৮-২৭৯ রুপিতে লেনদেন হচ্ছে। এতে করে হোম টেক্সটাইল প্রস্তুতকারকদের কম দামে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।
টেক্সটাইল মিল মালিক লিটল গ্রুপের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে লাভের পরিমাণ ছিল ৩ শতাংশ। কিন্তু গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পর উৎপাদন খরচ মুনাফার চেয়ে ৫ শতাংশ বেড়েছে।
'ফলস্বরূপ, হোম টেক্সটাইল মিল মালিকরা নতুন অর্ডার বুক করেননি। এর ফলে হঠাৎ করেই উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে।'
তিনি বলেন, বহু বছর ধরে রুপির অতিমূল্যায়িত হওয়ায় বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিল মালিকরা তাদের পাকিস্তানি প্রতিযোগীদের কাছে বাজার হারিয়েছে।
আলম একটি স্থানীয় হোম টেক্সটাইল মিলারের উদাহরণ দেন যে মাসে গ্যাস বিল হিসাবে ৬৪ কোটি টাকা দিতেন যেখানে খরচ এখন ১২৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
'এটি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিচালন ব্যয় বাড়িয়েছে এবং ফলস্বরূপ কোম্পানির লাভের মার্জিনকে প্রভাবিত করেছে। এটি ফার্মটিকে অতীতের মতো নতুন অর্ডার নেওয়া বন্ধ করতে বাধ্য করেছে এবং অস্থির ব্যবসায়িক পরিবেশে প্রতিযোগিতামূলক থাকার জন্য উত্পাদন ক্ষমতা অর্ধেক করেছে।
তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে ঋণ দেওয়ার সুদহার বহাল রেখে জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯ শতাংশ ঋণহার সীমা প্রত্যাহার করার পর উদ্যোক্তাদের জন্য তহবিলের ব্যয়ও বেড়েছে।
চাহিদা কম থাকায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হোম টেক্সটাইল উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী নোমান গ্রুপের উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্য সংকটও রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি মাসে গড়ে ২২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য সরবরাহ করে। গ্রুপটির নির্বাহী পরিচালক শহীদুল্লাহ চৌধুরী জানান, কয়েক মাস আগে যা ছিল ৩২ মিলিয়ন ডলার।
তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে নোমান গ্রুপ রাশিয়ায় ১২ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি করত। এটি শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।
'একইভাবে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ইউরোপেও রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে।'
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনসুর আহমেদের মতে, অস্থির বিনিময় হার এবং গ্যাস সংকটের কারণে, গত কয়েক বছরে কিছু বড় হোম টেক্সটাইল কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে।
গ্যাস পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শিগগিরই আরও টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন।
Comments