কারাগার থেকে পর্দায়

কারাগার থেকে পর্দায়
সিনপাটের একটি দৃশ্যে সোহেল শেখ। ছবি: সংগৃহীত

হলিউডে তারকাখ্যাতি পাওয়া অনেকেই আছেন, যারা অভিনয়ে আসার আগে কোনো না কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই তালিকায় আছে রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, মার্ক ওয়ালবার্গ, ড্যানি ট্রেজো ও স্নুপ ডগসহ বেশ কিছু বড় নাম।

বাংলাদেশের শোবিজ জগতে আগে কখনো এমনটা দেখা না গেলেও ব্যতিক্রম সোহেল শেখ৷ পাবনার নগরবাড়ি এলাকার এ বাসিন্দা এখন সাতটি মামলার আসামি।

৩৮ বছর বয়সী সোহেলের সঙ্গে সিনেমা জগতের কারোরই ছিল না কোনোরকম সম্পর্ক কিংবা পরিচয়। নিছক ভাগ্যই তাকে টেনে এনেছে পর্দায়। মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামের ওয়েব সিরিজ 'সিনপাট'-এ মূল চরিত্রে অভিনয় করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সোহেল।

দ্য ডেইলি স্টারকে জীবনের প্রথম সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এই নবীন অভিনয়শিল্পী, শুনিয়েছেন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প৷ যা শুনে অবাক হবে অনেকেই।

কারাগার থেকে পর্দায়
সোহেল শেখ।

১১ জানুয়ারি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে মুক্তি পায় 'সিনপাট'। সেদিনই রাজশাহীতে হয়েছিল সিরিজটির প্রিমিয়ার শো৷ সোহেলের ভাগ্য খারাপ। সিরিজের প্রধান চরিত্রের অভিনেতা হয়েও থাকতে পারেননি প্রিমিয়ারে৷ সেদিনই জামিনে পাবনা কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন তিনি৷ তবুও সময়মতো প্রিমিয়ারে হাজির হতে পারেননি।

আলাপের শুরুতেই আফসোসের কথাটি শোনালেন সোহেল৷ কথা হচ্ছিল তার বন্ধুর মোবাইল ফোনে, কারণ সোহেলের কোনো ফোন নেই।

সোহেল বলেন, 'আমার নামে সাতটি মামলা দিয়েছে। আমি তো জানতাম চারটির কথা। দাদারা (পরিচালক তাওকীর ও তার টিম) খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন সাতটি মামলার কথা। এগুলোর কিছু মামলা তো মিথ্যা। এমন জায়গার মামলাও আছে, যে জায়গায় আমি জীবনেও যাইনি।'

দুই ভাই-দুই বোনের মধ্যে সোহেল তৃতীয়৷ বাবা ছিলেন রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার।

'ছোটবেলা থেকে অনেক দুষ্টু ছিলাম। বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেছে স্কুলে পাঠাতে। তবে পাঠাতে পারেনি', বলেন সোহেল। 

কারাগার থেকে পর্দায়
সিনপাটের একটি দৃশ্যে সোহেল শেখ। ছবি: ফুটপ্রিন্ট ফিল্ম প্রোডাকশন

মাত্র ১৩ বছর বয়সে জেলে যেতে হয় সোহেলকে৷ বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও নানা ধরনের মাদককাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে মামলা হয়৷ কখনো জেল খেটেছেন, আবার জামিনে বেরও হয়েছেন। 

সোহেল বলেন, 'সিনেমায় (সিনপাট) আমার জীবনের অনেকটাই দেখানো হয়েছে। আমার আপন ছোটবোন মুক্তিও আমার সঙ্গে অভিনয় করেছে।'

পরিচালক তাওকীরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'শাইক (তাওকীর) দাদা আমার দায়িত্ব নিয়েছেন৷ তার উপকার আমি আজীবন মনে রাখব।'

'সিনপাট'র শুটিংয়ে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে সোহেলের৷ শুটিংয়ের মাঝেই তাকে আদালতে হাজিরাও দিতে হয়েছে।

সোহের বলেন, 'সারারাত আমরা বিয়ে বাড়ির সিনের শুটিং করেছি। তারপর ভোর ৬টার বাসে করে আমাকে আদালতে হাজিরা দিতে পাবনা নিয়ে গেছেন দাদারা।'

পরিচালক তাওকীর কীভাবে তার খোঁজ পেলেন, জানতে চাইলে সোহেল বলেন, 'আমি ছোটবেলা থেকে সিনেমাপাগল। ৯০ দশকের নায়ক জসীম, মান্না ছিল আমার পছন্দের। আর রোমান্টিক নায়কদের মধ্যে সালমান শাহ।'

কারাগার থেকে পর্দায়
সোহেল শেখ। ছবি: ফুটপ্রিন্ট ফিল্ম প্রোডাকশন

একটু থেমে আবার বলেন, 'সেসময় হিন্দি সিনেমা দেখতাম ভিসিআরে৷ সানি দেওল, অজয়—এদের অনেক সিনেমা দেখেছি৷ সবসময় মনে মনে ভাবতাম, একদিন আমিও এরকম অভিনয় করব, আল্লাহ আমার দিকে চোখ ফিরিয়েছেন।'

'সিনপাট'-এ কীভাবে সুযোগ পেলেন? প্রশ্নের উত্তরে সোহেল জানান, বন্ধুরা মজার ছলে তার কিছু ভিডিও করেছিল। সেখানকার একটি ভিডিও দেখেন পরিচালক৷ এরপরই তার খোঁজ করেন তাওকীর৷ কিন্তু সোহেল তখন কারাগারে। বের হওয়ার পরেই কাজটি করেন তারা।

আঞ্চলিকতার টানে সোহেল বলেন, 'দাদা আমাক নতুন জীবন দিছেন। দুই বছর হয় খারাপ পথে যাইনি, এখন অভিনয়ই করতে চাই৷ খুব ইচ্ছা সিনেমায় কাজ করব।'

সিনপাটে নিজের অভিনয়ের প্রশংসা নিজেই করলেন সোহেল৷ সহজ-সরল ভঙ্গিতে বললেন, 'আমার অভিনয় এত ভালো হয়েছে যে কী আর বলব।'

সিরিজে নিজের সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্যের কথাও বলেন সোহেল৷ লঞ্চের ছাদে এক নারীর গলার হার ছিনিয়ে নদীতে ঝাপ দেন এবং সাঁতরে যান বহুদূর৷ শটটি এক টেকেই 'ওকে' হয়।

মজার তথ্য হলো সোহেল, সেই নারী আর তার স্বামীর চরিত্রের অভিনেতা ছাড়া লঞ্চের আর কেউই জানতেন না যে, সেখানে শুটিং চলছে৷ আশপাশের সাধারণ যাত্রীরা ভেবেছিলেন সত্যিকারের ছিনতাই হয়েছে৷ তাতে দৃশ্যটি অর্গানিক রিঅ্যাকশন পায়।

'আমি যেই রিক্সটা লিয়েছি, তা বড় বড় নায়করাও লিবে না', বলেন আত্মবিশ্বাসী সোহেল।

কারাগার থেকে পর্দায়
সিনপাটের একটি দৃশ্যে সোহেল শেখ। ছবি: ফুটপ্রিন্ট ফিল্ম প্রোডাকশন

জানতে চাইলাম, এই দৃশ্যের মতো বাস্তবেও এমন অভিজ্ঞতা আছে কি না? প্রশ্নটি শুনে কিছুটা বিব্রত হলেন। পরে হেসে বললেন, 'তা তো আছেই, এরকম আরও কত ইস্টোরি আছে।'

প্রায় ছয় বছর আগে (২০১৮ সাল) বাবাকে হারিয়েছেন, মাকে হারিয়েছেন তারও বহু আগে, ২০০৪ সালে ৷ দুর্ভাগ্য সোহেলের, দুজনের মৃত্যুর সময়ই তিনি ছিলেন জেলে৷ শেষ দেখা পাননি বাবা-মা কারোরই, 'বিশেষ অনুমতি' মেলেনি।

'বাপ, মা কারও কবরেই মাটি দিতে পারিনি, এই কষ্ট আমার সারাজীবন থাকবে৷ বাপ-মা চলে যাওনের পর আমি আবার খারাপ পথে চলা শুরু করি। তবে এখন আমি বেশ ভালো আছি৷ আর যেতে চাই না সেই পথে৷ খারাপ তো আর কেউ নিজের ইচ্ছায় হয় না৷ কিন্তু সেই পথে ঢোকা যত সহজ, বের হওয়া তত কঠিন', বলেন সোহেল।

কেবল অভিনয় নয়, ভালো গাইতেও পারেন সোহেল৷ তার মুখস্থ আছে প্রায় হাজারখানেক বাংলা ও হিন্দি গান৷ সিনপাটে তার কণ্ঠে কিছু গান রেখেছিলেন পরিচালক, কপিরাইট ইস্যুর কারণে পরে দৃশ্যগুলো বাদ দিতে হয়েছে।

কারাগার থেকে পর্দায়
সোহেল শেখ। ছবি: ফুটপ্রিন্ট ফিল্ম প্রোডাকশন

সিরিজে দেখানো হয়, দুই সন্তানের জনক সোহেল৷ বাস্তবে তিনি অবিবাহিত৷ কথায় কথায় জানান, তার জীবনেও প্রেম এসেছিল। তাও একবার নয়, দুই দুই বার। কিন্তু কারও সঙ্গেই ঘর বাঁধা হয়নি। বলেন, 'খারাপ পথে চললি কে আমাক বিয়া করবে? তবে এখন আমি ভালো আছি, ইচ্ছা আছে সংসার করব, যদি উপরওয়ালা চায়।'

'সিনপাট' তাকে দিয়েছে সম্পূর্ণ নতুন পরিচয় ও জীবন। এখন পরিচিত-অপরিচিতরা সোহেলকে দেখলেই চিনতে পারেন৷ 'আমার নগরবাড়ির লোকেরা পাগল হয়ে গেছে সিনপাট দেখে। আমাক দেখলেই সবাই সিনপাট সিনপাট বলে চিল্লায়।'

হঠাৎ পাওয়া এই খ্যাতি নতুন জীবনের আশা দেখাচ্ছে সোহেলকে৷ অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে চান তিনি। সামনের জীবনটা সুন্দরভাবে কাটিয়ে দিতে চান৷ সোহেল আশাবাদী যে, তার বিরুদ্ধে চলা মামলাগুলো থেকেও শিগগির খালাস পাবেন।

'গত দুই বছর ধরে আমি সৎ মানুষ। সিনপাট আমাক সেই সুযোগ করে দিছে', যোগ করেন সোহেল।

Comments

The Daily Star  | English

BNP sticks to demand for polls by December

In a meeting with Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night, the BNP restated its demands that the next general election be held by December and the government immediately announce a roadmap to that end.

3h ago