কেন কবি, আর কবিতা প্রকাশ করবেন না

ছবি: সংগৃহীত

ঘাড়ের ওপর জোঁয়ালের মতো বসা নিদারুণ প্রকাশের কালে জয় গোস্বামী জানাচ্ছেন, তিনি আর কবিতা প্রকাশ করবেন না। 'অবনী বাড়ি আছ'র কবি বলছেন, তিনি আর কবিতা প্রকাশ করবেন না, 'বৃষ্টি নামল যখন'-এর কবি বলছেন, তিনি আর কবিতা প্রকাশ করবেন না! বিশ্বাস করা যায়? 

আপাতত এই খবর হজম করা কবিতার নিষ্ঠাবান পাঠকদের জন্য সত্যিই কঠিন। দীর্ঘ ৫০টি বছর ধরে যে কবি কয়েকটি প্রজন্মকে শুধু কবিতা দিয়ে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রেখেছিলন, সেই কবির নতুন কবিতার স্বাদ আর পাঠকরা নিতে পারবেন না, ভিজতে পারবেন না আর তাঁর স্বর্গীয় কবিতাজলে। ভাবা যায়? ফলে কবিতা প্রেমিদের মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

সত্যিই ভাবা যায় না। চারদিকে যখন আত্মপ্রকাশের উৎসব, যখন ফেসবুক উসকানি দিচ্ছে আত্মপ্রকাশের, যখন টুইটার-ইউটিউব-টিকটক-ইনস্টাগ্রাম হরদম উসকানি দিচ্ছে প্রকাশ্য হওয়ার, তখনই কি না দুই বাংলার সন্তু কবি জয় নিজেকে প্রকাশ করা থেকে গুটিয়ে নিলেন।

আত্মপ্রকাশের সকল উসকানি, সকল প্রলোভন, সকল মোহ তখনই উপেক্ষা করা সম্ভব হয়, যখন আত্মপরীক্ষার সাধনায় নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেওয়া যায়। কবি নিজেও এই আত্মপরীক্ষার কথাই বলেছেন তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত 'জয় গোস্বামীর কবিতা প্রকাশের ৫০ বছর' পুস্তিকায়।

নিজের কবিতা প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের সময় পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়েছে। বিনামূল্যে পুস্তিকাটি পাওয়া যাচ্ছে কলকাতার বিভিন্ন বইয়ের দোকানে। সেই পুস্তিকাতে এক দীর্ঘ লেখায় জয় গোস্বামী তার এই আত্মপরীক্ষার কথা বলেছেন। বলেছেন, তিনি কবিতা লেখা চালিয়ে গেলেও তা আর প্রকাশ করবেন না।

জয় লিখেছেন, 'আমার ৫০ বছর কবিতা প্রকাশের পূর্তি আমি আমার রচনা প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েই উদযাপন করতে চাই। যেসব সম্পাদক আমার লেখা সম্মান দিয়ে এত বছর প্রকাশ করে এসেছেন তাদের কাছে আমার আভূমি-নত কৃতজ্ঞতা অর্পণ করি। পাশাপাশি আমার কাছে আর লেখা চেয়ে চিঠি না দেওয়ার অথবা ফোন না করার জন্যেও মিনতি জানাই। তাদের 'না' বলতে আমার দুঃখ হবে অথচ 'না' তো বলতেই হবে আমার আত্মপরীক্ষার জন্য। তারা যে আমাকে দুঃখ দিতে চান না, এ-কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি!'

আত্মপরীক্ষা প্রসঙ্গে এই কবি আরও লিখেছেন, 'একটি কবিতার পিছনে সর্বোচ্চ পরিশ্রম প্রয়োগ করার সময় লেখাটি কবে ছাপা হয়ে বেরোবে, এই বাসনাটিকে বিচ্ছিন্ন করা। যে-কোনো বাসনার মধ্যেই একরকম উত্তেজনা থাকে। লেখার উত্তেজনাটি জাগ্রত রইল। ছাপার বাসনা তথা উত্তেজনা নির্বাপিত হল সম্পূর্ণ। তা কি সম্ভব? আমার পক্ষে? এই বয়সেও যদি তা সম্ভব না হয়, তবে তা কবে হবে? এই পথটিই আমার সামনে পড়ে রয়েছে একমাত্র পথ হিসেবে। নিজের সম্পর্কে মমত্ব বর্জন করার এই এক উপায়। এ কেবল এক আত্মপরীক্ষা চালানো। এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন।'

বুঝতে অসুবিধা হয় না, কবি জয় গোস্বামী 'এই বয়সে' এসে মমত্ব বিসর্জন দিতে চাইছেন, বিষয় বাসনা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছেন। তিনি চাইছেন আত্মপরীক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে আরও সুদ্ধ হতে, চাইছেন আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্য দিয়ে মোহমুক্ত হতে।

বলাই বাহুল্য, এ সাধনার পথ বড় দুস্তর। এ পথে হেঁটেছিলেন মহামতি কাফকা, পুড়িয়ে ফেলেছিলেন নিজের লেখালেখির ৯০ শতাংশ। এ পথে হেঁটেছিলেন মহাত্মন জীবনানন্দ দাশ, নিজের লেখা কবিতা লুকিয়ে রাখতের তোশকের তলায়-ট্রাংকের ভেতর। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় জীবদ্দশায় মাত্র ১৫৬টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর। এ পথে হেঁটেছিলেন কবি সমর সেন, মাত্র ১২ বছর কবিতা লেখার পর বন্ধ করে দিয়েছিলেন লেখালেখিই।

কিন্তু তাদের চেয়ে জয়ের সাধনার পথ সত্যিই 'দুস্তর পরাবার'-সম; কারণ জয় এক সময় দুহাত খুলে লিখেছেন, উপভোগ করেছেন তুমুল জনপ্রিয়তার অমেয়। তাঁর পক্ষে জনপ্রিয়তার এই শেকল ছিন্ন করা সত্যিই কঠিন হবে। তা ছাড়া কাফকা-জীবনানন্দ-সমর সেনদের সময়ে আত্মপ্রকাশের এত এত ফাঁদ, ফেসবুক-টুইটার-অনলাইনের মতো এত এত মোহময় হাতছানি ছিল না। ছিল না ভক্ত-পাঠকদের অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফ আর সেলফির মতো মোহন বীণার সুর। ফলে নিজেকে সংবরণ করা সহজ ছিল।

জয় তবু কঠিনেরেই ভালোবাসিলেন। বেছে নিলেন কঠিন ও কণ্টকে আকীর্ণ পথ। বললেন, 'আমাদের সকলের মধ্যেই লুকিয়ে আছে হিটলার যে সমস্ত কিছু প্রাপ্তির পরেও অন্যের সর্বস্ব দাবি করে। সবটা পাওয়ার পর আমি সাহিত্য জগতের থেকে আর কতটা বা কী চাইতে পারি, বা চাইলেও কতটা সঙ্গত হবে?'

তাই সব চাওয়ার উর্ধ্বে উঠে সকল প্রকাশ মাধ্যম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। এমনকি এখন থেকে কেউ যেন পুরস্কার দেওয়ার জন্য তার নাম বিবেচনা না করেন—এমন অনুরোধও করেছেন বঙ্গভূষণ, বঙ্গবিভূষণ, সাম্মানিক ডি লিট, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিসহ অসংখ্য পুরস্কার পাওয়া এই কবি।

কবির এ চাওয়া পূর্ণ হোক—একজন জয়প্রেমী পাঠক হিসেবে আমরা আর কী ই বা চাইতে পারি। আমরা চাই, তার আত্মপরীক্ষার সাধনা সিদ্ধিলাভ করুক। তিনি মমত্ব বিসর্জন দিয়ে নির্বাণ লাভ করুন। জয়তু জয় গোস্বামী!

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

14m ago