‘সঙবাদ কার্টুন’ : কঠিন সময়ের চিত্র
স্বাধীনতার পর সামাজিক জীবন ভয়াবহ ও অস্থির হয়েছিল। অর্থাৎ ১৯৭২ সালে ঢাকা শহরের সর্বত্র সংকট নেমে এসেছিল। কালোবাজারী, চোরাচালানী, ব্যাংক ডাকাত, খুন, ধর্ষণ, অপহরণসহ নানা অশুভ দৈত্যে মানুষের জীবন নাভিশ্বাস। সে চিত্রই 'সঙবাদ কার্টুন' শিরোনামের নাটকে সেলিম আল দীন তুলে ধরেছেন। নাটকের দৃশ্যরূপ যেন তারই দলিল। এটি ১৯৭৩ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত নিয়মিত মঞ্চস্থ হয়। এখনো হয় অনেকের প্রযোজনায়।
সেলিম আল দীনের প্রথম দিকের রচনা সঙবাদ কার্টুন। নাটকটি সে সময় অত্যন্ত সফলতা অর্জন করে। এর উপযোগিতা এখনো চলমান। নাট্যকার একদিকে যেমন ছিলেন সমাজ সচেতন তেমনি ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা জাগরণে বিপ্লবী পথিকৃৎ। তার রচনাগুলোর মধ্যদিয়ে হাজার বছরের রচনারীতি ধারায় তুলে এনেছেন ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালির জীবন-সংস্কৃতি।
'সঙবাদ কার্টুন' নাটকটি প্রথম প্রযোজনা করে ঢাকা থিয়েটার। সেলিম আল দীনের নাটকের মাধ্যমেই তারা মঞ্চে আসেন। অস্থিরতাকালীন জন্ম নেওয়া এ ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ দেখা যায়। দেশজ ও মৌলিক নাটক প্রযোজনায় হাজার বছরের ঐতিহ্যলালিত বাঙালি জীবন, জীবনবোধ, সংস্কৃতি ও নাম-গোত্রহীন মানুষের সংগ্রামী জীবনচেতনা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে তাদের প্রযোজনায়। 'সঙবাদ কার্টুন' নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ।
নাটকটি সেসময়ের নানা ঘটনা, পরিস্থিতি ও রাজনীতির নানা কার্যকলাপকে নিয়ে কোলাস জাতীয় রচনা। এটি এ যাবত ৪৭ টির বেশি প্রদর্শনী হয়েছে। এতে সুনির্দিষ্ট কোনো একক কাহিনি নেই। ঢাকার অস্থির বাস্তবতাই এ নাটকের প্রতিপাদ্য। এতে চরিত্রেরও সুনির্দিষ্টতা নেই। সংবাদপত্রের নানা খবরকে কেন্দ্র করে স্কেচধর্মী উপস্থাপনা। একে সে সময়ের সামাজিক জীবনের ডকুমেন্টশন বললেও অত্যুক্তি হবে না। খবরগুলোর মধ্যে উঠে এসেছে- ছিনতাই, নকল দ্রব্যের ছড়াছড়ি, রাজনৈতিক নেতার চরিত্র, হত্যা, ধর্ষণ, পুলিশের নিস্ক্রীয়তা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ সামাজিক অস্থিরতাসহ নানা কিছু।
নাটকের কোনো অঙ্ক কিংবা দৃশ্যবিভাজন নেই। শুরুতে মিউজিকের তালে পুতুল নাচের ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে একজন। হাতে তার ঢাকা শহরের মানচিত্র। ঘোষক এগিয়ে এসে বলে উঠেন- 'সমবেত সুধী দর্শকবৃন্দ। আপনাদের সামনে প্ল্যাকার্ড সাইজের এই বস্তুটি খাদ্যের দাবী কিংবা অমুকবাদ তমুক হোক- এর মতো কোনো শ্লোগান নয়। এটা ঢাকা শহরেরর মানচিত্র এবং তা নিজেই একটা শ্লোগান। সব শ্লোগানের মিলিয়ে ঢাকা শহর- অথবা সমস্ত ঢাকা শহরই একটা শ্লোগান। ঢাকা শহর। জ্বি হ্যাঁ- কালোবাজারী, চোরাকারবারীর শহর, মুনাফাখোর-মজুতদারের শহর-হাইজ্যাকার-ব্যাংক লুটেরা নকলবাজের শহর। ঢাকা শহর।'
ঘোষক আরো দেখান ঢাকা শহরে এখন বাস করে গ্যাস্টিকে ভোগা বুদ্ধিজীবী, জন্ডিসে ভোগা কবিকূল, ছশ হাইজ্যাকার, পাঁচশ নকলবাজ, বিশ হাজার কেরানী, ছয় হাজার ব্যবসায়ী, ছয় হাজার কসাই, তিনশ কালোবাজারী ইত্যাদি। এখানে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে ধর্ষণ, অপহরণ নানা কিছু। তা থেকে মুক্তির উপায়?
পত্রিকা খুলে নিউজগুলো পড়তে থাকে ঘোষক। যখন গতকালের শিরোনাম পড়তে থাকে 'উন্মুত্ত জনতা কর্তৃক পিটিয়ে একজনকে হত্যা' তখন যেন উত্তেজিত জনতা এসে ঘোষককেই ধাওয়া করতে শুরু করে। পত্রিকায় প্রকাশিত খণ্ড খণ্ড ঘটনা-চিত্রের মাধ্যমে সমকালীন সমাজ-রাজনীতি-বাস্তবতার সংবেদনশীল মানব হৃদয়কে স্পর্শ না করে পারে না। ঢাকা পুলিশ যেন ভিন্নধর্মী আরেক চরিত্রে আর্বিভূত। মাথায় ছুঁচালো শিং- হাতে এক একটা কলা নিয়ে ছুলে খাবার ভঙ্গিতে নৃত্যের তালে তালে নাটকে চলাফেলা করে। ঢাকা শহরের এক অস্থিতিশীল বাস্তবতাকে কে রুখবে? তবে কী জনতা? এ নাটক যেমন নাটক নয়; এ নাটক যেমন অবক্ষয়ের প্রতিবাদ।
ঘোষক একের পর এক পত্রিকার সংবাদ মঞ্চে তুলে ধরতে থাকে-'১১ সেপ্টেম্বর। ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা স্থানীয় ব্যাংকে দুপুর বেলা- ইত্যাদি ইত্যাদি'। এ সামাজিক অবক্ষয়ের দায় কে নেবে? সুবেশ যখন ছিনতাইয়ের ভয়ে পুলিশ ঢাকে তখন দেখা যায় পুলিশ গাঁজা টানছে। সুবেশ ও হাইয়ে অনুরোধে পুলিশ ছিনতাইকারীকে ধরতে চাইলে খোঁজে পায় ছেঁড়া কাপড়, আন্ডারওয়ার ইত্যাদি। ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে পুলিশ চরিত্র ও সমাজের রূপরেখা তুলে ধরেন নাট্যকার-নির্দেশক।
রাজনৈতিক গুপ্ত হত্যায় ঢাকা শহরের সর্বত্র আতঙ্ক বিরাজমান তখন। ঘোষক সংবাদের পাতা থেকে তুলে আনতে থাকেন নানা সংবাদ। এমন সময় এক রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য ফুটে উঠে-
'বন্ধুগণ- আজ জাতির ক্রান্তিকালে হত্যা যেখানে কথায় কথায় উচ্ছৃঙ্খলতা যেখানে চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে- চোরাকারবারী মুনাফাখোরের কবলে সমগ্র বাংলাদেশ যেখানে নিমজ্জিত সেখানে আমরা বিপ্লবের লাল লেলিহান শিখার মশাল নিয়ে এগিয়ে যাবো। আমরা এই অযোগ্য সরকারের পতন চাই। অদূরদর্শী সরকার পরোক্ষভাবে কালোবাজারীদের হাতই শক্ত করছে। প্রায় চব্বিশ কোটি টাকার করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।' তবে আবার অন্য বক্তার বক্তব্যে পাওয়া যায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদেশ অমান্য করে যারা এখনো অস্ত্র জমা দেয়নি তারা দেশদ্রোহী। অতি বামপন্থীরা অবস্থাকে কেবল ধূমায়িত করে তুলছে।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি যেন ঢাকা সর্বত্র। ৩০০ টাকার শাড়ি হয়েছে ৮০০ টাকা। রেস্তোঁরায় খাবারের দামী আকাশচুম্বী। প্রতিবার ১০ পয়সা করে বেড়ে সিগারেটের দাম হয়েছে ১৫০ পয়সা। পণ্য ক্রয়ের ক্ষমতা নিম্ন বিত্ত ও মধ্যবিত্তের সামর্থের বাইরে। এর সমাধান কী। জনতা কী সমাধান দিতে পারবে। না পারবে না। দেখা যায় দোকানে দোকানে পণ্যের বদলে ফাঁসির দড়ি বিক্রি হচ্ছে। ফাঁস দিয়ে মরা থাকা আত্মরক্ষার আর কোনো সুযোগ নেই। তাই নাটকের শেষে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নৃত্যের তালে তালে গলায় রশি ঝুলিয়ে মৃত্যুর অভিনয়ের কায়দা ছাড়া আর করার কী কিছু থাকে।
খ
'সঙবাদ কার্টুন' নাটকটিতে বিকাশভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কোনো চরিত্র নেই। সংলাপনির্ভর কাহিনির বিকাশও ঘটেনি। কোনো ঘটনার সরাসরি নাট্যপ্রবহও এতে নেই। অর্থাৎ ঘটনাটি নিয়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। কিছু চরিত্রের সুনির্দিষ্ট কিছু উক্তি-প্রত্যুক্তি বা সংলাপ যদিও আছে তবুও সংবাদনির্ভর সমাজিক নকশা হিসেবেই নাটকটি প্রতিভাত। সামাজিক অস্থিরতার চিত্রমুখী এ নাটকটির প্রযোজনা প্রসঙ্গে ঢাকা থিয়েটার তাদের সুভিন্যুরে উল্লেখ করেন-
'একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সাধারণের প্রথমে অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে হয় এবং তাদের স্মৃতিতে ছিল আর্মি ক্র্যাকডাউনের নিষ্ঠুরতা। তাদের মুখোমুখি হতে হল এক নতুন ধরনের বাস্তবতার। যে বাস্তবতার উপকরণ কালো টাকা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। ফলে দেখা দেয় হতাশা। এই হতাশা এদেশের মধ্যবিত্তকে করলো বিচলিত, বিভ্রান্ত। কেউ কেউ মুক্তি চাইলো অন্যত্র, ভিন্নভাবে। মধ্যবিত্ত প্রধান এদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্দোলনে- রাজনৈতিক হউক সাংস্কৃতিক হউক মধ্যবিত্তেরই প্রাধান্য। '৪৮ আর '৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-এ সবই মধ্যবিত্ত বাঙালির গৌরবময় ভূমিকা। অথচ এই মধ্যবিত্ত সমাজ হতাশায়, বিভ্রান্তিতে, অন্যত্র মুক্তির অন্বেষণে আজ যেন কক্ষচ্যুত?'
নাটকটি তৎকালে যেমন ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল তেমনি নেতিবাচক নানা কথাতেও আলোচনার তুঙ্গে এসেছিল। প্রচলিত নাটক দেখার অভিজ্ঞতার বাইরে বিপরীতধর্মী আরেক ধরনের অভিজ্ঞতা। নাটককে তৎকালীন অনেকে স্ট্যান্ট, ডকুমেন্ট প্রদর্শন, বিশেষ রাজনীতি বক্তব্য প্রসূত বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আবার অনেকে এর কাহিনির পরম্পরাহীন বলে অ্যাবসার্ড বলেও অভিহিত করেছেন। তবে এর গল্পের পরম্পরা না থাকলেও এতে আছে তৎকালীন সমাজের অতি গভীর হৃদয়স্পর্শী আত্মদগ্ধ বাস্তবতা। বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন সাপ্তাহিক 'বিচিত্রা' পত্রিকায় এ নাটকের তিনজনের সাক্ষাতকার প্রকাশ করে। সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সাক্ষাতকারে রাজনীতি প্রসূত নয়, নাট্যনির্মাণের মূলে সমাজের নানা অসঙ্গতি দেখানোর প্রবণতাই প্রধান ছিল, তা উঠে আসে। প্রকৃতপক্ষে নাটকটি দেশ স্বাধীন হবার পর কী রকমের অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল তারই রূপরেখা; তারই দলিল। আর সামাজিক রূপরেখার সূত্র ধরে নাটকটি সবসময়েই প্রাসঙ্গিক।
সেলিম আল দীনের প্রথম দিকের রচনাগুলোতে সামাজিক চৈতন্য প্রাধান্য পেলেও আশির দশক থেকে শুরু হয়েছিল ঐতিহ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। নব্বয়ের দশকে এসে হাজার বছরের ঐতিহ্যের ভিত্তিতে জাতীয় নাট্য আন্দোলনে তৎপর হয়ে উঠেন। নাট্যচিন্তায় মূলত এগিয়েছেন উপনিবেশের জ্ঞানতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে বাঙালির আদর্শে। কবিতায় রেঁবো-বোদলেয়ার দ্বারা বুদ্ধদেব, নাটকে লেবেদেফের প্রসিনিয়াম ধারা, উপন্যাসে ওয়াল্টার স্কট প্রভাবে বঙ্কিমের আদর্শ যে আধুনিকতার সূচনা করেছিল তা ছদ্মবেশে অনেকাংশেই গ্রাস করেছিল আমাদের অতীত। ২০০ বছরে বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠেছিল ইউরোপীয় সাহিত্যের অন্ধ-অনুকরণ। এই সময়ে আমাদের শিল্পরীতির সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের পালা সৃষ্টি হয়েছিল বলে সেলিম আল দীন আত্মকষ্ট অনুভব করতেন। ফলে জীবনের বাকিটা ঐতিহ্যের পথ ধরে আধুনিকতার পাটাতনে হেঁটেছেন।
Comments