গন্তব্য অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প? জানুন ট্রেকিং অভিজ্ঞতা এবং প্রয়োজনীয় টিপস

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প

পাহাড় যাদের টানে তারা জানেন পথ যত কঠিন ততটাই বেশি সুন্দর শেষটা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি এলেও তারা থেমে দুদণ্ড শান্তি নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করেন। কারণ এই হেঁটে যাওয়ার মাঝেই আনন্দ। পাহাড়কে ভালোবেসেই ট্রেকিংকে ভালোবাসা। যারা ট্রেকিং পছন্দ করেন তাদের প্রায় সবার বাকেট লিস্টে একটি স্থান থাকেই, সেটি অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প।

আজকে অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প নিয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। যারা প্ল্যান করছেন অনেকদিন ধরে, তারা এবার গুছিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন। অন্নপূর্ণার ভয়ংকর সুন্দর রূপ দেখার সময় কিন্তু এখনই।

যাওয়ার আগে কী করবেন

● ৪০-৬০ লিটারের ট্রাভেল ব্যাগে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সুন্দর করে রোল করে গুছিয়ে নিবেন। ৬০ লিটারের বেশি বড় ব্যাগ অবশ্যই নেবেন না। 

● ড্রাই ফ্রুটস, খেজুর, বিস্কিট, কফি মিনি প্যাক, শুকনো খাবার ব্যাগে রাখবেন।

● এই জার্নিতে একটা উইন্ড ব্রেকার, একটা পাতলা ডাউন জ্যাকেট, একটা ভারী ডাউন জ্যাকেট, পঞ্চ, ভালো মোজা দুই সেট, একটা স্নো প্যান্ট, একটা ট্রেকিং প্যান্ট ফুল হাতা দুই-তিনটা টি-শার্ট, দুই সেট থার্মাল ইনার সঙ্গে নেবেন। বুট কাঠমান্ডু থেকে নিলেই ভালো।

● ট্রেকিংয়ে যাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার শারীরিকভাবে ফিট হওয়া জরুরি। তাই প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে হাঁটতে হবে। যদি সম্ভব হয় এক মাস অন্তত জিম করুন। 

ট্রেকিং

মিশন অন্নপূর্ণা

এবার আসি অন্নপূর্ণা ঘুরে আসার গল্পে। যেদিন ঠিক করি অন্নপূর্ণা যাব ঠিক সেদিনই এক মাস পরের ডেটে ঢাকা টু কাঠমান্ডুর টিকিট কেটে ফেলি। আগে কেটে ফেলাতে প্লেনের টিকিট কিছুটা কমে পেয়েছিলাম। আপনারাও চেষ্টা করবেন টিকিট আগেই কেটে ফেলার।

প্রথম দিন ঢাকা থেকে বিমান বাংলাদেশে করে পৌঁছালাম কাঠমান্ডু। সেখানে পৌঁছে মোটামুটি ভালোই সময় পেয়েছিলাম। থামেলে একটা হোটেল বুক করা ছিল। সেখানে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম। আপনারা যারা হালাল দোকানে খেতে চান তারা থামেলে 'বিসমিল্লাহ' নামে একটা হোটেল পেয়ে যাবেন। তাদের খাবার বেশ ভালো। খাওয়াদাওয়া শেষে একটু ঘোরাঘুরি, একটু বিশ্রাম তারপর রাতের খাবার খেয়ে বাসে করে পোখারা রওনা দিলাম। থামেলের কাছেই পোখারা যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। আশপাশে জিজ্ঞেস করলেই কাউন্টার দেখিয়ে দেবে। ও হ্যাঁ! থামেল থেকেই চেষ্টা করবেন মানি এক্সচেঞ্জ করে নেওয়ার।

সারারাত বাসযাত্রার পর ভোরে পৌঁছে গেলাম পোখারা। যখন পৌঁছাই তখনও সূর্যের আলো ফোটেনি। ফ্রেশ হয়ে একটা ছোটখাটো ঘুম দিয়ে উঠে পড়লাম। হোটেলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। এত সুন্দর ভিউ! যাই হোক, সকালটা ফেওয়া লেকে হাঁটতে অবশ্যই ভুলবেন না।

চাইলে সেদিনই ট্রেকিং শুরু করা যায়। কিন্তু আমি একদিন পোখারাতেই ছিলাম। আমার যাত্রা শুরু হয় পরের দিন।

নেপালে ট্রেকিং

ট্রেকিংয়ের শুরুতেই নেপাল ট্যুরিজম বোর্ড পোখারা থেকে পারমিশন নিতে হবে। যদি আপনি যেদিন পোখারা নামবেন সেদিনই ট্র্যাকিং শুরু করেন তবে আগের দিন কাঠমান্ডু থেকে পারমিশন নিয়ে নিবেন।

ট্রেকিংয়ের প্রথম দিন ভোরে জিপে করে ঝিনু নামের একটি স্থানে আসি। এখান থেকে ট্রেক শুরু হয়। যাব চোমরং।

এই পথটি সবচেয়ে কঠিন। একে তো ট্রেকিংয়ের প্রথম দিন, তার ওপর অসংখ্য সিঁড়ি। সঙ্গে রাস্তাও খাড়া। এই পথেই বিশাল লম্বা একটা সেতু পার করেছি। চমরং পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ছোট একটি লজে বুকিং করা ছিল আগে থেকে। অফ সিজনে গেলে লজে রুম বুক করতে পারবেন যাওয়ার পরে। কিন্তু সিজনে অবশ্যই আগে থেকে বুক করে যাওয়া ভালো। স্বাভাবিকভাবেই স্থল থেকে অনেকটা ওপরে চলে আসার জন্য ঠান্ডা বেড়ে গিয়েছিল।

দ্বিতীয় দিনের গন্তব্য দোভান। এইদিন আবহাওয়া ভালো ছিল, রোদ ছিল সকালের পর থেকে। প্রথম দিনের থেকে রাস্তাটাও সহজ মনে হয়েছে। অথবা প্রথম দিন শরীর ট্রেকিংয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠায় কষ্ট কম হয়েছে। এই পথ দিয়ে হাঁটার সময় বড় জলপ্রপাত চোখে পড়েছে।

নেপাল ভ্রমণ

সন্ধ্যার আগে আগে যখন দোভানে পৌঁছালাম তখন ভালোই ঠান্ডা অনুভব করা শুরু করি, পানিও বরফের মতো ঠান্ডা। যে লজে ছিলাম তার ঠিক পাশ থেকেই ঝরনার পানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

তৃতীয় দিনের ট্রেকিংটা বাকি দুইদিনের থেকে একদমই আলাদা। পৌঁছাতে হবে মাছাপুছারে বেজ ক্যাম্প (এমবিসি)। পুরো ট্রেকে অনেকগুলো ভ্যালিই মন কাড়বে, তবে দোভান থেকে এমবিসি যাওয়ার পথেই ভ্যালিটা সবথেকে বেশি সুন্দর। ভ্যালি থেকে আগাতে থাকলেই বরফের রাজ্যে ঢুকে যেতে শুরু করবেন। সন্ধ্যার আগে গিয়ে পৌঁছালাম এমবিসিতে।

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অন্ধকার নামতে শুরু করল। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে একটা অদ্ভুত সুন্দর চাঁদ উঠল আকাশে। আমি তখন ফিলিপিনের এক মেয়ের সঙ্গে গল্প করছিলাম বাইরে বসে। চাঁদটা যখন উঠে আমরা দুজনই চুপ করে তাকিয়ে ছিলাম সেই অদ্ভুত রহস্যময়ী চাঁদের দিকে। চাঁদের আলোতে বিশাল বিশাল পাহাড়গুলোকে যেন এক একটি দৈত্যের মতো লাগছিল।

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প

এমবিসিতে অনেকেরই একিউট মাউন্টেইন সিকনেস হতে পারে। যদি মাথা ঘোরানো, বমি বমি ভাব কিংবা বমি হয় তবে অবশ্যই গ্রুপের কাউকে জানাবেন আর একা ট্রেকার হলে পাশে যিনি আছে তাকেই বলুন। যে লজে উঠেছেন সেই লজে জানান। সাধারণত ট্রেকাররা এমন অবস্থায় সবসময়ই সাহায্য করেন।

এমবিসিতে রাত কাটিয়ে পরের দিন ভোর ৪টার দিকে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের (এবিসি) উদ্দেশে রওনা হই। খুবই সতর্কতার সঙ্গে মাথায় হেডলাইট বেঁধে হাঁটা শুরু হয়। উদ্দেশ্য এবিসিতে গিয়ে সূর্যোদয় দেখা। অন্ধকার রাতে পাহাড়ের ভয়ংকর রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়ার অ্যাডভেঞ্চার এই ট্রেকিংয়ের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। এমবিসির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর আস্তে আস্তে সূর্য উঠছে। পাহাড়ের ওপর দিয়ে সূর্যের আলো এসে বিশাল অন্নপূর্ণার ওপর পড়ে তখন ভ্যালিতে সাদা বরফগুলো চকচক করছিল, মনে হচ্ছিল সোনার খনি! আমি সেদিন সেই মুহূর্তে ভয়ংকর সুন্দরের মানে বুঝতে পেরেছিলাম।

সাত নম্বর দিন ঝিনু নেমে পোখারা চলে আসি। যদি আপনাদের হাতে সময় থাকে তবে আপনারা রুট প্ল্যান আরও সহজ করে নিতে পারেন। যেমন-

প্রথম দিন ঝিনু থেকে ট্রেকিং শুরু করে চমরং, দ্বিতীয় দিন চমরং থেকে আপার সিনুওয়ার, তৃতীয় দিন আপার সিনওয়ার থেকে হিমালয়, চতুর্থ দিন হিমালয় থেকে দেউরালি, পঞ্চম দিন দেউরালি থেকে মাছাপুছারে বেস ক্যাম্প (এমবিসি), ষষ্ঠ দিন এমবিসি থেকে এবিসি (অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প) এভাবেও সাজিয়ে নিতে পারেন। এতে আপনার ট্রেকিং প্রতিদিন কম করতে হবে।

অন্নপূর্ণার সৌন্দর্য কিংবা অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প পৌঁছানোর সৌন্দর্যের বর্ণনা লিখে প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তবে এটুকু অবশ্যই বলতে পারি, সত্যিই যদি পাহাড় ভালোবাসেন তাহলে আর দেরি না করে প্ল্যান করে ঘুরে আসুন অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প। নিজেকে উপহার দিন সেরা কিছু মুহূর্ত, সেরা কয়েকটি দিন।

এই পুরো ট্রেকিংয়ে আপনার পরিচয় হবে নানা দেশের নানা মানুষের সঙ্গে। ভাগ্য ভালো থাকলে বন্ধুও খুঁজে পাবেন। ভিন্ন খাবারের অভিজ্ঞতা, একটানা হাঁটা আর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে আপনি খুঁজে পাবেন এক অন্য আপনাকে।

ছবি: সাইমা তাবাসসুম উপমার সৌজন্যে 

Comments

The Daily Star  | English

Over 102,000 annual deaths in Bangladesh linked to air pollution

Study also finds air pollution behind 266 million sick days every year hurting the economy

1h ago