যেভাবে যাবেন রহস্যঘেরা সেই কামরূপ কামাখ্যা

পূর্ণাঙ্গ কামাখ্যা মন্দির। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

'কামরূপ কামাখ্যা' নামটি শোনেননি দেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রহস্য, যাদুবিদ্যা, তন্ত্র-মন্ত্রে সিদ্ধহস্ত তান্ত্রিকদের নানা গল্প।

রহস্যে ভরা নানা লৌকিক গল্প শোনা যায় কামরূপ কামাখ্যা সম্পর্কে। বলা হয়, এটি ছলাকলা আর জাদুবিদ্যায় পারদর্শী ডাকিনী, যোগিনী আর তান্ত্রিকদের জায়গা! দুর্গম পাহাড়ে জাদুটোনার দেশ কামরূপ কামাখ্যা নারী শাসিত। যেখানে গেলে কেউ নাকি ফিরে আসতে পারে না। জাদুকররা তাদের বন্দী করে নিজেদের কাজ করায়, কাউকে জীবনসঙ্গী, আবার কাউকে পাথর বা ভেড়া বানিয়ে রেখে দেয় এমন কল্পকথাও প্রচলিত আছে।  

কামরূপ কামাখ্যা মন্দির কোথায়

রহস্যঘেরা কামরূপ কামাখ্যা কিন্তু বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতের আসাম রাজ্যে এর অবস্থান।

কামরূপ আসাম রাজ্যের একটি জেলার নাম। কামরূপ ছিল মূলত একটি রাজবংশ। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সাল থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের উপত্যকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল কামরূপ রাজাদের রাজত্ব। পরে অহম রাজা কামরূপ দখল করেন।

কামাখ্যা মন্দির প্রাঙ্গণ। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

আসামের গুয়াহাটি শহর থেকে পশ্চিমাংশে নীলাচল পাহাড়েই চূড়ায় কামরূপ কামাখ্যা মন্দির। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই মন্দির। একান্ন সতীপীঠের অন্যতম এবং চার আদি শক্তিপীঠের মধ্যে কামাখ্যা মন্দিরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

কামরূপ কামাখ্যা নামের সঙ্গে কল্পকাহিনী আর লৌকিকতা মিশে থাকলেও বাস্তবে সেসবের দেখা মেলে না এখানে।

নীলাচল পাহাড়ের পাদদেশ থেকে চূড়ায় উঠার পথ খুব সুন্দর, পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়িতে করে যেতে পারবেন যে কেউ। নীলাচল পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে প্রতি মুহূর্তে। পাহাড়ে পাদদেশে জনবসতি ছাড়াও পাহাড়ের  বুকে গড়ে উঠা রঙ-বেরঙের ঘরবাড়িতে প্রাণচাঞ্চল্য চোখে পড়ার মতো।  চূড়ায় উঠে যাওয়া পথের দুই পাশেই শত শত দোকান। যেখানে পূজার সামগ্রী ও সৌখিন জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ভক্ত, দর্শনার্থীদের ভিড় দেখতে পাবেন প্রায় প্রতিটি দোকানেই।

কামরূপ কামাখ্যা শক্তিপীঠ কী করে হলো

হিন্দু পুরান অনুসারে, সতী দেবী তার বাবা দক্ষ রাজার অমতে বিয়ে করেছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবকে। প্রতিশোধ নিতে দক্ষ রাজা এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন, আর সেই যজ্ঞে সবাই আমন্ত্রিত হলেও সতী এবং মহাদেব কাউকেই নিমন্ত্রণ করেননি দক্ষ রাজা। মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী বাবার যজ্ঞানুষ্ঠানে যান, সেখানে মহাদেবকে অপমান করেন দক্ষ রাজা। সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞে দেহত্যাগ করেন সতী। শোকে ক্রুদ্ধ মহাদেব যজ্ঞ ভণ্ডুল করে সতী দেবীকে তুলে নেন এবং প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব বন্ধ করতে অন্যান্য দেবতাদের অনুরোধে বিষ্ণুদেব তার সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীদেবীর মৃতদেহ ছেদন করেন।

কামাখ্যার সাধু। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

সতীদেবীর দেহখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশের ৫১টি জায়গায় পতিত হয়েছিল, সেখানেই গড়ে উঠে শক্তিপীঠ, যা সতীপীঠ নামেও পরিচিত। কামাখ্যা মন্দির সেই শক্তিপীঠের অন্যতম। কারণ দেবী সতীর গর্ভ এবং যোনি এখানে পতিত হয়েছিল।

কামরূপ কামাখ্যা মন্দিরের আকার ও স্থাপত্য

দেবী কামাখ্যাকে উর্বরতার দেবী বলা হয়। মন্দির চত্বরে দশ মহাবিদ্যার মন্দির রয়েছে। কামাখ্যা মন্দিরের মূল অংশটি মন্দিরের মধ্যে পাহাড়ের গুহার ভেতরে।

কামাখ্যা মন্দিরের চূড়াগুলো মৌচাকের মতো দেখতে। মন্দিরে চারটি কক্ষ রয়েছে। গর্ভগৃহ এবং চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির নামে তিনটি মণ্ডপ। মন্ডপগুলোর স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সমতুল্য। খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্যভারতীয় মন্দিরের আদলে খোদাইচিত্র দেখা যায়।

কামাখ্যা মন্দিরে পূজার ফুল, মালার দোকান। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

মন্দিরের গর্ভগৃহ পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত, এটি ভূগর্ভস্থ একটি গুহা। ছোট এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহায় সরু খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশের সময় অন্যরকম এক অনুভূতি হয়। ভেতরে কোনো প্রতিমা নেই। ঢালু পাথরের একটি খণ্ড রয়েছে, যা যোনি আকৃতির। এটিতে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর গর্ত, ভূগর্ভস্থ প্রস্রবণের জল বেরিয়ে গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই শিলাখণ্ডটি দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত হন, যা দেবীর পীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ।

 অম্বুবাচী মেলা ও অন্যান্য উৎসব

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, আষাঢ় মাসে মৃগ শিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে ধরিত্রী মা ঋতুমতী হয়, এই সময়টিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়। অম্বুবাচীর দিন থেকে তিন দিন দেবী কামাখ্যা মন্দির বন্ধ থাকে, কোনো মাঙ্গলিক কাজ করা যায় না। চতুর্থ দিন দেবীর স্নান ও পূজা শেষে মন্দিরে দেবী দর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়।

প্রতি বছর অম্বুবাচীর সময় মেলার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্ত ও পর্যটকরা ভিড় করেন কামাখ্যা মন্দিরে।

কামাখ্যা মন্দিরে পূজা করলে সব ইচ্ছে পূরণ হয়, এমনটাই বিশ্বাস সনাতন ধর্মালম্বীদের। তাই তো, দুর্গাপূজাসহ সব বড় উৎসবের সময় সাধু সন্ন্যাসীদের সমাগম বাড়ে এই মন্দিরে।

কামাখ্যা মন্দিরের ইতিহাস

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মঙ্গলদের আক্রমণে প্রথম কামাখ্যা মন্দির ধ্বংস হয়েছিল। এরপরও কয়েবার আক্রমণ হয়েছে এবং পুনরায় নির্মিত হয়েছে। বর্তমান কামরূপ কামাখ্যা মন্দিরটি অহম রাজাদের রাজত্বকালে নির্মিত।

এই মন্দিরের ভূগর্ভেই কামাখ্যার পূজা হয়। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

কীভাবে যাবেন

প্রথমে ভারত যাওয়ার জন্য ভিসা নিতে হবে। সড়ক পথে সিলেট হয়ে তামাবিল যাবেন। সেখান থেকে বর্ডার পার হয়ে আসামের গুয়াহাটির উদ্দেশে বাস অথবা ট্যাক্সি ধরতে পারবেন। গুয়াহাটি থেকে কামরূপ কামাখ্যা মন্দির খুব বেশি দূরের পথ নয়। ট্যাক্সি নিয়েই যেতে পারবেন।

ঢাকা থেকে আসামের সরাসরি উড়োজাহাজ নেই। বিমানে ঢাকা থেকে কলকাতা, এরপর কলকাতা থেকে আসামের গুয়াহাটির ফ্লাইট ধরতে হবে।

কোথায় থাকবেন

সব মানের হোটেল পেয়ে যাবেন থাকার জন্য। অনলাইন অথবা স্পটে পৌঁছে পছন্দমত বুক করতে পারবেন।

যা মনে রাখা জরুরি

১. খুব ভোর থেকেই মন্দিরে পূজা দেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। যারা ভূগর্ভস্থ মন্দিরে যেতে চান তারা সময় নিয়ে যাবেন মন্দিরে।

২. মন্দির প্রাঙ্গণে খালি পায়ে প্রবেশ করতে হয়।

৩. অম্বুবাচীর সময় সাধারণত জুন মাসে মন্দির তিন দিনের জন্য বন্ধ থাকে, যদিও সেসময় মন্দিরের পাশে বসে ঐতিহ্যবাহী অম্বুবাচী মেলা। ভ্রমণের জন্য এই সময়টি বেছে নিতে পারেন।

 

Comments

The Daily Star  | English

Injured uprising protesters block Mirpur Road

Injured protesters from last year's mass uprising blocked Mirpur Road demanding medical treatment and rehabilitation

1h ago