নওগাঁর সাব্বীরের বিরিয়ানি: ৪০ বছর ধরে যার স্বাদ বেড়েই চলেছে

সাব্বীরের বিখ্যাত খাসির বিরিয়ানি, সাব্বীর আনছারী ও দোকানের মূল অবস্থান। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

উত্তরবঙ্গের নওগাঁ শহরে বিরিয়ানির নাম শুনলেই সবার মনে পড়ে যায় সাব্বীর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের কথা। বিরিয়ানি আর সাব্বীর শব্দ দুটো যেন সমার্থক হয়ে উঠেছে নওগাঁয়।

শহরের ধর্মতলা রোডের আটাপট্টিতে অবস্থিত এই দোকানটি। খাসির বিরিয়ানি ও মোরগ পোলাওয়ের জন্যই বিখ্যাত এ দোকান। তবে তাদের খাবারের তালিকায় কাচ্চি, ভাত, মাছ-মাংস ও রকমারি মিষ্টি ও দইও আছে।

তবে এ দোকানের শুরুটা ছিল ডাল আর রুটি দিয়ে, সঙ্গে ছিল চা। 

১৯৭৪ সালের কথা। ইদ্রিস আনছারী ও সায়রুন্নেসার বড় ছেলে সাব্বীর আনছারী তখন কিশোর। 

দোকানের স্বত্বাধিকারী ইদ্রিস আনসারী রুটি তৈরি করতেন, ছেলে সাব্বীর আনছারীর দায়িত্ব ছিল পরিবেশন। 

সাব্বীরের বিখ্যাত দই ও মিহিদানা লাড্ডু। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

১৯৮০ সালে সাব্বীরের যখন ছয় বছর বাবার দোকানে কাজের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে, তখন একদিন এক ব্যবসায়ীর এক অনুষ্ঠানের জন্য মোরগ-পোলাও রান্নার অর্ডার পেলেন ইদ্রিস।

বাবার পরামর্শ নিয়ে সাব্বীর দুই কেজি চালের পোলাও ও ১০টি মুরগি রান্না করেন। রান্না তো হলো, কিন্তু দেখা গেল, খাবারগুলো আর কেউ নিতে আসছে না! 

সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। এলাকার যুবক মোশতাক সন্ধ্যায় রুটি খেতে আসেন দোকানে। কিন্তু সেখানে পোলাও দেখে তার আগ্রহ হয়। পোলাও ও মুরগির রোস্ট দিতে বলেন তিনি। 

সাব্বীরের সেদিনের রান্না করা খাবার খেয়ে মোশতাক খুবই তৃপ্তি পান। হাফ প্লেট পোলাও ও হাফ বাটি মুরগির মাংস খেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। সাব্বীর পোলাও-মাংসের দাম রেখেছিলেন ১৩ টাকা। 

খেয়ে দোকান থেকে চলে যাওয়ার পর, আবার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দোকানে আসেন মোশতাক। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত প্রায় ৪০ জন সেদিন সাব্বীরের রান্না করা পোলাও-মুরগী খেয়েছিলেন।

অণুপ্রাণিত হন সাব্বীর। পরদিন তিন কেজি চালের পোলাও ও ১২টি মুরগি রান্না করেন। সেদিনও সব খাবার শেষ হয়ে যায়। 

দোকানটি তখন ছিল খুবই ছোট। টিনশেড বেড়ার ঘর। সবমিলিয়ে ছয়জন বসতে পারতেন। 

দিনে দিনে সুনাম বাড়তে থাকে, দোকানে ১২ জনের বসার ব্যবস্থা করেন সাব্বীর আনছারী। তবে তখনো অনেকেই জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন বাইরে। 

ইদ্রিস আনছারী আগের তুলনায় সময় দেওয়া কমিয়ে দেন। সাব্বীর নিজেই রান্না করতেন। রান্নার কাজে সহায়তা ও খাবার পরিবেশনের জন্য সাইফুল নামে এক ছেলেকে রাখলেন।

এভাবে অনেক বছর চলে যায়। দোকানের পরিসর বাড়ে সাব্বীরের। এখন তার নিজের পাঁচতলা ভবন। দোতলায় হোটেল, তিন তলায় কমিউনিটি সেন্টার, চার তলায় স্টোররুম, পাঁচ তলায় রান্নার ব্যবস্থা। 

আগে যেখানে টিনশেড দোকান ছিল, সেখানে এখন দই ও মিষ্টি বিক্রি করেন। 

সাব্বীর আনছারীরা চার ভাই। ছোট ভাই শামীম আনছারী ও শফিক আনছারী ব্যবসা দেখাশোনা করেন। সাব্বীরের বয়স এখন প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। মিষ্টির দোকানে নিয়মিত বসেন তিনি। 

নতুন ভবনের দোতলার বিরিয়ানি, পোলাও, ভাত, মাছ-মাংস, ভর্তা-ভাজির রেস্টুরেন্টে সাধারণত বসেন শামীম কিংবা শফিক আনছারী। 

এখানে একসঙ্গে ৫৬-৬০ জন বসে খাবার খেতে পারেন। দুপুরের পর ও রাতে ৯টার দিকে ভিড় বেশি হয়ে থাকে। 

খাসির বিরিয়ানি প্রতি প্লেট ২০০ টাকা, মোরগ পোলাও ১৮০ টাকা, কাচ্চি ১৮০ টাকা দামে বিক্রি করেন তারা। 

দোকানে বর্তমানে কর্মচারী ২২ জন। আশেপাশের নানান আয়োজন ও অনুষ্ঠানের জন্য নিয়মিত অর্ডার করা হয় তাদের খাবার। রমজান মাসে মুখরোচক নানান ইফতার সামগ্রী তৈরি হয়।

প্রতিদিন দুপুর ও রাত মিলিয়ে প্রায় ৬০০-৭০০ জন এখানে খাবার খান। প্রতিদিন বিরিয়ানি ও পোলাও মিলিয়ে ৮০ কেজি চাল রান্না হয় এখানে। মাংস কিনে থাকেন স্থানীয় বাজার থেকে। মুরগি ও খাসি রান্না করা হয়, গরুর মাংসের বিরিয়ানির ব্যবস্থা নেই। 

সাব্বীর জানান, তাদের দোকানে খাসির বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও বেশি বিক্রি হয়। কাচ্চিও চালু করেছেন। অনেকে আবার ভাত-ভর্তা-মাছও খেতে চান। মুরগির লটপটিও অন্যতম জনপ্রিয় আইটেম। 

বিরিয়ানিতে সরিষার তেল ব্যবহার করেন তারা, যা এর স্বতন্ত্র স্বাদের কারণ।

সাব্বীর বলেন, 'এখনো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করি। আমার তিন ভাই ব্যবসা দেখভালে সাহায্য করে। ২০১৮ সালে নওগাঁ জেলার সেরা হোটেলের পুরস্কার পেয়েছি জেলা প্রশাসন থেকে।'

তিনি বলেন, 'খুব বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি আমি। তবে ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করছে। সততার সঙ্গে ব্যবসা করে এতদূর এসেছি, যতদিন বাঁচি সততার সঙ্গেই ব্যবসা করে যেতে চাই।'

Comments

The Daily Star  | English

Reform commission reports provide framework for new Bangladesh: Yunus

Earlier this morning, the chiefs of four reform commissions submitted their reports to the chief adviser

51m ago