ভারতীয়-মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির অন্যতম নিদর্শন কুতুব মিনার

ইতিহাসের স্বাক্ষী কুতুব মিনার: যা দেখতে পাবেন, যেভাবে যাবেন
কুতুব মিনার কমপ্লেক্স। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

দিল্লির কুতুব মিনার ইট দিয়ে তৈরি বিশ্বের সর্বোচ্চ মিনার। লাল বেলেপাথরের এই মিনার সৌন্দর্য আর ইতিহাসকে ধারণ করে আজো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের মাটিতে।

দিল্লির আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা কুতুব মিনারে আসা পর্যটক সংখ্যা অনেক সময় তাজমহলকেও ছাড়িয়ে যায়। ১৯৯৩ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে তালিকাভুক্ত হয়েছে কুতুব কমপ্লেক্স।

১১৯৩ সালে দিল্লি জয় করেন কুতুবুদ্দিন আইবক; ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক ছিলেন তিনি। কুতুবুদ্দিনের আদেশে ১১৯৩ সালে কুতুব মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

দূর থেকেই কাছে টানে কুতুব মিনারের সৌন্দর্য
খিলজির আলাই মিনার। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

তবে ১৩৮৬ সালে মিনারের উপরের তলাগুলোর কাজ সম্পূর্ণ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক। ভূমিকম্প ও বজ্রপাতে একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুতুব মিনার, যা পরবর্তী শাসকরা সংস্কার করেন। মিনারের আশেপাশে বেশকিছু প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় স্থাপনা ও ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যা কুতুব মিনার কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত।

প্রাচীন হওয়ার স্বাক্ষী হয়ে থাকা হাজার বছরের পুরোনো স্থাপনা ছুঁয়ে না দেখলে বোঝা যায় না এর গভীরতা। এখানে ইতিহাস কথা বলে যায়; আর অপেক্ষা করে কালের স্বাক্ষী হয়ে টিকে থাকার। যুদ্ধ, রক্ত, গৌরব কিংবা ভালোবাসার গাঁথুনি মজবুত হয়; তাই হয়ত আজো মাথা উঁচু করে টিকে আছে কুতুব মিনার কমপ্লেক্সের স্থাপনা নিজের সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে। আর যেসব ক্ষয়ে গেছে, ভগ্নপ্রায়, তাদের মর্যাদাও কম নয়।

কী কী দেখবেন কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে

কুতুব মিনার

দূর্গের কিল্লা রাই পিথোরার ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মিত হয়েছিল কুতুব মিনার। কুতুব মিনারের পাঁচটি তল রয়েছে, প্রতিটি তলে রয়েছে একটি ঝুলন্ত বারান্দা।  মিনারের পাদদেশের ব্যাস ১৪ দশমিক ৩ মিটার, যা ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে ৭২ দশমিক ৫ মিটার উচ্চতায় শীর্ষে ২ দশমিক ৭ মিটার সরু হয়েছে। লাল বেলেপাথরে তৈরি মিনারে খোদাই করা আছে পবিত্র কোরআনের আয়াত।

নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর এই মিনার ভারতীয়-মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। দূর থেকেই কাছে টানে এর সৌন্দর্য, আর যত সামনে যেতে থাকে পর্যটকদের ততটাই বিমোহিত করে কুতুব মিনার।

আলাই দরওয়াজা

কুওয়াত-উল-ইসলাম মসজিদের দক্ষিণ দিকের প্রবেশদ্বার হলো আলাই দরওয়াজা। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি ১৩১১ সারে নির্মাণ করেছিলেন এটি। লাল বেলেপাথর ও সাদা মার্বেলে অলঙ্কিত অসাধারণ কারুকার্য মুগ্ধ করে পর্যটকদের।

দূর থেকেই কাছে টানে কুতুব মিনারের সৌন্দর্য
কুওয়াত-উল-মসজিদ। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

কুওয়াত-উল-মসজিদ

১১৯২ সালে নির্মিত কুওয়াত-উল-ইসলাম মসজিদও রয়েছে মিনারের পাশে, যেটি কুতুব মিনারের থেকেও পুরোনো। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বলছে, মসজিদটি একটি মন্দিরের অবশিষ্টাংশের উপরে স্থাপিত হয়েছিল এবং এটি অন্যান্য ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির থেকে নেওয়া সামগ্রী থেকেও নির্মিত হয়েছিল, যা পূর্ব দিকের মূল প্রবেশপথে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

দূর থেকেই কাছে টানে কুতুব মিনারের সৌন্দর্য
লৌহ্যস্তম্ভ। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

লৌহ্যস্তম্ভ

কুতুব মিনার চত্বরেই রয়েছে দিল্লির রহস্যময় লৌহস্তম্ভ। ১৬০০ বছরের পুরোনো এই লৌহস্তম্ভে আজো মরচে পড়েনি। সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় ৪০২ সালে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদয়গিরিতে এই স্তম্ভটি প্রথম স্থাপিত হয়েছিল। ১২৩৩ সালে স্তম্ভটিকে দিল্লির বর্তমান অবস্থানে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। যদিও বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, এটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের আগে ৯১২ খ্রিষ্টপূর্বের নির্মাণ।

দূর থেকেই কাছে টানে কুতুব মিনারের সৌন্দর্য
ইলতুতমিশের সমাধি। ছবি: সোমনাথ দত্ত

ইলতুতমিশের সমাধি

দিল্লি সালতানাতের শাসক সুলতান ইলতুতমিশের সমাধিও দেখতে পাবেন কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে। শ্বেত মার্বেলে বাঁধানো সমাধিসৌধটি চেম্বারের মাঝখানে একটি উত্থিত মঞ্চে স্থাপন করা। পুরো চেম্বারে ইসলামিক স্থাপত্যের পাশাপাশি হিন্দু মোটিভের সমন্বয় চোখে পরার মতোই।

দূর থেকেই কাছে টানে কুতুব মিনারের সৌন্দর্য
আল্লাউদিন খিলজির সমাধি ও মাদ্রাসা। ছবি: সোমনাথ দত্ত

আল্লাউদিন খিলজির সমাধি ও মাদ্রাসা

কুতুব মিনার কমপ্লেক্সেই দেখা মিলবে খিলজি রাজবংশের দ্বিতীয় সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সমাধি এবং তারই নির্মিত মাদ্রাসা। ১২৯৬ সাল থেকে ১৩১৬ সাল পর্যন্ত দিল্লির শাসক ছিলেন আলাউদ্দিন খিলজি।

দূর থেকেই কাছে টানে কুতুব মিনারের সৌন্দর্য
রাতের কুতুব মিনার। ছবি: সোমনাথ দত্ত

খিলজির আলাই মিনার

কুতুব মিনারের চেয়ে উচ্চতায় দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়ে আলাউদ্দিন খিলজি আলাই মিনার নির্মাণ শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। ১৩১৬ সালে তার মৃত্যুর পর থেমে যায় এর কাজ। খিলজি রাজবংশের তার উত্তরসূরিরা আলাই মিনারের কাজ পুনরায় শুরু না করায় পরিত্যক্ত হয় মিনারটি। আজো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে সেটি দাঁড়িয়ে আছে ভগ্নপ্রায় অবস্থায়।

রাতের কুতুব মিনারের সৌন্দর্য

দিনের আলোতে কুতুব মিনার যেমনটা দেখায়, রাতে এর সৌন্দর্য বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আলোয় সাজানো হয় কুতুব কমপ্লেক্স। এক অদ্ভুত মায়া ছড়িয়ে থাকে সেই আলো আঁধারিতে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন কুতুব কমপ্লেক্স। যদি হাতে সময় থাকে, সূর্য ডোবার পর একবার ঘুরে আসতে পারেন কুতুব মিনারে।

দূর থেকেই কাছে টানে কুতুব মিনারের সৌন্দর্য
কুতুব মিনার। ছবি: সোমনাথ দত্ত

কীভাবে যাবেন

ভারতের ভিসা নিতে হবে প্রথমে। উড়োজাহাজে সরাসরি যেতে পারেন দিল্লি। অথবা কলকাতা হয়ে ট্রেনে দিল্লি যাওয়া যাবে। দিল্লিতে গাড়ি ভাড়া করে কিংবা মেট্রোরেল ধরে পৌঁছে যেতে পারবেন দক্ষিণ দিল্লির মেহেরৌলি সংলগ্ন  কুতুবমিনার কমপ্লেক্সে।

কখন যাবেন

সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকে কুতুব মিনার কমপ্লেক্স; সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। অক্টোবর থেকে এপ্রিল ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময়।

দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রবেশমূল্য ভিন্ন। অনলাইনে অথবা সরাসরি এসে টিকিট কিনতে পারবেন।

যা মনে রাখা জরুরি

প্রবেশ কুপনটি অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন, কারণ বের হওয়ার সময় তা দেখাতে হবে। অন্যথায় জরিমানা গুণতে হতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

Govt relieves Kuet VC, Pro-VC of duties to resolve crisis

A search committee will soon be formed to appoint new candidates to the two posts

1h ago