গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস: কেন হয়, কারা ঝুঁকিতে, কখন পরীক্ষা করতে হবে

ছবি: সংগৃহীত

রোগটার নাম হচ্ছে ডায়াবেটিস আর যে ব্যক্তির ডায়াবেটিস আছে তিনি হচ্ছেন ডায়াবেটিক। আগে তাদের রোগী বলা হত এখন তা বলা হয় না। যার ডায়াবেটিস আছে তাকে ডায়াবেটিক পারসন হিসেবেই দেখেন চিকিৎসকরা। আগে না থাকলেও গর্ভাবস্থায় অনেকেরই ডায়াবেটিস দেখা দেয়।

কেন গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়, লক্ষণ, করণীয় বিষয়ে নিয়ে বিস্তারিত জেনে নিন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারিয়া আফসানার কাছ থেকে।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কেন হয়

ডা. ফারিয়া আফসানা জানান, কিছু কিছু ঝুঁকি আছে যেই ঝুঁকিগুলো যদি কারো থাকে তাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে-

  • বয়স যদি ২৫ এর বেশি হয়
  • যদি ওজন বেশি থাকে
  • যদি কোনো শারীরিক পরিশ্রম না থাকে এবং সারাদিন বসে থাকার প্রবণতা থাকে
  • পরিবারে কারো যদি ডায়াবেটিস থাকে
  • এমন যদি হয় যে আগেরবার গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ছিল এবং তারপর ভালো হয়ে গিয়েছিল,তাহলে দ্বিতীয় গর্ভধারণেও ডায়াবেটিসের উচ্চ ঝুঁকি থাকে
  • কিছু কিছু অসুখ যেমন থাইরয়েডের সমস্যা, হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ, পলিসিস্টিক ওভারি, কোলেস্টেরল বেশি এগুলো যাদের আছে তাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • আবার কোনো নারীর আগেরবার গর্ভাবস্থায় অনেক বড় সন্তান প্রসব হয়েছে, চার কেজি বা তার বেশি ওজনের সন্তান প্রসব হয়েছে- এরকম যদি হয় তারও উচ্চ ঝুঁকি আছে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার।
  • যে জাতির মধ্যে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি সেই জাতির নারীদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। বাংলাদেশে যেহেতু প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্থূলতা অনেক দ্রুত গতিতে বাড়ছে সেজন্য এই এলাকাটিকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়। সুতরাং এই দেশের যারা বাসিন্দা তারা সবাই উচ্চ ঝুঁকির আওতায়।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে কি নেই কখন পরীক্ষা করতে হবে

গর্ভকালীন ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে স্ক্রিনিং করে বোঝা যায়, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে কি নেই। কিন্তু অনেক সময় গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসের মধ্যে স্ক্রিনিং করেও ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়। যেসব নারীদের উচ্চ ঝুঁকি আছে তাদের প্রথম ফলোআপের সময় স্ক্রিনিং টেস্ট করে নেওয়া উচিত যে ডায়াবেটিস আছে কি নেই।

সেই সময় যদি ডায়াবেটিস ধরা পরে তাহলে দুটি জিনিস হতে পারে। একটা হচ্ছে, তার আগে থেকে ডায়াবেটিস ছিল কিন্তু ধরা পরেনি বা পরীক্ষা করা হয়নি, এখন স্ক্রিনিংয়ের সময় ধরা পড়ল। আবার এমনও হতে পারে, ডায়াবেটিস এখনই শুরু হয়েছে। যেহেতু উচ্চ ঝুঁকিতে ছিলেন।

সুতরাং যাদের উচ্চ ঝুঁকি আছে তাদের প্রেগনেন্সির প্রথম ফলোআপে বা প্রথম তিন মাসের মধ্যে অবশ্যই স্ক্রিনিং করা উচিত। আর যাদের ওপরে উল্লেখ করা ঝুঁকিগুলোর কোনোটাই নেই তারা প্রেগনেন্সির ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে স্ক্রিনিং করতে পারেন বলে জানান ডা. ফারিয়া আফসানা।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের লক্ষণ

প্রেগনেন্সি ডায়াবেটিস স্ক্রিনিংয়ের জন্য কোনো লক্ষণের জন্য অপেক্ষা না করার পরামর্শ দেন ডা. ফারিয়া আফসানা। কারণ ডায়াবেটিসের যে লক্ষণগুলো আছে যেমন ক্ষুধা বেশি লাগা, পানি পিপাসা বেশি পাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, ওজন কমে যাওয়া, দুর্বল লাগা এগুলো তখন হয় যখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেক হাই হযে যায়। প্রেগনেন্সি ডায়াবেটিসের বেলায় এই লক্ষণগুলো হাই হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে রুটিন স্ক্রিনিং করার কথা বলেন ডা. ফারিয়া আফসানা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ ছাড়াই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয় যে ডায়াবেটিস আছে কি নেই তা জানার জন্য।

গর্ভধারণের আগে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করার পরামর্শ এই চিকিৎসকের। যার ডায়াবেটিস ধরা পড়ল না, তাকেও কিন্তু গর্ভধারণের প্রথম ফলোআপে লক্ষণ থাকুক বা না থাকুক ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে। কারণ অনেক বেশি হাই ব্লাড সুগার না থাকলে লক্ষণ দেখা যাবে না, তাই গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসেই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো।

করণীয় কী ও কেমন খাবার খাওয়া উচিত

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার পর কী করতে হবে তার আগে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যায় কি না যাতে না হয় সেই প্রসঙ্গ ডা. ফারিয়া আফসানা বলেন, একজন মা যখন গর্ভধারণের পরিকল্পনা করবেন তখন তাকে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন- তার ওজন যেন স্বাভাবিক থাকে, পরিবারে কারো ডায়াবেটিস থাকলে স্ক্রিনিং করে নিতে হবে তার ডায়াবেটিস আছে কি না, যদি তার ডায়াবেটিস থেকে থাকে তাহলে খুব ভালো সুনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আনতে হবে। ব্লাড প্রেসার কম-বেশি থাকলে স্বাভাবিক করে নিতে হবে, কোলেস্টেরল থাকলে ঠিক করে নিতে হবে। তাহলে কিন্তু মা এবং সন্তান দুজনেরই জটিলতা কমে।

দেখা গেল, এগুলো সব করেই কোন নারী গর্ভধারণ করলেন, কিন্তু পরে তার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়ল। এক্ষেত্রে তার খাদ্য ব্যবস্থা খুব সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে। মা যাতে অপুষ্টিতে না পড়েন অর্থাৎ খাবার খাওয়া বেশি কমিয়ে যে না ফেলেন এটাও করা যাবে না। কারণ বাচ্চার গ্রোথ ডেভেলপমেন্ট ঠিক রাখতে হবে।

এ সময় প্রোটিন জাতীয় খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ভাত, রুটির পরিমাণ একটু কমিয়ে দিতে হবে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যায়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে হালকা হাঁটাহাঁটি করতে বলা হয়, যদি না কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকে। কোনো কোনো প্রেগনেন্সিতে প্রচুর ঝুঁকি থাকে, ব্লিডিং হয় সেরকম অবস্থায় অনেকের গাইনোকোলজিস্টদের নিষেধ থাকে হাঁটবেন না বা স্মপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলা হয়। তাদের হাঁটার দরকার নেই। বাকিরা হালকা পরিশ্রম যেমন ঘরের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করতে পারবেন। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হবে।

খাদ্য ব্যবস্থা এবং শরীরচর্চা করেও যদিও কারো ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে না আসে তখন চিকিৎসা শুরু করার কথা বলেন ডা. ফারিয়া আফসানা। এক্ষেত্রে সবার জন্যই চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অবশ্যই ইনসুলিন দেওয়ার কথা বলেন তিনি। মুখে খাওয়ার ওষুধ গর্ভাবস্থায় দেওয়া হয় না, কারণ এটা প্লাসেন্টা ক্রস করে বাচ্চার কাছেও চলে যেতে পারে। যা বাচ্চার জন্য ভালো নয়।

যা মনে রাখা উচিত বলছেন চিকিৎসক

প্রেগনেন্সি রিপ্রোডাক্টিভ এইজ বা প্রজননক্ষম নারীদের অবশ্যই ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানতে হবে-

  • ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং গর্ভধারণের আগেই করে নিতে হবে যে ডায়াবেটিস আছে কি নেই। যদি ডায়াবেটিস থাকে অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। যার নেই বা কখনোই ছিল না তার গর্ভধারণের প্রথম ফলোআপে স্ক্রিনিং করে নিতে হবে।
  • যদি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকে তাহলে শুধু খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করলেই হবে না, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সঠিকভাবে সবকিছু করতে হবে।
  • সন্তান জন্মদানের পর বাচ্চাকে বুকের দুখ খাওয়ানো কোনভাবেই বন্ধ করা যাবে না, ডেলিভালি নরমাল বা সিজার যেটাই হোক না কেন, প্রথম থেকে যত তাড়াতাড়ি মায়ের দুধ পান নিশ্চিত করা যাবে ততই বাচ্চার জন্য ভালো হবে।

     

  • যার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ছিল এবং সন্তান প্রসবের পর তা স্বাভাবিক চলে এসেছে, তাদের অবশ্যই সন্তান প্রসবের ছয় সপ্তাহ পর একটা স্ক্রিনিং টেস্ট করে করে জেনে নিতে হবে ডায়াবেটিস রয়ে গেল নাকি ভালো হয়ে গেল।
  • যার একবার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়েছে, তার ভবিষ্যতে টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা ৭০ শতাংশ বেশি। তাই তাকে অবশ্যই একটা সুনিয়ন্ত্রিত খাদ্যব্যবস্থার মধ্যে থাকতে হবে। কোনোভাবেই ওজন বাড়তে দেওয়া যাবে না।

Comments

The Daily Star  | English

No sharp rise in crime, data shows stability: govt

The interim government today said that available data does not fully support claims of a sharp rise in crimes across Bangladesh this year

39m ago