রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে গেছে ৯৪০ কোটি টাকার ইভিএম

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম বাংলাদেশে প্রথম ব্যবহার হয় ২০১১ সালে। নতুন এ ব্যবস্থাকে ভোটাধিকার প্রয়োগের এক দুর্দান্ত হাতিয়ার বলে ধরা হচ্ছিল তখন।

পরে, বড় আকারে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ছয়টি আসনের নির্বাচনে ব্যবহার হয় ইভিএম। ওই বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রতিটি ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় দেড় লাখ ইভিএম কেনে, যা ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দামের প্রায় ১১ গুণ বেশি।

ভারত সরকারের ওই ইভিএমগুলো ১৫ বছর ব্যবহার করা যায়। অথচ দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার কারণে আমাদের অন্তত ৪০ হাজার ইভিএম পাঁচ বছরও টেকেনি। এতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কমপক্ষে ৯৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

জনগণের অর্থের এই অপচয়ের পরিমাণ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মোট বাজেটের চেয়ে ২০০ কোটি টাকা বেশি।

এদিকে, আরও ৪০ হাজার ইভিএম নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। কারণ সেগুলো এমন জায়গায় রাখা হয়েছে যেখানে এ ধরনের স্পর্শকাতর যন্ত্রপাতি রাখার উপযোগী নয়। এই যন্ত্রগুলো এখনই সঠিকভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে আরও ৯৪০ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হবে।

বর্তমানে, বিশ্বের প্রায় ১২০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ভুটান, ভারত, ব্রাজিল ও ভেনিজুয়েলাসহ ২৫টি দেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার হয়।

জার্মানি, নেদারল্যান্ডস এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ ই-ভোটিংয়ের নিরাপত্তা, নির্ভুলতা, নির্ভরযোগ্যতা এবং যাচাইযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগের কারণে ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।

কিন্তু ভারত ও ব্রাজিলসহ যে দেশগুলো ইভিএম ব্যবহার করছে, তাদের সংরক্ষণ ও পরিবহনের নির্দেশনাসহ ইভিএম সম্পর্কে স্পষ্ট এবং কঠোর নির্দেশিকা রয়েছে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আবদুল আলীম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইভিএম ব্যবহার করে থাকে এমন অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে নজিরবিহীনভাবে প্রায় এক তৃতীয়াংশ মেশিন ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এতে জনগণের বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে।'

বিপুল ক্ষতি

আসন্ন ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। এ লক্ষ্যে কমিশন ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ইভিএম সংগ্রহ ও পর্যালোচনা শুরু করে।

সেসময় ইসি কর্মকর্তারা বলেছিলেন যে তাদের কাছে যতগুলো ইভিএম আছে, তা দিয়ে ৭০-৮০টি আসনে ভোটগ্রহণ সম্ভব। ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে তাদের আরও মেশিন সংগ্রহ করতে হবে।

তবে, নতুন ২ লাখ ইভিএম কিনতে এবং সেগুলো সংরক্ষণের জন্য ১০টি স্টোরেজ নির্মাণের জন্য ইসির ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব এ বছরের জানুয়ারিতে বাতিল করে সরকার।

ইসি সচিবালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ৪০ হাজার ইভিএম মেরামত অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলে দেশের একমাত্র ইভিএম প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি জানায়। প্রতিষ্ঠানটি এক প্রস্তাবে বলেছিল যে বাকি প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএম ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ঠিক করা যেতে পারে।

তবে, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে 'সরকারের আর্থিক সক্ষমতার ঘাটতির' বিষয় উল্লেখ করে পরিকল্পনা কমিশন প্রস্তাবটি বাতিল করে।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তারা (বিএমটিএফ) ইভিএমগুলোকে ব্যবহারযোগ্য করতে মেরামতের খরচ চেয়েছিল। অর্থাৎ, মেশিনগুলোর ব্যাটারি, তার, টাইমার এবং অন্যান্য কিছু অংশ পরিবর্তন করতে হবে।'

সেপ্টেম্বরের শুরুতে ইসির অভ্যন্তরীণ অধিবেশনে একটি প্রেজেন্টেশনে জানানো হয়, ৯৩ হাজার ইভিএম দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার নির্বাচন কার্যালয় এবং স্কুলে সংরক্ষণ করা আছে।

দ্য ডেইলি স্টারের কাছে থাকা ওই প্রেজেন্টেশনে উপস্থাপিত নথি অনুযায়ী, 'নির্বাচন কার্যালয়গুলো থেকে পাওয়া তথ্য থেকে বোঝা যায়, ওই মেশিনগুলোর ৩০ শতাংশ বর্তমানে অকার্যকর। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ইভিএমের আয়ু কমছে। অসংখ্য মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু মেশিনের ভেতরে কিছু যন্ত্রাংশ পর্যন্ত নেই।'

একই অনুষ্ঠানে আরেক প্রেজেন্টেশনে বলা হয়, দেড় লাখ মেশিনের মধ্যে ৯৩ হাজার ইসির মাঠ পর্যায়ের অফিস ও স্কুলে এবং ৫৪ হাজার ৫০০টি মেশিন বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ) এবং আড়াই হাজার মেশিন আগারগাঁওয়ে ইসি কার্যালয়ের বেজমেন্টে সংরক্ষিত আছে।

ইসির এক শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কয়েক মাস আগে মাঠ পর্যায়ে সংরক্ষিত ৯৩ হাজার ইভিএমের অবস্থা পরীক্ষা করা শেষ হয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগের অবস্থা খারাপ।

ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রকিবুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি ইভিএম সংরক্ষণের জন্য যথাযথ সুবিধা নেই বলে স্বীকার করেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেকগুলোর মনিটর ও টাইমার নষ্ট হয়ে গেছে, তার নেই এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট-ম্যাচিং কম্পোনেন্ট ও ব্যালট ইউনিটের বোতাম নষ্ট হয়ে গেছে।'

'মেশিনগুলো স্যাঁতসেঁতে জায়গায় রাখা হয়েছে,' বলেন তিনি।

দায়ী কে?

ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, যেখানে ইভিএম সংরক্ষণ করা হচ্ছে সেগুলোর দরজা-জানালা সার্বক্ষণিক বন্ধ থাকা উচিত এবং স্যাঁতসেঁতে হওয়া যাবে না। পাশাপাশি ওই জায়গা বন্যা বা জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। সেখানে বাতাস চলাচলের জন্য ফ্যান থাকতে হবে। কিন্তু ভাড়া করা অনেক গুদাম এবং যেসব স্কুল-কলেজে ইভিএম সংরক্ষণ করা হচ্ছে, সেসব জায়গায় এ ধরনের সুবিধা নেই।

এসব কারণেই ৩০ শতাংশের বেশি ইভিএম অল্প সময়ের মধ্যে অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ইসি কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে জানান।

কর্মকর্তারা আরও জানান, গত বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কশবা উপজেলা পরিষদ মিলনায়তন ও ঝিনাইদহের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৩৯টি মনিটর, ১০টি মনিটরের ব্যাটারি ও কন্ট্রোল ইউনিট চুরি হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর সেখানে ইভিএমগুলো রাখা হয়েছিল। তবে চুরি হওয়া কিছু যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম পরে পুলিশ উদ্ধার করে।

মে মাসে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা নির্বাচন অফিসে আগুন লাগে। আগুন নেভাতে পানি ব্যবহার করায় পানি ঢুকে নষ্ট হয় আরও ৫০টি ইভিএম।

রংপুরের এক জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, উপজেলা নির্বাচন অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত ৯০০ থেকে ১০০০ ইভিএমের বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে।

ইসির একাধিক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে জানান, ২০১৮ সালে ইভিএম সংগ্রহের আগে সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থার দিকে যথাযথভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। এটা পরিকল্পনা পর্যায়ের ব্যর্থতা।

সাবেক এক নির্বাচন কমিশনারও নিশ্চিত করেছেন যে সংরক্ষণের জন্য কোনো নিয়ম বা নির্দেশিকা ছাড়াই ইভিএম সংগ্রহ করেছিলেন তারা।

চলতি বছরের মার্চে ইসি ইভিএম সংরক্ষণের জন্য ৬৪ জেলায় বাড়ি ভাড়া নিতে টেন্ডার দেয়। এপ্রিল পর্যন্ত ৩৮ জেলায় এমন বাড়ি খুঁজে পায় ইসি।

চট্টগ্রামের এক জেলা কর্মকর্তা জানান, ঘন ঘন ভাড়া বাড়াতে না পারায় বাড়ি মালিকরা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিতে চান না।

যোগাযোগ করা হলে দুই সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাঠ পর্যায়ের ইসি কার্যালয়ের ভবন কয়েকতলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে ইভিএম সংরক্ষণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমরা। যেখানে এমন ভবন নেই, সেখানে গুদাম ভাড়া নেওয়ার প্রস্তাবও করা হয়েছিল। তবে সে প্রস্তাব কাজে আসেনি।'

জানতে চাইলে ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রকিবুল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রকল্পের মেয়াদ ইতোমধ্যে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এক বছর বাড়ানো হয়েছে। তবে কোনো ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়নি।'

'ইভিএম সংরক্ষণের জন্য একটি গাইডলাইন তৈরির কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। পরীক্ষা করে যে মেশিনগুলো খারাপ পাওয়া গেছে সেগুলো আমরা বিএমটিএফে পাঠাচ্ছি,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

8h ago