বঙ্গবন্ধু টানেল: অর্থনৈতিক করিডোরে নতুন সূচনা

বঙ্গবন্ধু টানেল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

দেশের সড়ক যোগাযোগে নতুন যুগের সূচনা করেছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল।

এ টানেলটি মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডকে অর্থনৈতিক করিডোরে রূপান্তরিত করবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগকারীরা।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের দুই অঞ্চলকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর পর তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার টানেল সড়ক পরিবহন খাতে দ্বিতীয় 'ড্রিম প্রজেক্ট'। চীনের সাংহাইয়ের মতো 'ওয়ান সিটি টু টাউন' মডেল অনুসরণ করে টানেলটি তৈরি করা হয়েছে।

টানেলটি কর্ণফুলীর উত্তর প্রান্তে চট্টগ্রাম বন্দরনগরীকে নদীর দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে যুক্ত করেছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানেলটি ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কসহ এর দুই পাশের দুই বড় অর্থনৈতিক করিডোরকে যুক্ত করে চট্টগ্রামকে বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করতে 'গেম চেঞ্জার' হিসেবে কাজ করবে।

ভবিষ্যতে এ টানেল এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের উন্নতি এবং বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর যোগাযোগ জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

গতকাল শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলটি উদ্বোধন করেন। আজ এটি সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু টানেল
দীর্ঘমেয়াদে বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের জন্য খুব ভালো উদ্যোগ। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টানেলটি অর্থনীতি, যোগাযোগ ও পর্যটনে ব্যাপক অবদান রাখবে। এটি হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি উন্নত বাংলাদেশের রোডম্যাপ।'

টানেলটি দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানাগুলোয় ব্যবহৃত ও উৎপাদিত কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে সময় ও অর্থ সাশ্রয় করবে। এই জোনে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর, কর্ণফুলী উপজেলায় কোরিয়ান ইপিজেড, আনোয়ারা উপজেলায় চায়না ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন ও কক্সবাজার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে।

এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, '২০১৫ সালে টানেল নির্মাণ শুরুর পর থেকে এ অঞ্চলে অনেক নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে। এক দশক আগেও কর্ণফুলীর দুই তীরে তেমন কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল না।'

প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটিতে চীন ও বাংলাদেশ যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে। বেইজিং দুই শতাংশ সুদে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।

কর্ণফুলীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি টানেলটি তৈরি করেছে। মূল টানেলটি তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ।

প্রতিটি টিউবে দুই লেনসহ এর দুইটি টিউবের দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে পাঁচ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার ফ্লাইওভার আছে।

উপজেলা ভূমি অফিসের তথ্যে জানা যায়—বিদ্যুৎ, পেট্রোলিয়াম, পোশাক, জাহাজ নির্মাণ, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ইস্পাত, সিমেন্ট ও তেল শোধনাগারসহ বেশ কয়েকটি খাতে কারখানা স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে অন্তত ৫০ বড় শিল্প গোষ্ঠী ও ৩৫০ ব্যবসায়ী জমি কিনেছেন। অন্তত শতাধিক কারখানা উৎপাদন শুরু করেছে বলেও জানান বিনিয়োগকারীরা।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের পাশাপাশি কর্ণফুলী টানেল এ অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী।

তিনি বলেন, 'সামগ্রিকভাবে, টানেলটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে।'

টানেলের অর্থনৈতিক প্রভাব

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ও বন্দরনগরী থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে মিরসরাইয়ে ৩৩ হাজার ৮০৫ একর জমির ওপর গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। এটি উপকূল বরাবর মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে টানেলের সঙ্গে যুক্ত হবে। মেরিন ড্রাইভটি পরবর্তীতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, এটি সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি এ এলাকার শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করবে।

বঙ্গবন্ধু টানেল
ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

গত ১১ অক্টোবর বেপজার প্রতিবেদনে জানা যায়, মিরসরাই অর্থনীতিক অঞ্চলে ১৫২ প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ হাজার ২৭১ দশমিক ৪৭ একর জমি ইজারা দেওয়ার ‍চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ প্রতিষ্ঠান ৪১০ একর জমিতে কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি এক দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ইতোমধ্যে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫২ হাজার ২৩৮ জনের।

ইজারা চুক্তির মাধ্যমে নিবন্ধিত ১৫২ প্রতিষ্ঠানের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলার ও কর্মসংস্থান হবে সাত লাখ ৭৫ হাজার ২২৮ জনের।

২০৩০ সালের মধ্যে এই জোনে ৫৩৯ প্লট বরাদ্দ শেষে ‍উৎপাদনে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে মোট বিনিয়োগ আরও কয়েকগুণ বাড়বে। সরাসরি কর্মস্থান হবে ১৫ লাখের বেশি মানুষের।

এ ছাড়া কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাশে আড়াই হাজার একর জমিতে কোরিয়ান ইপিজেডের ৩৮ কারখানা এ টানেলের সুবিধা পাবে। এখন কোরিয়ান ইপিজেড প্রতি বছর দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। যদিও এখনো এই ইপিজেডের ৭০ শতাংশ জমি অব্যবহৃত রয়ে গেছে।

কোরিয়ান ইপিজেডের পাশেই চায়না ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। ২০১৬ সালে আনোয়ারায় ৭৫৩ একর জমিতে এটি উদ্বোধন করা হলেও ভূমি উন্নয়নের কাজ এখনো শেষ হয়নি। বেপজার তথ্য অনুসারে, এ জোনটি চালু হলে ৩৭১ কারখানা স্থাপন করা হবে এবং ১৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পাশাপাশি ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ পথটি দেশের বৃহত্তম শিল্প করিডরে পরিণত হবে।'

তবে তিনি টানেলের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য ২৩০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন।

বর্তমানে প্রকল্পটি সমীক্ষা যাচাইয়ের শেষ পর্যায়ে আছে।

তিনি মনে করেন, টানেলটি পুরোপুরি ব্যবহার করতে মেরিন ড্রাইভের বিকল্প নেই। মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যাবে। একই সঙ্গে মিরসরাই থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চল একটি অর্থনৈতিক করিডোরে রূপান্তরিত হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক আরও বলেন, 'টানেলের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৫ সালে। শুধু আয় দিয়ে কিস্তি পরিশোধ সম্ভব হবে না। কারণ টানেলটির সুফল আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পুরোপুরি পাওয়া যাবে না।'

তার মতে, 'মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ও বে টার্মিনালসহ এই শিল্প অঞ্চলগুলো পুরোপুরি চালু হলে টানেলের পূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে। দীর্ঘমেয়াদে টানেলটি দেশের জন্য খুব ভালো উদ্যোগ।'

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

1h ago