জীবনানন্দকে কতোটুকু চেনা হলো 

স্টার গ্রাফিক্স

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশ স্বাতন্ত্র্য এক মন্তব্য করেছিলেন, 'শরৎচন্দ্র বাংলা-উপন্যাসে এমন একটা নতুন আলোক নিয়ে এসেছেন যা আমরা বঙ্কিমচন্দ্রেও পাই না, রবীন্দ্রনাথেও পাই না।' কবিতার মতো প্রবন্ধেও জীবনানন্দ যে প্রাতিস্বিক ও প্রচলপন্থার সাক্ষীগোপাল নয় উপর্যুক্ত অভিমত তার অনুপম সাক্ষ্য। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র সম্পর্কীয় বয়ান কবি জীবননান্দ দাশের জন্যও সমধিক প্রযোজ্য নয় কি? বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ নতুন আলোক নিয়ে এসেছেন যা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলে পাই না, এমনকি জসীম উদদীনেও নয়। বৈশ্বিক পরিসরেও এরকম কবি-প্রতিভা দুর্লক্ষ্য, অভাবিত ও অপূর্ব।

জীবনানন্দের কবি প্রতিভার মূল্যায়ন ঢের হলেও যথার্থ হয়েছে কি-না তা শুধু প্রশ্ন সাপেক্ষ নয়, বিস্তর সংশয়েরও। 'নির্জনতম কবি', 'শুদ্ধতম' কবির আখ্যা জুটেছে তার উষ্ণীষে। ১৯৪৩ সালে 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থের আলোচনায় বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশকে 'নির্জনতম কবি'র আখ্যা দেন। ১৯৪৯ সালে সুরজিৎ দাশগুপ্তকে জীবনানন্দ প্রসঙ্গে অন্নদাশংকর রায় বলেন, উনি আমাদের 'শুদ্ধতম কবি'। ক্ষান্ত দেওয়া হয়েছে এসব বলেই, আবিষ্কৃত হয়নি জীবনানন্দের কবি প্রতিভার শক্তি-উন্মোচিত হয়নি কবিতার ভেতর- বাইরের গভীর-গভীরতর রহস্য। যতটুকু তালাশ ও তত্ত্বানুসন্ধান হয়েছে-তার প্রায় সবটাই চেনা আলোয়-ঔপনিবেশিক চিন্তা কাঠামোয় জারি থাকা পঠন-পাঠন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও এষণায়। যার সঙ্গে কবির রয়েছে স্পষ্ট ফারাক এবং বোধ ও চেতনায় উন্মীলিত আধেয়র সঙ্গে বিপ্রতীপ অবস্থান, দূরত্ব ও গভীরতর এক টানাপড়েন। জীবনানন্দের প্রবন্ধে এসবের সুলুক সন্ধান কিংবা ইংগিত-ইশারা শুধু নয় দ্ব্যর্থ উচ্চারণও রয়েছে।

জীবনানন্দের জনপ্রিয় কবিতা 'বনলতা সেন'। বনলতা সেনকে শনাক্ত ও আবিষ্কারের লক্ষ্যে নানামুখী অনুসন্ধান ও এষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কবির নিকটাত্মীয়দের মধ্যে খুঁজে ফেরা হয়েছে-হচ্ছে আজও জীবনানন্দের প্রতিমা-প্রতিরূপ। আক্ষরিক অর্থেই নাটোরের বাসিন্দা জ্ঞান করে রূপোপজীবীর তকমা এঁটে হাজির করা হয়েছে। এই দুই ডিসকোর্সের বাইরে আরও একজন বনলতা সেন রয়েছেন যিনি নামেই 'বনলতা সেন'। দেশপ্রেমিক এই নারী কারা অন্তরীণ হওয়ার পর পত্রিকায় খবর বেরোয় এবং নামটি দৃষ্টি কাড়ে। জীবনানন্দের কবিতাকে-কবিতার ভাবকে-চরিত্রকে এভাবে বিশ্লেষণ করা কতোটা যৌক্তিক, গবেষক- মেধাজীবীমহল কখনো কি তা ভেবে দেখেছেন? যেখানে এসম্পর্কিত পরিষ্কার ধারণা জীবনানন্দ নিজের লেখা প্রবন্ধে হাজের-নাজেল করে গেছেন স্পষ্টরূপে।

কেন লিখি প্রবন্ধে জীবনানন্দ বলেছেন, 'কবির ভাবপ্রতিভা এমন এক অপরূপ অপ্রশান্তির আস্বাদ পেয়েছে যা জীবনের কোনো ব্যবহারের ভিতরেই ধরা পড়ে না, জীবনের প্রতিবিম্বও নয়, আমাদের এই ইতিহাসস্মৃত জীবন ছাড়িয়ে কবিমানস কোনো অনন্য অভিজ্ঞতার দেশে চলে গিয়েছে। কোনো কবি যদি এরকম মনে করেন তাহলে বুঝতে হবে যে তিনি আজ-কালকের নিত্যব্যবহার্য সমাজপদ্ধতির বাইরে কোনো কিছুর কথা ভাবছেন, কিন্তু তবুও জীবনের বাইরে কোথাও চলে যেতে পারেননি। কারণ জীবন, -এই জীবনের পদ্ধতি যে-কোনো সমাজ ও সমবায় পদ্ধতির চেয়ে বড়ো, এরই ভিতরে মানুষের মানুষের সমবায়-ব্যবস্থা বারবার ভেঙে যাচ্ছে ও নতুনভাবে গড়ে উঠছে।

আমাদের এই গ্রহের জীবনের-সাক্ষ্যেও সবচেয়ে স্মরণীয় দৃষ্টান্ত মানুষ; কোনো বিস্ময়কর প্রমত্ততার মুহূর্তেও নিজেকে অন্যরূপ কল্পনা করা তার পক্ষে কঠিন; তার কল্পনাপ্রতিভার চমৎকার সংহতির মুহূর্তে মানবজীবন সম্পর্কে সবেচেয়ে মূল্যবান কথা আবিষ্কার করবার কিংবা নতুনভাবে প্রচার করবার সুযোগ সে পায়। এইসব সময়ই হচ্ছে কাব্য বা শিল্পসৃষ্টির সময়। (কবিতার কথা।

কবিতা যে চেনা জীবনের ছকের বাইরের কিছু সেটা জীবনানন্দ প্রবন্ধে যেমন পরিস্কার করে যুক্তি-তর্ক দিয়ে পরিষ্কার করেছেন, তেমনি তার কবিতাতেও সেই অচেনা-অজানাকে কিছু ধরেছেন-ধরার চেষ্টায় ব্রতী থেকেছেন। জীবনানন্দ যাকে বলছেন, 'ইতিহাসস্মৃত জীবন ছাড়িয়ে কবিমানসের কোনো অনন্য অভিজ্ঞতার দেশে চলে গিয়েছে'। অথচ জীবনানন্দের 'সিগনেচার' কবিতা 'বনলতা সেন' এর 'বনলতা সেন'কে খুঁজছি কেবলই চেনা চেনা চৌহদ্দিতে-নিকটাত্মীয়র পঞ্জিতে আর উল্লিখিত জনপদের ভূগোলে।

জীবনানন্দের বনলতা সেন সম্পর্কিত ফায়সালায় এটাও মান্যতা দেয়া জরুরি, যা তিনি প্রবন্ধে বলেছেন খোলাসা করেই। 'নিত্য ব্যবহার্য সমাজ পদ্ধতির বাইরে কোনোকিছুর কথা ভাবছেন, কিন্তু তবুও জীবনের বাইরে কোথাও চলে যেতে পারেননি।' এই উপলব্ধির মধ্যেই কবি জীবনানন্দ'র মহত্তম জীবনা ভাবনা উন্মীলিত হয়েছে। একই সঙ্গে জীবনবোধের গভীরতর এক বাস্তবতা ও শাশ্বত সত্যকেও উপস্থাপন করেছেন। চাকরি হারা, বন্ধুহীন, সংসার নিগৃহীত, সহধর্মিণী নিষ্পেষিত, ভালবাসা-বঞ্চিত জীবনানন্দ এভাবেই কবিতা ও জীবনের মধ্যে সীমারেখা টেনেছেন। এবং জীবনের এইসব অপ্রাপ্তি আর নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করেই কবিতাকে নিয়ে গেছেন নিত্য ব্যবহার্য সমাজ পদ্ধতির বাইরে। আর এই বিশ্বাসে স্থিত হয়েছেন এর বাইরে কোথাও চলে যাওয়া যায় না, সুইসাইড ব্যতিরেকে।

একারণে লিটারারী নোটিসে 'সুইসাইড'র কথা বারংবার বললেও যাননি। জীবনের এই দ্বিচারিতা কিংবা দ্বৈরথও জীবনানন্দের কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে, ''আমরা যাইনি ম'রে আজো তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়/ মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে।'' (ঘোড়া)।

জীবননান্দর আরও একটি বহুল পঠিত ও পাঠক সমাদৃত কবিতা 'আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়'। কবি নানাভাবে-নানারূপে বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছেন। শঙ্খচিল শালিক, হাঁস, লক্ষ্মীপেঁচা, শিশু, কিশোর ধবল বক ইত্যাকার প্রাণীরূপে। ভারতীয় উপমহাদেশের বেশকিছু ধর্মে পুনর্জন্মে বিশ্বাস রয়েছে। জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম, শিখধর্ম এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কবিতার বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যাতেও পুনর্জন্মের আলোকে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি আস্থা রাখা হয়েছে। অথচ জীবনানন্দের ধর্মের প্রতি আস্থা ছিল না মোটেই। তাহলে জীবনানন্দের কবিতার এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কোশেশ কতোটা যৌক্তিক।

যেখানে তিনি বলছেন, 'আমি বলতে চাই না যে, কবিতা সমাজ বা জাতি বা মানুষের সমস্যাখচিত অভিব্যক্ত সৌন্দর্য হবে না। তা হতে বাধা নেই। অনেক শ্রেষ্ঠ কাব্যই তা হয়েছে। কিন্তু সে সমস্ত চিন্তা, ধারণা, মতবাদ, মীমাংসা কবির মনে প্রাক্কল্পিত হয়ে কবিতার কঙ্কালকে যদি দেহ দিতে চায় কিংবা সেই দেহকে দিতে চায় যদি আভা, তাহলে কবিতা সৃষ্টি হয় না পদ্য লিখিত হয় মাত্র - ঠিক বলতে গেলে পদ্যের আকারে সিদ্ধান্ত, মতবাদ ও চিন্তার প্রক্রিয়া যায় শুধু। কিন্তু আমি আগেই বলেছি কবির প্রণালী অন্যরকম, কোনো প্রাকনির্দিষ্ট চিন্তা বা মতবাদের জমাট দানা থাকে না কবির মনে কিংবা থাকলেও সেগুলোকে সম্পূর্ণ নিরস্ত করে থাকে কল্পনার আলো ও আবেগ; কাজেই চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ প্রকৃত কবিতার ভিতর সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে শিরা, উপশিরা ও রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে যেন। (কবিতার কথা)

জীবনানন্দ বলছেন, 'কোনো প্রাকনির্দিষ্ট চিন্তা বা মতবাদের জমাট দানা থাকে না কবির মনে।' অথচ পুনর্জন্মের আলোকে 'আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়' কবিতার ব্যাখ্যা হাজির করে, জীবনানন্দ উল্লিখিত 'প্রাকনির্দিষ্ট'  চিন্তাতেই কি আশ্রয় নেয়া হয় অ্যাকাডেমিয়ায় কিংবা তার বাইরেও?

গবেষক- মেধাজীবীরা এই অন্বেষণ এখনও হাজির করেননি একজন ধর্ম অনীহ ব্যক্তি কেনো এরূপে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করবেন। এখানে ধর্ম মুখ্য, নাকি সেই সময় ও জীবনের বাস্তবতা একজন কবিকে অন্যভাবে ভাবাচ্ছে এবং যার মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমের দীপশিখা জ্বলে উঠছে? এও মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলা কবিতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-মূল্যায়ন-উপমা-প্রতীক-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প যেভাবে যে পদ্ধতিতে করা হয়েছে, একই পদ্ধতি যদি জীবনানন্দের কবিতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার সমূহ শঙ্কা রয়েছে।

জীবনানন্দ এসব উপলব্ধি ও আঁচ করেই বোধ করি একথা বলেছেন, 'সকলেই কবি নয়। কেউ-কেউ কবি; কবি- কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে-সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য-বিকিরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়। (কবিতার কথা)

এই গ্রহকে পর্যবেক্ষণের অন্যরকম এক ধীশক্তি ছিল জীবনানন্দের। পৃথিবীকে পাঠ করেছেন, দেশকে দেখেছেন আর জীবন ঘষে আগুনে দগ্ধ হয়েছেন আমৃত্যু, যা তাঁকে করে তুলেছে পরশমনিতুল্য। যে পরশমণি বাংলা কবিতাকে দিয়েছে অনন্য-অপার্থিব এক সৌন্দর্য। প্রচল প্রবাহের কোশেশ ও কসরতে সেই সৌন্দর্য অনুসন্ধান ও আবিষ্কার যৌক্তিক কি, যা জারি রয়েছে জীবনানন্দ সম্পর্কিত এষণায় এবং উনাকে নিয়ে লেখা ফিকশনেও।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত এক লেখায় জীবনানন্দ বলেছেন, 'রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব ও তার প্রতিভার বিচিত্র দানের কথা অনেকদিন থেকে আমাদের দেশে ও সমস্ত পৃথিবীতে আলোচিত হয়ে আসছে। কিন্তু আমার মনে হয় আমরা এখনও রবীন্দ্রনাথের আনুপূর্বিক ভাস্বরতার এত বেশি নিকটে যে, ইতিহাসের যেই স্থির পরিপ্রেক্ষিতের দরকার একজন মহাকবি ও মহামানবকে পরিষ্কারভাবে গ্রহণ করতে হলে, আমাদের আয়ত্তে তা নেই। তৎসত্ত্বেও আমরা অনুভব করি রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষা, সাহিত্য, জীবনদর্শন ও সময়ের ভিতর দিয়ে সময়ান্তরের গরিমার দিকে অগ্রসর হবার পথ যেরকম নিরঙ্কুশভাবে গঠন করে গেছেন পৃথিবীর আদিকালের মহাকবি ও মহাসুধীরাই তা পারতেন, ইদানীং বহু যুগ ধরে পৃথিবীর কোনো দেশই এরকম লোকোত্তর পুরুষকে ধারণ করেনি। (রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা)

জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও উপরোল্লিখিত বয়ান সমধিক প্রযোজ্য-যথার্থও বোধ করি। জীবনানন্দের মতো বিরলপ্রজ ও বিস্ময়কর কবি প্রতিভার কবিতার অন্তর্গত সৌন্দর্য-ব্যক্ত ও অব্যক্ত শব্দ-স্বাদ-গন্ধ-রঙ-রূপ এবং 'ইন বিটুইন লাইনস' আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি, নাকি আমাদের আয়ত্তে নেই?

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

17h ago