হাওর, প্লাবন সমভূমি, সমুদ্র উপকূল ও পাহাড়ে জীবন্ত রয়েছে কুস্তি
সমাজভিত্তিক কুস্তি খেলার ঐতিহ্য জীবন্ত রয়েছে দেশের পূর্বাঞ্চলে। বিশেষ করে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা নদী, মধ্য-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা নদীর প্লাবন সমভূমি ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলে। অনুসন্ধানকালে জানা যায়, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কুস্তি চর্চার অঞ্চলটি হাওরাঞ্চলে সুনামগঞ্জ জেলার পাঁচটি উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত। এখানে প্রচলিত রয়েছে 'ভাইয়াপি কুস্তি খেইড়' নামে দুটি গ্রামের মধ্যে কুস্তি খেলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এক সংস্কৃতি।
অন্যদিকে, মধ্য-পূর্বাঞ্চলে মেঘনা নদীর দুই তীরের প্লাবন সমভূমিতে কুস্তি চর্চার অঞ্চলটি বিস্তৃত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুর, কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর, হোমনা, মেঘনা, তিতাস ও দাউদকান্দি, চাঁদপুর জেলার মতলব, নারায়নগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার ও সোনারগাঁও এবং মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া ইত্যাদি উপজেলাজুড়ে। অঞ্চলটিতে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামবাসীর উদ্যোগে আয়োজন করা হয় রাতব্যাপী কুস্তি প্রতিযোগিতা। মধ্য-পূর্বাঞ্চলে বেশ কিছু প্রাচীন মাজারে বার্ষিক ওরস উপলক্ষে আয়োজন করা হয়ে থাকে কুস্তি প্রতিযোগিতা।
অনুসন্ধানকালে আরো জানা যায়, মধ্য পূর্বাঞ্চলে রাতব্যাপি কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলেও উত্তরা-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় দিনব্যাপি। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে কুস্তি খেলা হয়ে থাকে। অনুসন্ধানকালে আরো জানা যায়, দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে এখন মূলত কক্সবাজার জেলার উখিয়া, চকরিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ ও ককক্সবাজার সদর উপজেলা এবং চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী লবন চাষী এবং পানচাষীদের মধ্যে কুস্তি চর্চার প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের বিখ্যাত কুস্তিগিররা মূলত কক্সবাজার অঞ্চলের। চট্টগ্রামে জব্বারের বলি খেলার সর্বশেষ আসরে রানার আপ এবং এর আগের আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন কক্সবাজারের চকরিয়ার একজন কুস্তিগির।
অনুসন্ধানকালে আরো জানা যায়, মধ্য পূর্বাঞ্চলের মেঘনা নদী তীরবর্তী অঞ্চলের কুস্তি খেলোয়াড়রা বাংলাদেশের জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন বিভিন্ন সময়ে। জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনের কুস্তি খেলোয়াড়দের বড় অংশই উল্লিখিত অঞ্চলের। তবে বাংলাদেশে কুস্তির সংস্কৃতির অন্যতম জনপ্রিয় অঞ্চল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কুস্তি খেলোয়াড়রা জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া থেকে বঞ্ছিত হয়ে আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা এবং সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে উদ্যোগহীনতার কারণে তারা অংশ নিতে পারছে না।
দেশের ঐতিহ্যবাহি কুস্তি প্রতিযোগিতাসমূহের মধ্যে জাতীয়ভাবে সবচেয়ে পরিচিত জব্বারের বলি খেলা। চট্টগ্রাম অঞ্চলে কুস্তিগিরকে বলা হয় বলি এবং কুস্তি খেলাকে বলা হয় বলি খেলা। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চঞ্চলে বৈশাখ মাসে গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা ও বলি খেলা আয়োজনের ঐতিহ্য প্রচলিত রয়েছে। সাধারণত প্রত্যেকটি স্থানের বলি খেলার তারিখ নির্ধারিত থাকে। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম শহরে ১২ বৈশাখ খেলাটি প্রচলন করেছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর। এরপর থেকে প্রতি বছর ১২ বৈশাখ লালগীঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে জব্বারের বলি খেলা। জব্বারের বলি খেলা ছাড়াও প্রতি বছর বৈশাখ মাসে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে বেশ কিছু স্থানে বলি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন মক্কার বা মক্কারো বলি খেলা। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মাদার্শা ইউনিয়নে মক্কার বাড়িতে প্রতি বছর ৭ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় বলি খেলা। আবরের মক্কা নগরী থেকে সাতকানিয়ার মাদার্শায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন ধর্মপ্রচারক ও ব্যবসায়ী ইয়াসিন মক্কী। ইয়াসিন মক্কীর বংশধররা পরবর্তীকালে জমিদার হয়েছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াসিন মক্কীর নাতি জমিদার কাদের বকস প্রচলন করেছিলেন বলি খেলা, যা এরপর নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়েছে আসছে।
চট্টগ্রামের পটিয়ায় শতাধিক বছর ধরে প্রতি বছর ১৪ বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বৈশাখী মেলা ও বলি খেলা। সংশ্লিষ্টরা জানান, পূর্বে নাম ছিল পরীর দীঘি পাড়ের বৈশাখী মেলা ও বলি খেলা। বিগত শতকের ষাটের দশকে নাম পরিবর্তন করে পটিয়া পৌরসভা আমজু মিয়া স্মৃতি বৈশাখী মেলা ও বলি খেলা করা হয়।
কক্সবাজারে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয় ডিসি বলি খেলা ও বৈশাখী মেলা। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান এবং কক্সবাজার জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ক্রীড়া সংগঠক ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার উদ্যোগে ১৯৫৮ সালে কক্সবাজার শহরে চালু করা হয়েছিল বৈশাখী মেলা ও বলি খেলা। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তখন কক্সবাজার মহকুমা প্রশাসনের নির্বাহী প্রধান তথা এসডিও ছিলেন বলে মেলাটি পরিচিতি লাভ করে এসডিও মেলা নামে। আশির দশকে কক্সবাজারকে মহকুমা থেকে জেলায় রূপান্তর করা হয়। তখন মেলটির নাম পরিবর্তন করে ডিসি বলি খেলা নামকরণ করা হয়।
স্থানীয় কুস্তিগির, কুস্তি সংগঠক ও জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ডিসি বলি খেলা বর্তমানে কক্সবাজারের কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রধান উৎসব হলেও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গ্রামে গ্রামে এখনো বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে বলি খেলা তথা কুস্তি খেলা হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিককালে বলি খেলার আয়োজনের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কম।
কক্সবাজার জেলা ফুটবল এসোসিশেনের সভাপতি ফজলুল করিম সাঈদী আরো জানান, বলি খেলা কক্সবাজারের ঐতিহ্য, চকরিয়ার ঐতিহ্য। চকরিয়ায় প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে বলি খেলা অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু গত ২ বছর যাবত বন্ধ আছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনাগ্রহের কারণে বলি খেলার আয়োজন বন্ধ আছে বলে তিনি অভিযোগ করেন এবং চকরিয়ায় বলি খেলা আবার চালু করতে তিনি দাবি জানান।
গ্রামে গ্রামে ঐতিহ্যবাহি বলি খেলার আয়োজনের সংখ্যা ক্রমশ কমলেও আবার নতুন করে বলি খেলার প্রচলনের খবরও পাওয়া যায় অনুসন্ধানকালে। চট্টগ্রাম শহরে সিআরবি শিরিষতলায় গত ১৩ বছর ধরে পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বৈশাখী মেলা ও শাহাবুদ্দিনের বলি খেলা। শাহাবুদ্দিনের বলি খেলার প্রবর্তক মো: শাহাবুদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, বলি খেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, চট্টগ্রামের সংস্কৃতি। কিন্তু বলি খেলার ঐতিহ্য বিলুপ্ত হওয়ার আংশকা দেখা দিয়েছে। বলি খেলাকে পুনরুজ্জীবিত করতে করতে ২০১০ সাল থেকে ১ বৈশাখে চট্টগ্রাম শহরের সিআরবি-শিরিষতলায় আয়োজন করা হচ্ছে বলি খেলা।
চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলার আয়োজক কমিটির অন্যতম সংগঠক ও সংস্কৃতি কর্মী শাহরিয়ার খালেদ চট্টগ্রাম শহরের কুস্তি তথা বলি খেলার ঐতিহ্য প্রসঙ্গে বলেন, নগরীর বাকুলিয়ায় বলিরহাট বলে একটি অঞ্চল রয়েছে। সেখানে রয়েছে বলিবাড়ি একটি প্রাচীন বাড়ি, যার বাসিন্দারা বংশানুক্রমিকভাবে বলির চর্চা করতেন। বাকুলিয়ার বলিরহাট থেকে বলিরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নেচে-গেয়ে লালদীঘি ময়দানে এসে জব্বারের বলি খেলায় অংশ নিতো। কিন্তু চট্ট্রগ্রাম শহরে এখন বলিরা নেই। বিগত খ্রিষ্টীয় শতকের সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম শহরে কুস্তি খেলার চর্চা বিলোপ ঘটে। তখন থেকে মূলত শহরের বাইরের খেলোয়াড়রা জব্বারের বলি অংশ নেন।
শাহরিয়ার খালেদ আরো জানান, সাম্প্রতিককালে জব্বারের বলি খেলায় চট্টগ্রাম জেলার প্রতিযোগীরা তেমন পাওয়া যায় না। জব্বারের বলি খেলায় অংশ নেন মূলত কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও কুমিল্লা জেলার মেঘনা নদী তীরবর্তী কুস্তিগিররা। কক্সবাজার জেলায় কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকোরিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ঐতিহ্যবাহি কুস্তির চর্চা এখনো অব্যাহত আছে। কক্সবাজারের উল্লিখিত পাঁচটি উপজেলার কুস্তিগিররা সাম্প্রতিককালে ভালো ফলাফল করছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র এবং জব্বারের বলি খেলার প্রধান রেফারি আলহাজ্জ এম এ মালেক জানান, আগে চট্টগ্রাম শহরে বলিরহাটে বিখ্যাত বলিরা ছিলেন। কিন্তু শহরে এখন বড় কোনো বলি নেই। ছোট ছোট বলি আছে। জব্বারের বলি খেলায় ছোট বলিদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই, শুধু বড় বলিরাই অংশ নিতে পারে। ফলেশহরের বলিরা জব্বারের বলি খেলায় অংশ নেয়ার সুযোগ পায় না। তিনি আরো জানান, চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলায় সারা দেশের খেলোয়াড়দের অংশগ্রণের সুযোগ থাকে। তবে কক্সবাজার ও কুমিল্লা অঞ্চল থেকে বলিরা বেশি আসেন। সিলেট বিভাগের প্রতিযোগীরাও আসে। সম্প্রতিক কাঞ্চলেরাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির বলিরাও ভালো করছে।
অনুসন্ধানকালে জানা যায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে বলি খেলায় ভালো ফলাফল করছে কক্সবাজারের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল এবং মেঘনা নদী তীরবর্তী প্লাবন সমভূমি অঞ্চলের কুস্তিগিররা। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত জব্বারের বলি খেলা ১১৪ তম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন কুমিল্লার হোমনার শাহজালাল বলি এবং রানার আপ হয়েছিলেন কক্সবাজারের চকরিয়ার তারিকুল ইসলাম জীবন বলি । জব্বারের বলি খেলার এর আগের আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন কক্সবাজারের চকরিয়ার তারিকুল ইসলাম জীবন বলি এবং কুমিল্লার শাহজালাল বলি তখন হয়েছিলেন রানারআপ।
কক্সবাজারের বলি খেলা সম্পর্কে বিশিষ্ট ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ও চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী জানান, কক্সবাজারে শিক্ষিত ও সম্পন্ন পরিবারের সন্তানরা কুস্তি চর্চা করে না, কক্সবাজার জেলার বলিরা গরীব ঘরের সন্তান। তারা মূলত লবন চাষের সঙ্গে যুক্ত। লবন চাষের কারণে তাদের শরীর শক্ত হয়। লবন চাষের জমির পাশেই তারা সাধারণত কুস্তির চর্চা করে থাকেন।
জব্বারের বলি খেলার সর্বশেষ আসরে চ্যাম্পিয়ন তারিকুল ইসলাম জীবন বলি জানান, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ ইত্যাদি উপজেলার লবন চাষীরা এবং মহেশখালীতে পানচাষীরা মূলত বলি খেলার চর্চা করে থাকেন। আগের তুলনায় এখন বলি খেলার আসরের সংখ্যা কমে গেছে। তারপরও এখনো বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসের অধিকাংশ দিনে কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় কোন না কোন স্থানে বলির খেলার আসর হয়ে থাকে। তিনি আরো জানান, কক্সবাজারে বংশ পরম্পরায় বলি খেলা হয়ে আসছে।
মেঘনা নদী তীরবর্তী প্লাবন সমভূমি অঞ্চলেও বংশ পরম্পরায় কুস্তির চর্চা হয়ে আসছে। জব্বারের বলি খেলার সর্বশেষ আসরে আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার ভাসানিয়া ইউনিয়নের উমরাবাদ গ্রামের শাহজালাল বলি। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ কুস্তি খেলতেন। মেঘনা নদী তীরবর্তী নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, মুরাদনগর, হোমনা, মেঘনা, তিতাস ও দাউদকান্দি, আড়াইহাজার, সোনারগাঁও, গজারিয়া ইত্যাদি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘকাল ধরে বংশানুক্রমিক কুস্তির চর্চা করে আসছে।
চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলায় ২০১২ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন বাঞ্ছারামপুর উপজেলার বাহেরচর গ্রামের মো অলি। একই কথা বলের মো : অলিও। দ্যা ডেইলি স্টারকে জানান, তার গ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই কুস্তি খেলার প্রচলন রয়েছে। তার পিতাও ছিলেন একজন কুস্তির খেলোয়াড়। তিনি শৈশব থেকে কুস্তি খেলে আসছেন। শৈশব থেকে বন্ধুরা মিলে মেঘনা নদীর তীরে প্রতিদিন তারা কুস্তি খেলতেন।
মো: অলি আরো জানান, কুস্তির চর্চা আগের চেয়ে এখন কম। আগে অঞ্চলটিতে প্রতি গ্রামে ১০/১২ খেলোয়াড় দেখা যেতো। কিন্তু এখন খেলোয়াড়ের সংখ্যা কম। তার গ্রামে এখন তিনিসহ ৩জন কুস্তি খেলেন। তবে মো: অলি আরো জানান, কুস্তির প্রতিযোগিতাসমূহ আয়োজনে গ্রামের মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা আগের মতো রয়েছে।
অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, বা রামপুর, মুরাদনগগর, তিতাস, মেঘনা ইত্যাদি উপজেলার কোথাও কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন হলেসাধারণত যে কোনো অঞ্চলের প্রতিযোগীর অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, নারায়নগঞ্জের মেঘনা তীরবর্তী বিভিন্ন উপজেলার কুস্তিগিররাই মূলত অংশ নেন। কখনো কখনো জাতীয়ভাবে বিখ্যাত কুস্তিগিররাও অংশ নেন।
কুস্তির জাজ, রেফারি ও সাবেক খেলোয়াড় মোঃ সালাম জানান, বাঞ্ছারামপুর, মুরাদনগগর, তিতাস অঞ্চলে কুস্তির আয়োজন ভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। বিভিন্ন গ্রামে সেখানে গ্রামবাসিরা আয়োজন করা হয়ে থাকে কুস্তি। আমিও সেখানে কুস্তি খেলায় কয়েকবার অংশ নিয়েছি। কুস্তি আয়োজন উপলক্ষ্যে উৎসবের আমেজে মেতে উঠে সারা গ্রাম। রাত ব্যাপি কুস্তি প্রতিযোগিতা হয়। পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়। আশে-পাশের গ্রামগুলো থেকেও দলে দলে মানুষ আসে। হাজার হাজার নারী-পুরুষ রাত জেগে কুস্তি দেখেন। আয়োজকরা প্রচুর টাকা খরচ করে কুস্তির আয়োজন করে থাকেন। কখনো কখনো আয়োজকরা ঢাকা থেকে ভালো ভালো খেলোয়াড় নিয়ে যান।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে আয়োজন করা হয়ে থাকে কুস্তি প্রতিযোগিতা। উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী জাদিদ উর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ইউনিয়নে এ বছর উজানচর, বুধাইরকান্দি, রাধানগর, কালিকাপুর গ্রামে কুস্তি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কুস্তি প্রতিযোগিতাগুলো শুরু হয় সাধারণত সন্ধ্যায় এবং শেষ হয় সকাল ১০ টায়। কুস্তি প্রতিযোগিতা আয়োজনে মূল উদ্যোক্তা গ্রামবাসীরাই। আমরা যারা নেতৃত্বে আছি, আয়োজনে সহযোগিতা করে থাকি।
কাজী জাদিদ উর রহমান আরো জানান, সামাজিক কাজে অনুদান চাইলে কোনো কোনো সময় মানুষ বিব্রত হয়। কিন্তু এ অঞ্চলে কুস্তি আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খুব সহজেই সংগ্রহ হয়ে যায়। ধনী থেকে দরিদ্র পর্যন্ত কেউ কার্পন্য করে না। স্বতস্ফূর্তভাবে গ্রামের সকলে অংশ নেয়। তিনি আরো বলেন, কুস্তি প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে হলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আর জেলা প্রশাসকের অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে কিছু আনুষ্ঠানিকতা। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেয়ার কাজটি গ্রামের মানুষের পক্ষে বেশ বেশ কষ্টকর। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুমতি দিলে গ্রামের মানুষের পক্ষে কুস্তির আয়োজন সহজ হবে।
অনুসন্ধানকালে আরো জানা গেছে, বাঞ্ছারামপুর, তিতাস, মুরাদনগর অঞ্চঞ্চলেবেশ কিছু মাজারে বার্ষিক ওরস উপলক্ষে আয়োজন করা হয়ে থাকে কুস্তি প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার গাজীপুরে জিন্দাপীর নামে খ্যাত হজরত শাহবাজ-এর ওরস উপলক্ষ্যে আয়োজিত কুস্তি প্রতিযোগিতা ও মেলা। জনশ্রুতি অনুযায়ী, হজরত শাহজালালের সফরসঙ্গী ছিলেন হজরত শাহবাজ। তিতাস উপজেলার গাজীপুর গ্রামে তিনি আস্তানা স্থাপন করেছিলেন। একদিন তিনি হঠাৎ চিরতরে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। তাই জিন্দাপির বলা হয়। প্রতি বছর ৫ ফাল্গন থেকে ওরস উপলক্ষে তিনদিনব্যাপি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও সাতদিন ব্যাপী বিশাল গ্রামীন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। গাজীপুর মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য ও তিতাস উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ ফকির এ প্রসঙ্গে ডেইলি স্টারকে জানান, জিন্দাপিরের মেলায় দুই শতাধিক বছর ধরে কুস্তি প্রতিযোগিতা হয়ে আসছে। প্রতি বছর মেলা উপলক্ষ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের আগমন ঘটে। আর মেলার প্রধান আকর্ষন হচ্ছে কুস্তি। গাজীপুর খান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে প্রথম দিন ছোটদের কুস্তি, দ্বিতীয় দিন বড়দের কুস্তি এবং তৃতীয়দিন ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়।
ওরস উপলক্ষে কুস্তি প্রতিযোগিতা আয়োজনের ঐতিহ্য রয়েছে কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে। ঊনিশ শতকের পাগল ধারার বিখ্যাত সাধক বেলতলীর সোলেমান শাহ লেংটা-এর জন্মস্থান কাঠালিয়া নদী তীরবর্তী উল্লিখিত আলীপুর গ্রাম। আর সোলেমান শাহ লেংটার মাজার রয়েছে চাঁদপুর জেলায় মেঘনা নদী তীরবর্তী জনপদ বেলতলীতে। সম্প্রতি মেঘনা উপজেলার আলীপুর গ্রাম সরজমিনকালে জনপ্রতিনিধি, মাজার কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কথা বলে জানা, হযরত সোলেমান শাহ লেংটা-এর ভাতিজা ও তাঁর অন্যতম আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার গনি শাহ লেংটা-এর ওরস উপলক্ষ্যে প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে অনুষ্ঠিত হয় কুস্তি প্রতিযোগিতা। ১৩ ফাল্গুন থেকে ২০ ফাল্গুন পর্যন্ত ওরসে বাউল গানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে একদিন হয় কুস্তি প্রতিযোগিতা।
গোবিন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: মাইনউদ্দিন তপন জানান, সোলেমান শাহ লেংটা জন্মস্থান হিসাবে আলীপুর অঞ্চলটি তাঁর ভক্তদের কাছে তীর্থস্থানস্বরূপ। প্রতি বছর চৈত্র মাসে সোলেমান লেংটার ওরসে নৌকা দিয়ে যাওয়ার সময় ভক্তরা আলীপুরে নৌকা থামিয়ে জন্মস্থান পরিদর্শন করে যায়।
কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার হোলারচক গ্রামে আব্দুর রব ভান্ডারির পিতা পীর হজরত আলী-এর বার্ষিক ওরস উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হয়ে থাকে কুস্তি প্রতিযোগিতা।
কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার জাহাপুর ইউনিয়নের সাতমোড়া গ্রামে কুলুমদ্দীন শাহ-এর ওরস উপলক্ষে শতাধিক বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে কুস্তি প্রতিযোগিতা। তবে সরজমিনকালে মাজারের খাদেমসহ স্থানীয়রা জানান, করোনার বিস্তার ঘটার পর থেকে কুলুমুদ্দিন শাহ মাজারে ওরস উপলক্ষ্যে কুস্তি প্রতিযোগিতা বন্ধ আছে।
সুফি গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আহসানুল হাদী এ প্রসঙ্গে বলেন, সুফি ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রবাহিত হয়েছে কুস্তি চর্চা। সুফিদের তৎপরতার কেন্দ্র খানকায় ধর্ম ও দর্শন চর্চার পাশাপাশি আবশ্যিক চর্চিত বিয়ষ ছিল কুস্তি। বিশ্বখ্যাত সুফি জুনায়েদ বাগদাদীসহ সুফি ঐতিহ্যে অনেক সাধক কুস্তিগির হিসাবেও ছিলেন বিখ্যাত। মেঘনা তীরবর্তী অঞ্চঞ্চলেবিভিন্ন মাজারে বার্ষিক ওরস উপলক্ষে কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন সুফি ঐতিহ্যের নিদর্শন বহন করছে।
ধর্মীয় ঐতিহ্যের অঙ্গ হিসাবে কুস্তি খেলার প্রচলন রয়েছে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যেও। প্রতি বছর নাগ পঞ্চমী তিথিতে চা বাগানে উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় কুস্তি প্রতিযোগিতা। শ্রাবন মাসের নাগ পঞ্চমী তিথি শৈব ও শাক্তরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করেন। উত্তর প্রদেশ ও বিহার অঞ্চলে নাগপঞ্চমী তিথি উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের অন্যতম অঙ্গ কুস্তি প্রতিযোগিতা। সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ অঞ্চলের চা বাগানসমূহে নাগপঞ্চমীর দিনে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কুস্তি প্রতিযোগিতা আয়োজনের রেওয়াজ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি মিন্টু দেশোয়ারা এ প্রসঙ্গে জানান, আগে প্রায় সব বাগানে নাগ পঞ্চমী তিথিতে কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। কিন্তু এখন সংখ্যা কমে গেছে। গত বছর মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার হিংগাজিয়া চা বাগান এবং হবিগঞ্জ জেলার চাঁনপুর চা বাগানে নাগ পঞ্চমী তিথিতে কুস্তি প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছিল।
সুনামগঞ্জ জেলায় সুনামগঞ্জ সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ ও তাহিরপুর উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত এ অঞ্চলে রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কুস্তি খেলার ঐতিহ্য। এ অঞ্চলে হয়ে থাকে 'ভাইয়াপি কুস্তি খেইড়'। ভাইয়াপি মানে প্রীতি, আর খেইড় মানে খেলা। 'ভাইয়াপি কুস্তি খেইড়' বা 'প্রীতি কুস্তি খেলা' অনুষ্ঠিত হয় দুটি গ্রামের মধ্যে। স্থানীয়ভাবে কুস্তিগিরদের বলা হয় 'মাল'। দুটি গ্রামের সেরা 'মাল'দের দিনব্যাপী কুস্তি দেখতে আসেন আশে-পাশের বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার মানুষ।
ঐতিহ্য অনুযায়ী, যে গ্রামে খেলা অনুষ্ঠিত হবে, খেলার আগের দিন সন্ধ্যায় অন্য প্রতিযোগী গ্রামের প্রায় এক হাজার মানুষ আয়োজক গ্রামে আতিথ্য গ্রহণ করবেন। ব্যাপক সমাদরে গ্রহণ করা হয় অতিথিদের। এক রাত এক দিন আপ্যায়ন ও আবাসনের ব্যবস্থা করেন স্বাগতিক গ্রামবাসী। খেলা উপলক্ষে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই আপ্যায়নের জন্য গরুর গোস্তসহ বাহারি খাবারের আয়োজন করা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে গ্রামের মেয়েরা নাইওরিতে আসেন। অতিথিদের জন্য তৈরি হয় বিভিন্ন ধরণের পিঠা-পায়েস, গরু জবাই করা হয় ৫টি থেকে ১০টি। খেলায় জয় পরাজয় যাই হোক- দুই গ্রামের মাানুষের মধ্যে সৌহার্যে কোনো অবনতি ঘটে না। সাধারণত এক গ্রামে খেলার হওয়ার কিছুদিন পর অন্য গ্রামের মানুষও আয়োজন করে থাকে 'ভাইয়াপি কুস্তি খেইড়'।
সুনামগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষক ও সাংবাদিক শামস শামীম এ প্রসঙ্গে বলেন, সুনামগঞ্জের ৫টি উপজেলায় প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী 'ভাইয়াপি কুস্তি খেইড়' গ্রামের চিরায়ত উৎসব ও সম্প্রীতিকে ধরে রেখেছে। কোথাও 'ভাইয়াপি কুস্তি খেইড়' অনুষ্ঠিত হলে নানা বয়সের, নানা শ্রেণী-পেশার নারী-পুরুষের ঢল নামে মাঠে। মাঠে নারীরাও উৎসাহী দর্শক। নারীদের জন্য থাকে নির্ধারিত স্থান। রোদের তাপ, বৃষ্টির তোড় কোনোকিছুতেই খেলা বন্ধ হয় না। 'ভাইয়াপি কুস্তি খেইড়' একদিকে যেমন উৎসব, অন্যদিকে, এতে দুটি গ্রামের মানুষের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি হয়।
শামস শামীম আরো জানান, সুনামগঞ্জের ৫টি উপজেলায় এবছর অন্তত ১০০টি 'ভাইয়াপি কুস্তি খেইড়' অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুনামগঞ্জ উপজেলার মোহনপুর, বানীপুর, মুড়ারবন্দ, জলিলপুর, সরদারপুর, হবতপুর, শ্রীপুর, শাফেলা, জগাইরগাঁও, পুরানগাঁওয়ে লড়েছেন মালরা। শান্তিগঞ্জের চানপুর, জামালগঞ্জের নোয়াগাঁও, বিছনা, ঘাগটিয়া, দুর্লভপুর, রামনগর, শুকদেবপুর, রাধানগর, নয়াহালটসহ বিভিন্ন গ্রামে কয়েকবার খেলা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের ঐতিহ্য গবেষক শামস শামীম জানান, সাম্প্রতিককালে আমন্ত্রিত ও স্বাগতিক গ্রামের মধ্যে 'ভাইয়াপি কুস্তি খেইড়' অনুষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি শুরু হয়েছে টুর্নামেন্ট আকারে কুস্তি প্রতিযোগিতা। টুর্নামেন্ট কুস্তিতে গ্রামের বাছাই করা ৬জন খেলোয়াড় অংশ নেন। তিনি আরো জানান, গত নব্বই দশকের মধ্যভাগ থেকে প্রায় একদশক ঐতিহ্যবাহী খেলাটি বন্ধ ছিল। পরে স্থানীয় লোকজন আবারও খেলাকে জাগিয়ে তোলেন।
অনুসন্ধানকালে জানা যায়, শুধু সুনামগঞ্জে 'ভাইয়াপি কুস্তি খেইড়' নয়, নব্বই দশকের মধ্যভাগ থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মেঘনা নদীর মধ্যাঞ্চল সংলগ্ন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর অঞ্চঞ্চলেগ্রামবাসীর উদ্যোগে কুস্তি প্রতিযোগিতার উৎসব আয়োজন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানবৃন্দ ও কুস্তি সংগঠকরা জানিয়েছেন, মেঘনা নদীর মধ্যাঞ্চল সংলগ্ন তীরভূমি বাঞ্ছারামপুর, নবীনগর, মুরাদনগর, হোমনা, মেঘনা, তিতাস, দাউদকান্দি, মতলব, আড়াইহাজার, গজারিয়া ইত্যাদি উপজেলায় প্রায় এক যুগ বন্ধ থাকার পর আবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে কুস্তি খেলার উৎসব।
সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর নারায়নগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ জেলার কুস্তির জনপ্রিয় অঞ্চলগুলোর ভূমিরূপ প্রায় এক। প্লাবন সমভূমি হওয়ায় বছরের ছয় মাস চাষাবাদ হয়। আর ছয় মাস প্রায় সকল কৃষিভূমি পানিতে ডুবে থাকে। প্লাবন সমভূমি অঞ্চলে শুকনা মওসুমে পায়ে হেটে এবং বর্ষা মৌসুমে নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। কুস্তি খেলা হয় মূলত বর্ষাকালে। আর কুস্তি খেলা দেখতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ আসতো নৌকা দিয়ে। তবে অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, সাম্প্রতিককালে এই প্রবণতার পরিবর্তন হয়েছে। এখন সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লায় সারা বছরই কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী জাদিদ-উর-রহমান-এর মতে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের কারণে এখন হয়তো সারা বছর কুস্তির আয়োজন করা হচ্ছে। দ্যা ডেইলি স্টারকে বলেন, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ইত্যাদি জেলার প্লাবন সমভূমিতে শুকনা মৌসুমে পায়ে হাটা ছাড়া বিকল্প কোনো মাধ্যম ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে প্লাবন সমভূমিতে 'সাবমার্জ' রোড করা হয়েছে, যা দিয়ে শুকনা মৌসুমে ৬ মাস হালকা যানবাহন চলাচল করতে পারে। আর ৬ মাস পানিতে ডুবে থাকে।
সুনামগঞ্জের হাওরে ও সিলেট- মৌলভীবাজার অঞ্চলের চা বাগানে কুস্তি জনপ্রিয় খেলা হলেও সিলেট বিভাগের কুস্তিগিররা জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া থেকে বঞ্চিত আছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেসলিং ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক মেবাহউদ্দিন আজাদ জানান, কুস্তি ফেডারেশন আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও বিভিন্ন কর্মসূচিতে কোনো খেলোয়াড় অংশ নিতে চাইলে বিভাগীয় বা জেলা ক্রীড়া সংস্থা অথবা ফেডারেশনভুক্ত ক্লাবের প্রতিনিধি হয়ে আসতে হয়। সিলেট বিভাগের কোনো ক্লাব এখনো ফেডারেশনভুক্ত হয়নি। সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা বা সিলেট বিভাগের কোনো জেলা ক্রীড়া সংস্থা বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে কুস্তির কোনো কর্মসূচিতে কখনো দল পাঠান নি।
জাতীয় পর্যায়ের কুস্তি প্রতিযোগিতায় সিলেট বিভাগ থেকে কুস্তি দল না পাঠানো সম্পর্কে সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, খেলাধূলার অনেকগুলো ডিসিপ্লিন আছে। আমাদের যে সামর্থ্য আছে, তাতে সবগুলো ডিসিপ্লিনকে প্রমোট করা সম্ভব হয় না। কিছু ডিসিপ্লিনকে নির্বাচন করতে হয়। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলো যে নির্বাচিত খেলাগুলো প্রমোট করে. তাতে কুস্তি নেই। জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় এ সিলেট বিভাগ থেকে এ কারণে কুস্তি দল পাঠানো সম্ভব হয় না।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব ড. মোহাম্মদ শাহানুর আলম সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কুস্তির একজন সংগঠক ও খেলোয়াড়। ড. মোহাম্মদ শাহানুর আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, সুনামগঞ্জের ৫টি উপজেলার ঐতিহ্যবাহি কুস্তি খেলার ধারক ও বাহক হচ্ছে সাধারণ মানুষ। শিক্ষিত মানুষেরা এই খেলাকে চাষভূষার সংস্কৃতি মনে করে। জীবন্ত এই ঐহিত্যকে এড়িয়ে চলে। কুস্তি চর্চার সঙ্গে স্কুল জীবনে যুক্ত কোনো ছেলেযদি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে, দেখা যায় সে আর কুস্তির সঙ্গে যুক্ত থাকতে চায় না, থাকে না। কুস্তিকে স্থানীয় চাষাভূষার খেলা মনে করার কারণে জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে না।
জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনাবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সহ-সভাপতি মাশুক মিয়া জানান, কুস্তি শহরের মানুষরা খেলেন না। মূলত গ্রামের মানুষ খেলে খাকেন। আমরা কুস্তির প্রচলন করার চেষ্ঠা করছি। কিন্তু জেলা ক্রীড়া সংস্থার আর্থিক বিষয়ে খুবই দুর্বল।
কুমিল্লা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হোসেন রোমেল এ প্রসঙ্গে জানান, কুমিল্লা জেলার কুস্তির চর্চা হয়ে থাকে মেঘনা, তিতাস ও দাউদকান্দি অঞ্চলে। জেলার প্রায় সকল কুস্তি খেলোয়াড়ও ওই তিনটি উপজেলার। অঞ্চলটিতে দীর্ঘদিন ধরে কুস্তি খেলার ঐতিহ্য রয়েছে। দাউদকান্দি উপজেলার শাহজালাল চট্টগ্রামের বলি খেলায় গত বছর রানার্সআপ এবং এর আগে দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তবে কুমিল্লা জেলায় ছেলেদের তুলনায় মেয়ে খেলোয়াড়ের সংখ্যা কম।
Comments