ঐতিহ্যময় কুস্তি, পর্ব-৪

দেশের পশ্চিমাঞ্চলে শহরভিত্তিক কুস্তি খেলার উত্থান

নড়াইল, রংপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুরসহ দেশের পশ্চিমাঞ্চল তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় সম্প্রতি শহরভিত্তিক কুস্তি খেলার উত্থান ঘটেছে। বিগত শতকের নব্বই দশক পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী কুস্তির প্রচলন ছিল মূলত গ্রামে, খেলতেন কৃষক পরিবারের সন্তানরা। প্রায় ২০ বছর ধরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নড়াইলে ও উত্তরবঙ্গের রংপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম ইত্যাদি জেলা সদরে সরকারী ক্রীড়া অবকাঠামোর মধ্যে শহরের শিশু-কিশোররা চর্চা করছে কুস্তি। ঐতিহ্যবাহী কুস্তি খেলায় অংশ নেন মূলত পুরুষ খেলোয়াড়রা, মেয়েরা সেখানে উপস্থিত থাকেন দর্শক হিসেবে। অন্যদিকে, সম্প্রতি দেশের পশ্চিমাঞ্চলে উত্থান হওয়া শহরভিত্তিক কুস্তিতে ছেলে ও মেয়েরা উভয়েই নিয়মিত চর্চাকারী।

অনুসন্ধানকালে জানা যায়, ইতিমধ্যে জাতীয় জুনিয়র কুস্তিতে অন্যতম শীর্ষ শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের শহরভিত্তিক কুস্তিগিররা। ২০০০ সালের পূর্ববর্তী সময়ে জাতীয় জুনিয়র কুস্তিতে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ হতো যশোর, খুলনা, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ ইত্যাদি জেলা থেকে আগত দলগুলো, যেখানে ঐতিহ্যবাহি কুস্তি খেলার প্রচলন রয়েছে। খেলোয়াড়রা সেখানে চর্চা করতেন গ্রামে। ২০০০ সালের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়।  দেশের পশ্চিমাঞ্চলে উত্থান হওয়া শহরভিত্তিক কুস্তি দলগুলো জাতীয় জুনিয়র কুস্তি প্রতিযোগিতায় নিজেদের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে উপস্থাপন করছে। গত এক যুগ বিভিন্ন সময়ে জাতীয় জুনিয়র কুস্তিতে বালক ও বালিকা বিভাগে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ হয়েছে শহরভিত্তিক কুস্তি চর্চাকারী দল নড়াইল, রংপুর ও রাজশাহী।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নড়াইলে শহরভিত্তিক কুস্তি খেলার উত্থান হয়েছে ২০০০ সালে মূলত সুলতান মেলাকে কেন্দ্র করে। সমসাময়িককালে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহরেও শুরু হয় কুস্তির চর্চা। সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, শহরভিত্তিক কুস্তি চর্চার উত্থান ও বিকাশের ঘটনায় রয়েছে কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠকের নিরলস প্রচেষ্টা।

অনুসন্ধানকালে জানা যায়, দেশের পূর্বাঞ্চলের তুলনায় পশ্চিমাঞ্চলে ঐতিহ্যবাহি কুস্তির প্রচলন কম।  উত্তরবঙ্গের কোথায় ঐতিহ্যবাহি কুস্তির প্রচলন থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে।  বর্তমানে ঐতিহ্যবাহি কুস্তির প্রচলন রয়েছে খুলনার শহরতলী রায়েরমহল, খালিসপুর ইত্যাদি অঞ্চলে এবং যশোর জেলায় অভয়নগর ও বাঘারপাড়া উপজেলায়।

অনুসন্ধানকালে আরো জানা যায়, যশোর-খুলনা অঞ্চলে প্রচলিত ঐতিহ্যবাহি কুস্তি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় সাধারণত রাতব্যাপি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি কুস্তি প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে বাঘারপাড়া উপজেলায়। অন্যদিকে খুলনার শহরতলী অঞ্চলে কুস্তি প্রতিযোগিতা গত ২/৩ বছর যাবৎ প্রায় বন্ধ আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।  তবে খুলনা জাতীয় জুনিয়র কুস্তি প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্টত্ব বজায় রেখেছে এখনো। এ বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় জুনিয়র কুস্তির ২৮তম আসরে বালক ও বালিকা দুটি বিভাগেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে খুলনা।

খুলনার কুস্তিগিররা মূলত রায়েরমহল অঞ্চলের। খুলনা সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের রায়েরমহল অ লটি খুলনা শহরে পরিচিত 'কুস্তির গ্রাম' নামে।  রায়েরমহল অঞ্চলের কুস্তিগিররা জাতীয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়মিত পদক পেয়ে থাকেন। বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত রয়েছেন । খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এস এম মোয়াজ্জেম রশিদী দোজা এ প্রসঙ্গে বলেন, খুলনায় কুস্তির চর্চা হয়ে থাকে মূলত রায়েরমহল অঞ্চলে। বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার আগে অনুশীলন হয়ে থাকে রায়েরমহল গ্রামে।

কুস্তি ফেডারেশনের কোচ ও সংগঠক খান আবদুল মান্নানের জন্ম খুলনার রায়েরমহল অঞ্চলে। তিনি জাতীয় কুস্তি প্রতিযোতিায় দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। খান আব্দুল মান্নান জানান, বংশ পরম্পরায় রায়েরমহলের মানুষ কুস্তির চর্চা করে আসছেন।

খান আবদুল মান্নান আরো জানান, বিভিন্ন গ্রামে প্রতি বছর কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজনের রেওয়াজ ছিল আমাদের অঞ্চলে। রায়েরমহল এবং পার্শ্ববর্তী কাশীপুর, খালিশপুর, বিয়ানা, বোয়ালখালী ইত্যাদি গ্রামে কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো নিয়মিত। কিন্তু ইদানিং কুস্তি খেলার আয়োজনের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। গত বছর আমাদের অঞ্চলে শুধু খালিশপুরে কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। কেন সংখ্যা কমছে প্রশ্ন করা হলে খান আবদুল মান্নান বলেন, কুস্তি প্রতিযোগিতায় অনেক মানুষের সমাগম ঘটে। কোন অপ্রীতিকর ঘটনা হলে এর দায়-দায়িত্ব নিতে হয়।

ঐতিহ্যগতভাবে কুস্তি চর্চাকারী দল হিসাবে যশোরও দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় অঙ্গনে শক্তিমত্তা দেখিয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় জুনিয়র কুস্তির ২৭ তম আসরে বালিকা বিভাগে ১ম রানার্স আপ এবং বালক বিভাগে দ্বিতীয় রানার্স আপ হয়েছিল যশোর। যশোর জেলার ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব কবির দ্যা ডেইলি স্টারকে জানান, যশোর জেলার মধ্যে কুস্তি মূলত অভয়নগর ও বাঘারপাড়া উপজেলায় চর্চা হয়ে থাকে। জাতীয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জেলার প্রতিনিধিত্বকারী প্রায় সকল কুস্তি খেলোয়াড় মূলত উল্লিখিত দুটি উপজেলার। তিনি আরো জানান, যশোরে সমৃদ্ধ ঘরের ছেলেরা সাধারণত কুস্তি খেলে না। কুস্তি খেলে সাধারণত গবীর মানুষেরা। তাদের পক্ষে নিয়মিত অনুশীলন করা কঠিন। তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে যশোরের কুস্তির অবস্থা আরো ভালো হতো বলে তিনি উল্লেখ করেন।

কুস্তির আন্তর্জাতিক রেফারি ও জাজ এবং যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার জুডো, কুস্তি উসু সম্পাদক সৈয়দ আলী আনোয়ার জানান, বাঘারপাড়া ও অভয়নগর উপজেলায় যশোর জেলার ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে দুজনকে কুস্তির প্রশিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোচরা হলেন বাঘারপাড়া উপজেলায় আসগর আলী মোল্লা এবং অভয়নগর উপজেলায় বাবুল মোড়ল।

বাঘারপাড়া উপজেলা কুস্তির কোচের দায়িত্বপালনকারী মো আসগর আলী মোল্লার বাড়ি উপজেলার মহিরণ গ্রামে।  আসগর আলী মোল্লা জানান, তারা বংশানুক্রমিকভাবে কুস্তি খেলে আসছেন। ৮ ভাইয়ের ৮ জন জনই কুস্তি খেলেছেন বা খেলছেন। এর মধ্যে ৪ জন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলেছেন। মো আসগর আলী মোল্লা আরো জানান, খুলনা-যশোর অঞ্চলে বর্তমানে ঐতিহ্যবাহি কুস্তি সবচেয়ে জনপ্রিয় বাঘারপাড়া উপজেলায়। বাংলাদেশে কুস্তির সবচেয়ে বড় তারকা টাইগার জলিল নামে খ্যাত প্রয়াত আবদুল জলিলের পৈত্রিক নিবাস বাঘারপাড়া উপজেলায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদক বিজয়ী অনেক কুস্তিগিরের জন্ম ও বেড়ে উঠেছেন বাঘারপাড়ায়। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গ্রামবাসিরা বংশানুক্রমিকভাবে কুস্তির চর্চা করেন। গ্রামবাসির উদ্যোগে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় রাতব্যাপি কুস্তি প্রতিযোগিতা। এ ধরণের আয়োজন সাধারণত দুটি গ্রামের মধ্যে হয়ে থাকে। সম্প্রতি বাঘারপাড়া উপজেলার বাররা, দোহাকোলা, ইন্দ্র, মহিরণ ইত্যাদি স্থানে কুস্তি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক ও বাঘারপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো: আবদুর রউফ জানান, কুস্তিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যশোর ও খুলনার পাশাপাশি সাম্প্রতিককালে নড়াইল  শক্তিশালী দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। জাতীয় পর্যায়ের কুস্তি প্রতিযোগিতায় গত এক যুগ বিভিন্ন সময়ে  চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ হয়েছে নড়াইলের ছেলে ও মেয়েরা। তবে যশোর ও খুলনার সঙ্গে নড়াইলের প্রার্থক্য আছে। যশোর ও খুলনার কুস্তিগিররা চর্চা হয়ে থাকে গ্রামে। আর নড়াইলের কুস্তির চর্চা হয় শহরে।

নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার কুস্তি সম্পাদক ও কুস্তির কোচ রবিউল ইসলাম রবি জানান, প্রবি বছরই তারা নতুন নতুন কুস্তি খেলোয়াড় সংগ্রহ করেন, বাছাই করেন এবং সারা বছরই প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। প্রতি বৃহস্পতিবার, শুক্র ও শনিবার নড়াইল শহরে অনুষ্ঠিত হয় কুস্তির প্রশিক্ষণ। রবিউল ইসলাম রবি আরো জানান, নড়াইলে কুস্তির বিকাশে মূল পৃষ্ঠপোষক ক্রীড়া সংগঠক আশিকুর রহমান মিকু। তাঁর হাত ধরেই মূলত নড়াইলে সাম্প্রতিককালে কুস্তি খেলা বিকাশ লাভ করেছে।

বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক আশিকুর রহমান মিকু গত ৩৬ বছর ধরে নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। আশিকুর রহমান মিকু জানান, নড়াইলে সুলতান মেলা ও গ্রামীন ক্রীড়া উৎসবের প্রভাবে মূলত সাম্প্রতিককালে শহরে কুস্তি চর্চার প্রসার হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে নড়াইলে প্রতি বছর সুলতান মেলা ও গ্রামীন ক্রীড়া উৎসব হয়ে আসছে। গ্রামীন বিভিন্ন খেলাকে পুনরুজ্জীবন করতে নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত ্এ্ই ক্রীড়া উৎসবে কুস্তি, হাডুডু, লাঠিখেলা, ষাড়ের লড়াই ইত্যাদি গ্রামীন খেলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, সারা দেশের প্রতিযোগীরা অংশ নেয়। সুলতান মেলার পর থেকে জেলা ক্রীড়া সংস্থা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কুস্তির প্রশিক্ষণ শুরু করে।

শহরভিত্তিক কুস্তি চর্চাকারী দল উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও রংপুর জাতীয় অঙ্গনে শক্ত প্রতিদ্বন্দী রূপে আবির্ভূত হয়েছে। রাজশাহী ছেলে ও মেয়েরা জাতীয় জুনিয়র কুস্তিতে গত এক যুগ ধরে দক্ষতা প্রদর্শন করে আসছে।। গত এক যুগে জাতীয় জুনিয়র কুস্তিতে বালিকা বিভাগে অধিকাংশ সময় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থা। জুনিয়র কুস্তিতে বালক বিভাগেও রয়েছে তাদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। বিভিন্ন সময়ে তারাও চ্যম্পিয়ন ও রানার্স আপ হয়েছে। রাজশাহীতে কুস্তির নিয়মিত চর্চা হয়ে থাকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার জিমন্যাশিয়ামে। সংশ্লিষ্টরা জানান, কুস্তিতে রাজশাহীর ছেলেমেয়েদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে রাজশাহী কুস্তি একাডেমি। প্রায় ২০ বছর ধরে তারা কুস্তির প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। রাজশাহী কুস্তি একাডেমির কোচ মো: আহসান কবীর বাবু জানান, ১৯৮৩ সালে তারা ক্রীড়া শিক্ষার একটি একাডেমি গড়ে তোলেছিল। প্রথমে প্রায় ৬ বছর জুডো, এরপর আরো ৬ বছর কুংফো প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এরপর তারা আবারো পরিবর্তন করেন। শুরু করেন কুস্তির প্রশিক্ষণ। গত ২০ বছর ধরে শুধু কুস্তির প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

শহরভিত্তিক কুস্তি চর্চকারী রংপুর জাতীয় জুনিয়র কুস্তিতে নিজেদের শক্তিশালী দলরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে। এ বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় জুনিয়র কুস্তির ২৮তম আসরে বালক বিভাগে ১ম রানার্স আপ এবং বালিকা বিভাগে দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়েছে রংপুর। ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ২৭তম আসরে বালক বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল রংপুর। বালিকা বিভাগেও তারা বিভিন্ন সময়ে সাফল্য পেয়েছে। রংপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক অ্যাভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, রংপুর শহরে কুস্তির প্রচলন হয়েছে প্রায় ২০ বছর আগে। রংপুর স্টেডিয়ামের জিমন্যাশিয়ামে নিয়মিত কুস্তির চর্চা হয়ে থাকে। কুস্তিতে জাতীয় পর্যায়ে রংপুরের সাফল্যের কারণ মূলত কুস্তি কোচ রফিকুল ইসলামের কুস্তির প্রতি ব্যক্তিগত ভালবাসা ও মমতা।

রংপুর জেলার কুস্তির কোচ রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযাগ করা হলে তিনি জানান, ২০০৬ সাল থেকে তিনি কোচের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি আরো জানান, দায়িত্ব গ্রহণের পর বাচ্চাদের- শিশুদের ডাকতে শুরু করি। কুস্তির প্রশিক্ষণ দিতে থাকি। এদের মধ্যে থেকেই জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী কুস্তিগির তৈরি হয়েছে। রফিকুল ইসলাম প্রথম থেকেই তাঁর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়েছেন। কুস্তির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের। তাঁর বোন, ভাস্তি, ভাগ্নিরাও বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন কুস্তিতে পেয়েছেন জাতীয় পদক। জাতীয় জুনিয়র কুস্তির ২৬ তম আসরে বালিকা

বিভাগে ১ম রানার্সআপ হযেছিল দিনাজপুর। দিনাজপুরের কুস্তি সংগঠক ও কোচ রাহাতুল আবেদিন লিটন জানান, প্রায় ২০ বছর ধরে দিনাজপুরে কুস্তির চর্চা হচ্ছে। দিনাজপুরে কুস্তির চর্চা হয়ে থাকে শহরের বালুবাড়িতে মডার্ন বডিবিল্ডিং ক্লাব ব্যায়ামাগারে। ছেলে ও মেয়ে উভয়েই এখানে নিয়মিত কুস্তির চর্চা করে।

জাতীয় পর্যায়ে কুস্তি প্রতিযোগিতায় সম্প্রতিক সময়ে সাফল্য পেয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের কুস্তিগিররা। ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক দম্পতি মো: বাবলু জামান ও মাহমুদা বেগম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় কুস্তি বিস্তারে মূল অনুঘটক রূপে কাজ করছেন। কোচ ও ক্রীড়া সংগঠক দম্পতি  মো: বাবলু জামান ও মাহমুদা বেগম জানান, আগে তারা জুডো, ক্যারাতে ও বক্সিংয়ের প্রশিক্ষণ দিতেন। এরপর তারা যুক্ত করেন কুস্তির প্রশিক্ষণ। প্রায় ১৫ বছর ধরে তারা তারা ছেলেমেয়েদের নিয়মিত কুস্তির প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে কুস্তির চর্চা হয়ে থাকে পুরাতন স্টেডিয়ামে। চাপাইনবাবগঞ্জে কোচ মাহমুদা বেগম এ প্রসঙ্গে জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে কুস্তি চর্চার জন্য তারা নারিকেলের ছোবা দিয়ে তৈরি হয়েছে বিশেষ ধরণের ১২টি ম্যাট। নারিকেলের ছোবার দিয়ে তৈরি ম্যাটের উপর একপাশে ছেলেরা এবং এক পাশে মেয়েরা কুস্তির চর্চা করে থাকে।

শহরভিত্তিক কুস্তি খেলার প্রচলন হয়েছে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ইত্যাদি জেলায়ও। পঞ্চগড় পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও কুস্তির কোচ আবদুল্লাহ আল মামুন বাবু জানান, পঞ্চগড় স্টেডিয়ামে নিয়মিত কুস্তির চর্চার হয়ে থাকে। শহরের ক্রীড়া অবকাঠামোর মধ্যে কুস্তির চর্চা হয়ে থাকে কুড়িগ্রামেও।

জাতীয় জুনিয়র কুস্তিতে জেলা ক্রীড়া সংস্থার দলগুলো ভালো করলেও সিনিয়র ও জাতীয় কুস্তিতে তারা সাফল্য পায় না। সিনিয়র ও জাতীয় পর্যায়ে কুস্তি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ, দ্বিতীয় রানার্সআপ সীমাবদ্ধ থাকে মূলত ৪টি সার্ভিস দলের মধ্যে। দলসমূহ হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পুলিশ ও বাংলাদেশ আনসার।

জাতীয় ও সিনিয়র কুস্তি প্রতিযোগিতায় জেলা ক্রীড়া সংস্থার দলগুলোর সাফল্য না পাওয়ার কারণ সম্পর্কে রাজশাহী কুস্তি একাডেমির কোচ মো: আহসান কবীর বাবু বলেন, আমরা খেলোয়াড় তৈরি। কিন্তু ধরে রাখতে পারি না। ভালো খেলোয়াড়দের বিভিন্ন বাহিনী চাকুরি দিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের একাডেমিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় ৪০ জন খেলোয়াড় বর্তমানে বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত আছে। ভাল খেলোয়াড় ধরে রাখতে না পারায় আমরা বা অন্য জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোর দলগুলো, যারা জুনিয়র পর্যায়ে ভাল করে, কিন্তু জাতীয় বা সিনিয়র পর্যায়ে কুস্তি ভাল করতে পারে না।

অনুসন্ধানকালে জানা যায়, জাতীয় জুনিয়র কুস্তি প্রতিযোগিতার পর পরই বিভিন্ন সার্ভিস দল বিজয়ীদের চাকুরি দিয়ে তাদের দলে অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। তবে অনুসন্ধানকালে আরো জানা গেছে, কুস্তি খেলায় জাতীয় পর্যায়ে অগ্রগণ্য ৪টি সার্ভিস দল শুধু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভালো খেলোয়াড়দের চাকুরি দিয়ে সীমাবদ্ধ রাখে না তাদের কুস্তিগির সংগ্রহের প্রক্রিয়া। তাদের নিজস্ব ক্রীড়া ব্যবস্থাপনায়ও তৈরি হয় নতুন নতুন কুস্তি খেলোয়াড়। বাহিনীতে চাকুরি করার সূত্রে প্রথমে কুস্তি চর্চা শুরু করেছিলেন, পরবর্তীকালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদক পেয়েছেন, এমন কুস্তিগিরের সংখ্যাও অনেক।

দেশের খ্যাতিমান নারী কুস্তিগির এবং জাতীয় কুস্তি প্রতিযোগিতায় ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে চ্যাম্পিয়ন শিরিন সুলতানার কুস্তির চর্চা শুরু হয়েছিল আনসারে যোগ দেয়ার পর। তিনি ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আনসারে ব্যাটালিয়ন সৈনিক রূপে যোগ দেন। ২০০৯ সালে আনসারের ট্যালেন্ট হান্ট কর্মসূচিতে তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেন এবং আনসার মহিলা ফুটবল দলের কোচ রেহেনা পারভীন তাঁকে কুস্তি খেলার পরামর্শ দেন। এরপরই শুরু হয় শিরিন সুলতানার কুস্তি চর্চা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কুস্তি চর্চায় অগ্রগণ্য ৪টি সার্ভিস দল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পুলিশ ও বাংলাদেশ আনসারের রয়েছে কুস্তি চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা। ফলে উল্লিখিত ৪টি সার্ভিস দলের খেলোয়াড়রা সারা বছর কুস্তি চর্চার সুযোগ পেয়ে থাকে, যা দেশের অন্য কোথাও নেই।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কুস্তি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহি খেলা হলেও সরকারী ক্রীড়া অবকাঠামোতে খেলাটি চরম উপেক্ষার শিকার। বাংলাদেশের ক্রীড়া কার্যক্রমের মান উন্নয়ন, প্রসার ও সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। কুস্তিসহ ১৮টি ডিসিপ্লিনের কোচ থাকার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ১ যুগ ধরে ক্রীড়া পরিষদে কুস্তির কোনো কোচ নেই। এ ব্যাপারে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী পরিচালক (ক্রীড়া) সামিম আরা খানম-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ২০১০ সালে কুস্তির কোচ ফারুকউদ্দিন আহমদ বয়সজনিত কারণে অবসরে গিয়েছেন। এরপর নতুন কোচ নিয়োগ দেয়া হয়নি। কেন দেয়া হয়নি এবং কবে কুস্তির কোচ নিয়োগ দেয়া হবে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। তবে কবে নিয়োগ দেয়া হবে-এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় তিনি বলতে পারেননি।

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) জুডো, উশু, বাস্কেটবল, তায়কোয়ানডো, টেনিস, কারাতে, টেবিল টেনিসসহ ১৭টি ডিসিপ্লিন শিক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে কুস্তির প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা কখনোই ছিল না। বাংলাদেশ জাতীয় স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা ক্রীড়া সমিতি জাতীয়ভাবে প্রতিবছর গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ২টি ও শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ৭টি ইভেন্টে থাকে। স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত ৯টি  ইভেন্টের মধ্যেও কুস্তি নেই।

প্রবীন ক্রীড়া সাংবাদিক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, পাকিস্তান আমলেও ফুটবলের পরে এদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল কুস্তি। কিন্তু এখন নিয়মিত কুস্তির চর্চাই হয় না। আগে কুস্তির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন রাজা-জমিদাররা। কিন্তু এখন কুস্তির পৃষ্ঠপোষকতা কেউই করে না। পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা সত্ত্বেও ঐতিহ্যবাহী এই খেলাটি বহু যুগ ধরে আমাদের দেশে চলে আসছে বলে এখনো চর্চা হয়ে থাকে। তিনি আরো বলেন, পৃষ্ঠপোষকরা সব ক্রিকেটে সহায়তা করছে। ফলে শিশু-কিশোররা ছুটছে ক্রিকেটের দিকে। কুস্তির প্রসার ঘটাতে চাইলে ভাল কোচ আনতে হবে। নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে। তাহলে নতুন প্রজন্ম কুস্তির প্রতি আগ্রহী হবে।

বাংলাদেশ অ্যামেচার রেসলিং ফেডারেশনের সদস্য এবং রাজশাহী কুস্তি একাডেমির কোচ মো: আহসান কবীর বাবু জানান, দেশে জাতীয়, সিনিয়র, জুনিয়র ও সার্ভিস দলের কুস্তি প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মিনি ক্যাডেট পর্যায়ে কুস্তি প্রতিযোগিতা বন্ধ আছে। অথচ বাংলাদেশে কুস্তির প্রসার ঘটাতে চাইলে নিয়মিত মিনি ক্যাডেট কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন খুবই জরুরি। কারণ মা-বাবারা সাধারণত ৫/৬ বয়সে সন্তানকে কুস্তি চর্চা করতে একাডেমিতে দিয়ে থাকেন। একজন শিশু ৫/৬ বয়সে কুস্তি চর্চা করতে শুরু করে। কিন্তু কুস্তির চর্চা শুরু করার পরবর্তী ৬/৭ বছর সে খেলার সুযোগ পায় না। কুস্তির চর্চা শুরু করার ৬/৭ বছর পর সে জুনিয়র পর্যায়ে খেলার সুযোগ পায়। শিশু বয়সে প্রতিযোগিতার সুযোগ পেলে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়, স্বপ্ন দেখতে পারে। ভালো খেলোয়াড়দের শৈশব থেকে পরিচর্যা করে তখন বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে। কুস্তির কোচ ও সংগঠক মো: আহসান কবীর বাবু আরো বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের পদকপ্রাপ্তির দিক থেকে ক্রিকেট, আর্চারি, শ্যুটিংয়ের পরই কুস্তির অবস্থান। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সামনের দিনগুলোতে কুস্তিতে পদকপ্রাপ্তির সংখ্যা আরো বাড়বে।

বাংলাদেশে কুস্তির বিকাশ সম্পর্কে কুস্তির সংগঠক  এবং কুস্তির রেফারি ও জাজ একেএম আবদুল মবিন বলেন, বাংলাদেশে কুস্তিতে স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশে কুস্তির বিকাশের জন্য কুস্তি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রায় প্রতি রাজ্যে কুস্তি একাডেমি আছে। কোনো কোনো রাজ্যে একাধিক কুস্তি একাডেমি রয়েছে। সরকারের উদ্যোগে নির্মিত ও পরিচালিত এসব কুস্তি একাডেমিতে সারা বছর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তারা সাফল্য পাচ্ছে। বাংলাদেশে কুস্তি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো ভাল করবে বলে আশা করা যায়।

প্রবীণ ক্রীড়া সংগঠক ও বাংলাদেশ এ্যামেচার রেসলিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক তবিউর রহমান পালোয়ান এ প্রসঙ্গে বলেন, নিয়মিত কুস্তি চর্চার জন্য ঢাকায় একটিও স্থায়ী জায়গা নেই। কুস্তির প্রসার ও মানোন্নয়ন করতে চাইলে প্রথমেই দরকার ঢাকায় একটি স্থায়ী জায়গা, যেখানে সারা বছর কুস্তিগিররা কুস্তির চর্চা করতে পারবে। তখন দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভাল খেলোয়াড় তৈরি করাও সম্ভব হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Fulfilling sky-high expectations Yunus govt’s key challenge

Says ICG report on completion of interim govt’s 100 days in office

3h ago