ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্ট দেশের ব্যবসায়ীরাও

ছবি: রাজীব রায়হান

বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা, চেম্বার প্রধান ও বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, শুধু জাপানি ও চীনা কোম্পানি নয়, দেশীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য দেশের কোম্পানিগুলোও দেশের সার্বিক ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।

তারা এজন্য দায়ী করেন নীতিগত অসঙ্গতি, জটিল কাস্টমস সিস্টেম, চালান ছাড়তে দেরি, সরকারি কর্মকর্তাদের সেবা দেওয়ার মনোভাবের অভাবকে। একইসঙ্গে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দ্রুত সেবা নিতে বিধি বহির্ভূত অর্থ লেনদেন দুর্বল ব্যবসায়িক পরিবেশের জন্য দায়ী বলেও তারা মনে করেন।

তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, দীর্ঘদিন ধরে এই পরিস্থিতি চলে আসছে। সম্প্রতি জাপানি ও চীনা ব্যবসায়ীদের যে তথ্য জানিয়েছেন এটি তারই প্রতিফলন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, গত ৩০ আগস্ট জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অরাগানাইজেশনের (জেট্রো) এক জরিপে বলা হয়েছে- ৭১ শতাংশ জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্ট।

এরপর গত শনিবার চীনা ব্যবসায়ীরা ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট পেতে সমস্যা থেকে শুরু করে ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তারা এসব সমস্যার সমাধানসহ উন্নত সেবার দাবি জানিয়েছেন।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. সামীর সাত্তার বলেন, জাপান ও চীনা ব্যবসায়ীরা যেসব সমস্যার মুখে পড়ছেন, দেশি-বিদেশি কোম্পানিও একই সমস্যায় পড়ছে।

তিনি বলেন, কাস্টমসে চালান ছাড়ের ধীর গতির কারণে আমদানিকারকরা অনেক সময় বেশি ডিমারেজ দিতে বাধ্য হন। শুধু তাই নয় অপ্রত্যাশিত এই ধীর গতির কারণে আমদানি করা কাঁচামাল ও পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে, উদ্যোক্তাদের ব্যয় যেমন বাড়ে, একইভাবে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের টাইম রিলিজ স্টাডি-২০২২ অনুযায়ী, পণ্যবাহী কার্গো সমুদ্রবন্দরে পৌঁছানোর পর ছাড়ের জন্য ব্যবসায়ীদের ১১ দিন ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।

বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের চেয়ারপারসন নিহাদ কবির বলেন, এটা কিছুটা হলেও সত্যি যে- জাপানি কোম্পানিসহ কিছু দেশি-বিদেশি কোম্পানি অদক্ষতা ও লাল টেপিজমের কারণে সরকারি প্রণোদনা পায় না।

তিনি বলেন, 'কাস্টমস পদ্ধতিতে অটোমেশন পুরোপুরি কার্যকর হয়নি, এনবিআরকে যত দ্রুত সম্ভব এই প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রক কাঠামোতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা চায়।'

'ব্যবসার ওপর চাপ কমাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে, যেন বাংলাদেশ অধিক পরিমাণে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারে এবং দেশীয় ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আরও অবদান রাখতে পারে। আরও দক্ষ কাস্টমস প্রক্রিয়া বাংলাদেশকে উন্নত দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের দিকে নিয়ে যাবে,' বলেন তিনি।

জেট্রো জরিপের প্রসঙ্গ টেনে ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, 'ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও ৬৬ শতাংশ জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জাপানি বিনিয়োগকারীরা দ্রুত কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স ও ঋণপত্র নিষ্পত্তির ওপর জোর দিয়েছেন।'

প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, 'আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও প্রতিকূল নীতিমালা রপ্তানির পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। অদক্ষ বন্দর হ্যান্ডলিং ও জটিল কাস্টমস পদ্ধতির কারণে কাঁচামালের ক্লিয়ারেন্স ধীর গতিতে হয়, এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।'

তবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে আরও এফডিআই অর্জন ও ব্যবসাকে সহজতর করতে সরকারের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'দেশি-বিদেশিসহ সব বিনিয়োগকারীদের জন্য কর ও সুবিধার বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রয়োজন।'

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'জাপানি ব্যবসায়ীরা খুবই সচেতন এবং কাজের ক্ষেত্রে নৈতিকতা মেনে চলেন। তাই তারা এমন একটি পরিবেশ চান, যেখানে কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়া নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারবেন।'

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্ট হওয়ার অবশ্যই কিছু কারণ আছে।

তার মতে, বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে- বন্দরে ধীর গতির ক্লিয়ারেন্স, কর জটিলতা, উচ্চ কর বোঝা ও আমদানি শুল্ক, দুর্বল লজিস্টিক সিস্টেম এবং আধুনিক বাণিজ্য অর্থায়নের সুযোগ কম।

জেট্রোর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ইউজি আন্দো বলেন, বাংলাদেশে অনুকূল বিনিয়োগ নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও নীতিগত অসঙ্গতি, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশ, জটিল কাস্টমস পদ্ধতি, চালানে বিলম্ব, দক্ষ পেশাদারদের অভাব ও জটিল বৈদেশিক মুদ্রা বিধিমালার মতো কিছু কারণে জাপানি ব্যবসায়ীরা অসন্তুষ্ট।

তিনি বলেন, 'তবে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে পরিস্থিতির উন্নতি করার সম্ভাবনা আছে।'

সুমিতোমো করপোরেশন এশিয়া অ্যান্ড ওশেনিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের কান্ট্রি জেনারেল ম্যানেজার শিনিচি নাগাতা বলেন, যেসব দেশে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা ও কর প্রণোদনা দেওয়া হয়, ব্যবসায়ীরা সেসব দেশকেই বেছে নেন।

ঢাকায় জাপানিজ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তেতসুরো কানো বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কাঁচামালের আমদানি শুল্ক অনেক বেশি, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, 'তবে এখানে শ্রম ব্যয় সস্তা, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়ক।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

4h ago