সাক্ষাৎকার

অনন্য প্রকাশনা ‘মুজিবপিডিয়া’

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম 'মুজিবপিডিয়া'। কারণ ১৯২০-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তার জীবন-কর্মের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, স্থান ও চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে এক বইয়ে। এক কথায় সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার ইতিহাসের বহু তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে এতে। 

বইটির প্রকাশক হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার সার্কেল বাংলাদেশ লিমিটেড, পরিবেশক আগামী প্রকাশনী। এতে ৫৯১টি নিবন্ধ ও প্রায় ৭৫০টি ঐতিহাসিক আলোকচিত্র রয়েছে। বইটির ভুক্তি লিখেছেন ৯৭ জন লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিক। কাজের অভিজ্ঞতা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন কবি ও সম্পাদক ফরিদ কবির

'মুজিবপিডিয়া' প্রকাশের পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে চাই। কখন বা কেন এরকম একটি বইয়ের কথা ভাবলেন?

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে একটা কাজ করার পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। গত ৫০ বছরে এই বিষয়ে অন্তত ৫-৬ হাজার বই বেরিয়েছে। তাতে আছে নানা ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য। আছে বানানো ও মিথ্যা তথ্যও। ফলে কোন তথ্যটা সঠিক তা পাঠকের জন্য নির্ণয় খুব মুশকিল।

বছর তিনেক আগে এক সাংবাদিক বন্ধু পরামর্শ দেন, বঙ্গবন্ধুর ওপর একটা এনসাইক্লোপিডিয়া প্রকাশের উদ্যোগ নিতে পারি কি না? তারপর এই বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা পাওয়ার পর কাজের জন্য খোঁজখবর শুরু করি। বিশেষ করে গবেষণা, তথ্য যাচাইয়ের পদ্ধতি, গাইডলাইন, ভুক্তি লেখার পদ্ধতি- ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি। এটুকু বুঝতে পারি এ ধরনের কাজ খুব সহজ নয়।

যাই হোক, কাজটা করতে দরকার এমন একজন মানুষ, যিনি এ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। এর জন্য কবি কামাল চৌধুরীকে মনে হয়েছে সঠিক ব্যক্তি। তাকে প্রধান সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানালে তিনি রাজি হন। তার পরামর্শে ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেনকেও প্রকল্পে যুক্ত করা হয়। শুরু থেকে যুক্ত ছিলেন মো. ফখরুল ইসলাম চৌধুরী ও শিমুল সালাহ্উদ্দিন। এ ছাড়া ভাষা ও কপি সম্পাদনায় কবি তুষার দাশ ও মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাকসহ আরও অনেকে নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছেন। প্রায় ১ বছরের প্রাথমিক পরিকল্পনা এবং ২ বছরের কর্মযজ্ঞের ফসল দুই খণ্ডের এই মুজিবপিডিয়া।

দীর্ঘ এই কাজের কর্মপদ্ধতি কী ছিল? পরিকল্পনা মতে কাজটা কতটা সফল?

প্রথমে ৩০ জন গবেষককে নিয়োগ দিয়েছিলাম। সম্পাদনা পর্ষদ ও লেখক-গবেষকদের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনার পর বইয়ের তালিকা তৈরি হয়। তালিকা অনুযায়ী প্রায় ৪০০ বই সংগ্রহ করি। বইগুলো গবেষকদের মধ্যে ভাগ করে দেই। প্রতিদিন একেকজন গবেষককে একেকটি বইয়ের অন্তত ১২৫ পৃষ্ঠা পড়া এবং তা থেকে কি-ওয়ার্ডগুলোর বিষয়ে নোটের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

দুই মাস ধরে এই প্রক্রিয়া চলে। এতে করে একেকজন গবেষক দুমাসে পড়ে ফেলেন ৬ হাজার পৃষ্ঠারও বেশি। কি-ওয়ার্ডের যে নোট তারা তৈরি করেন, সেটা ছিল প্রায় ১৫ হাজার পৃষ্ঠার! এর মধ্যে মূল কি-ওয়ার্ড ছিল প্রায় এক হাজার। সেখানে যেসব বিষয়, ঘটনা, ব্যক্তি ও স্থানের নাম পাওয়া গেছে তা থেকে ৫৯১টি ভুক্তি চূড়ান্ত হয়। তবে, ৩০ জন গবেষক নিয়ে কাজ শুরু করলেও শেষপর্যন্ত টিকে ছিলেন মাত্র ১২ জন গবেষক।

গবেষকের অভাব দূর করতে দেশের ৮৫ জন বিশিষ্ট লেখক-গবেষক-সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদকে ভুক্তি লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। ভুক্তির তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ৪ জন গবেষককে নিয়ে একটি কমিটি করে দিই, যারা প্রতিটি ভুক্তি পড়ে পাশে নোট দিতেন, এতে কী ঘাটতি আছে, কী কী তথ্য থাকা দরকার, বিভ্রান্তিকর তথ্য কী কী আছে- ইত্যাদি। পরে তা আরেকদল গবেষককে দেওয়া হতো সঠিক তথ্য যুক্ত করা ও সংশোধনের জন্য। এভাবেই একেকটি ভুক্তি চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলোর বিষয়ে প্রধান সম্পাদকের মতামত নিয়েছি। পুরো পাণ্ডুলিপি তৈরি প্রধান সম্পাদক দেখে দিয়েছেন। আমরা মনে করি, পরিকল্পনা অনুযায়ী সাফল্যের সঙ্গেই কাজটা শেষ করতে পেরেছি। এতে কোনো ভুল-ত্রুটি পাওয়া গেলে পরের সংস্করণে সংশোধন করা হবে।

অনেক বইয়ের ভিড়ে এ বইয়ের বিশেষত্ব কী? একজন পাঠক কেন বইটা কিনবেন বা কেনা উচিত?

একটিমাত্র বইয়ে পাঠক পেয়ে যাবেন বঙ্গবন্ধুর জীবন-কর্ম, দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রায় সব তথ্য ও ঘটনাবলি। ১৯২০-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবন-কর্মের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, স্থান ও চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে।
 
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আরও আগে কেন হয়নি বলে মনে করেন?

এমন বিশাল কাজ করার জন্য গবেষক ও কর্মীবাহিনী যেমন দরকার, তেমনি দরকার অনেক অর্থও। যে কারণে এমন কাজ করতে কেউ এগিয়ে আসেননি। আমরা কাজটা করতে পারব; এটাও অনেকে বিশ্বাস করেননি।

আপনি একজন কবি। গবেষণা-সম্পাদনা করতে গিয়ে কী ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন?

এটা নিঃসন্দেহে নতুন অভিজ্ঞতা। সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান পড়তে গিয়ে কিছু গবেষণাকর্ম করতে হয়েছে। তবে, এতদিনে তার কিছুই মনে ছিল না। বছর চারেক আগে এনসাইক্লোপিডিয়া বিষয়ে জানতে গিয়ে প্রচুর নোট নিয়েছিলাম। কাজটা কীভাবে করব- তার একটা ছকও তৈরি করে রেখেছিলাম। সেই ছকে কাজটা করেছি।

সমস্যা হয়েছে আমার সম্পাদনা পর্ষদের সহকারী ও গবেষকদের নিয়ে। গবেষণাকাজে প্রধান সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক ছাড়া আর কেউই তেমন অভিজ্ঞ ছিলেন না। সত্যি বলতে, প্রায় ৮০ ভাগ ভুক্তির 'ইন্ট্রো' আমাকেই লিখতে হয়েছে।
 
এই প্রকাশনায় ভুক্তি লেখকদের অনেকে বিভিন্ন বইয়ের নাম বললেও নিয়েছেন অনলাইন, উইকিপিডিয়া থেকে। সম্পাদক হিসেবে তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কী কী পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন?

এই প্রকাশনায় যেসব লেখক-গবেষক ভুক্তি লিখেছেন তাদের উইকিপিডিয়া থেকে কোনো তথ্য নেওয়ার উপায় ছিল না। ভুক্তি লেখার জন্য যে গাইডলাইন বা নির্দেশিকা তাদের দেওয়া হয়েছিল সেখানে উইকিপিডিয়া থেকে কোনো তথ্য ব্যবহার না করার শর্ত ছিল। যেসব বই থেকে তথ্য বা ছবি নেওয়া হয়েছে, তার পৃষ্ঠা-নম্বরসহ বইয়ের নাম উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতাও ছিল। তাছাড়া, একটা ভুক্তি সম্পাদনা-দপ্তরে আসার পর তার তথ্য ৪ জনের একটা কমিটি যাচাই-বাছাই করতেন।

বঙ্গবন্ধুর আশেপাশে ছিলেন এমন স্বল্প পরিচিত মানুষের পরিচয়ও এসেছে মুজিবপিডিয়ায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিবারের পাশে আর্থিকভাবে আমৃত্যু ছিলেন কাজী জহিরুল কাইয়ুম, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ মহবুব আনাম, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আইনজীবী ও ৭০ সালের এম এন এ মীর হোসেন চৌধুরী- এমন অনেকের পরিচয় আসেনি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সভাপতি-সেক্রেটারিদের নামও। এমন গুরুত্বপূর্ণ লোকদের ছাড়া বঙ্গবন্ধুর অনেক কিছু জানা যায় না। এরা বাদ পড়ার কারণ কী?

এনসাইক্লোপিডিয়া করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের লেখা ৩টি বই এবং 'সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান'-এর ১২টি খণ্ডের ওপরই প্রধানত নির্ভর করেছি। এতে যেসব প্রসঙ্গ এসেছে, যেসব নাম এসেছে- সেসব প্রসঙ্গ ও নামের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে লক্ষ্য রেখেছি, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে কাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, বইয়ের একটা নির্দিষ্ট আয়তনের মধ্যেও আমাদের থাকতে হয়েছে। ফলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুক্ত অনেক প্রসঙ্গ বাদ দিতে হয়েছে। সম্পাদনা পর্ষদের সবাই আলোচনার মাধ্যমেই ভুক্তিগুলোর নাম চূড়ান্ত করেছি।

বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষদের আপন হলেও 'মুজিবপিডিয়া' সাধারণ মানুষের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে হয়নি। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা নেওয়ার পরেও বইয়ের দাম অনেক বেশি (৮ হাজার )- এ বিষয়ে মন্তব্য কী?

স্পন্সর নেওয়ার পরেও এ বইয়ে প্রকাশককে প্রায় এক কোটি টাকা লগ্নি করতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও বইয়ের দামের সঙ্গে সেই অর্থ যুক্ত করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রথম একটি এনসাইক্লোপিডিয়া বেরোচ্ছে- ফলে এটা করতে গিয়ে মুদ্রণ ও কাগজের সর্বোচ্চ মান রক্ষারও চেষ্টা করা হয়েছে। তা ছাড়া, বইয়ের মুদ্রণ খরচের সঙ্গে কমিশনের ৩৫ শতাংশ ও সম্পাদনা পর্ষদের ২৫ শতাংশ রয়্যালিটি যুক্ত করতে হয়েছে। এ কারণেই বইয়ের দাম কিছুটা বেড়েছে।

শতবর্ষে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। কাজ করতে গিয়ে কোন কোন বইগুলো আগামী ২০ বছর পরের পাঠক পড়বে বলে মনে হয়েছে?

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অন্তত হাজার তিনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু রচিত বই ছাড়া শেখ হাসিনার 'শেখ মুজিব আমার পিতা', 'শেখ ফজিলাতুন নেছা আমার মা', শেখ হাসিনা সম্পাদিত 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ' ও 'সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান' পাঠকরা আরও বহু বছর পড়বে বলে মনে হয়।

Comments