জেদ-রাগে মাটিতে গড়াগড়ি করে শিশু, বাবা-মায়ের জন্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শ

ছবি: সংগৃহীত

ধরুন, কারো বাড়িতে অতিথি হয়ে গেছেন। সঙ্গে আছে আপনার শিশু সন্তান। ওই বাড়িতে অন্য কোনো শিশুর হাতের খেলনা নিয়ে নেওয়ার জন্য আপনার সন্তান জেদ শুরু করল। আপনারা যতই বোঝানোর চেষ্টা করেন না কেন, সে মানছেই না। এক পর্যায়ে সে চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করল বা ওই শিশুটি মারধর করে বসল।

অথবা শিশুকে নিয়ে কোনো শপিং মলে ঘুরতে গেলেন। সেখানে কোনো জিনিস কিনে দেওয়ার জন্য সে প্রচণ্ড জেদ ধরে বসল, রাগ করে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে শুরু করল কান্না। কিনে না দেওয়া পর্যন্ত তাকে কোনোভাবেই শান্ত করা গেল না।

এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় অনেক বাবা-মাকেই। এমন আচরণ করতে করতে একটা সময় এটি শিশুর অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তখন সে তার চাহিদা অনুযায়ী কিছু না পেলেই এমন আচরণ করে, যাতে বাবা-মার ধৈর্য ধরে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পরে। অনেক সময় বাবা-মা মেজাজ হারিয়ে শিশুকে কড়া শাসন করেন বা মারধর করেন, যা একেবারেই ঠিক নয়।  

তাহলে এই সময়ে বাবা-মার কী করা উচিত? কীভাবে সঠিক উপায়ে শিশুর জেদ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? শিশুর এমন জেদ ধরার কারণই বা কী? চলুন জেনে নিই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, শিশুদের অতিরিক্ত জেদ বা রাগকে বলা হয় ট্যানট্রম, যার অর্থ খামখেয়ালিপূর্ণ বদমেজাজ বা অতিরিক্ত ক্রোধ। শিশু হঠাৎ করেই উগ্র মেজাজ দেখাতে পারে, জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করতে পারে, ভাঙচুর করতে পারে, এমনকি গায়ে হাতও তুলতে পারে।

 

কেন হয় ট্যানট্রম

শিশুরা তাদের মনের ভাব সহজে প্রকাশ করতে পারে না। তা ছাড়া অনেক শিশুর মনোযোগের চাহিদা থাকে বেশি। তারা তাদের নিজস্ব হতাশা, ক্ষোভ বা চাহিদা প্রকাশ করে ট্যানট্রমের মাধ্যমে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যেভাবে নিজেদের অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, শিশুরা সেটি পারে না। ফলে অনেক শিশুর মধ্যে দেখা যায় 'টেম্পার ট্যানট্রম'।মূলত ৩ থেকে ৭ বছরের মধ্যে টেম্পার ট্যানট্রম প্রকাশ পায়।

এই সময়কে যদি শিশুর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে ধীরে ধীরে শিশুর মধ্যে নেতিবাচকতা জন্ম নেবে। যা শিশুর ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে না।

শিশুর জেদ বা ট্যানট্রম নিয়ন্ত্রণ

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'অনেকেই শিশুদের অতিরিক্ত জেদের জন্য বাবা-মাকে দায়ী করে থাকেন। অনেকেই মনে করেন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এটি ঠিক হয়ে যাবে। তবে ৩ বছর বয়সের পরে শিশু যদি আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তবে বাবা-মাকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।'

তিনি জানান, সাধারণত অতিরিক্ত রাগের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিকার নেই। তবে শিশুদের রাগ-জেদ নিয়ন্ত্রণ ও ভালো আচরণের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-

শিশুকে নিয়মের মধ্যে আনুন

শিশুদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম একটি ছকের মধ্যে হওয়া উচিত। এতে শিশু বুঝতে পারবে কোনটার পর কোন কাজটি করতে হবে এবং সেভাবে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। প্রতিদিনের খাওয়া, ঘুম, খেলা, বিশ্রাম নিয়মের মধ্যে হলে শিশু নিয়মানুবর্তী হয়ে উঠবে। পাশাপাশি অযৌক্তিক আচরণ থেকেও সে বিরত থাকবে।

শিশুকে ব্যস্ত রাখুন

কোনো গেজেট নয়, কয়েক সেট খেলনা দিয়ে জেদের সময় তাকে ব্যস্ত রাখতে পারেন। তবে একেবারেই সব খেলনা না দিয়ে আলাদাভাবে খেলনাগুলো দিলে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখা যায়। শিশুকে খেলা দিতে হবে তার বয়স অনুসারে। শিশুর ক্ষুধা, অতিরিক্ত উত্তেজনা, একঘেয়েমি, বিষণ্নতা কাটাতে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতের নাগালে রাখা উচিত।

শিশুর মনের ভাব প্রকাশে সহায়তা করুন

শিশু অনেক কিছু বুঝলেও অনেক সময় সাধারণভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না, তখনই শুরু হয় জেদের প্রকাশ। তাই শিশুকে মাঝেমাঝে প্রশ্ন করুন যে, সে এখন কলা খেতে চায় না আপেল? এখন লাল জামা পরবে না নীল জামা? অবসর সময়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন সে এখন বই পড়তে চায়, নাকি খেলনা দিয়ে খেলতে চায়?

মাঝেমাঝে অবজ্ঞা করতে শিখুন

আদরের সন্তান চাওয়া মাত্রই সবকিছু হাতে নাগালেই দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ফলে শিশু সহজেই পেতে শিখে যায়। এতে করে শিশু যদি কখনো চাওয়ামাত্র কিছু না পায় তখন জেদ দেখাতে শুরু করে। সেই মুহূর্তে অভিভাবকের উচিত হবে তার চোখে চোখ না রেখে কথা বলা। শিশুর আচরণকে কোনোরকম গুরুত্ব না দেওয়া। মনোযোগ না পেলে তাদের মধ্যে শান্ত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। একে বলে 'ট্যানট্রম সাবসাইডিং'।

শিশু উত্তেজিত হয় এমন কাজ এড়িয়ে চলুন

শিশুকে রাগান্বিত করে এই ধরনের কাজ, অবস্থা, স্থান এড়িয়ে চলা উচিত। বাড়ির বাইরে অনেক সময় শিশুরা জেদের প্রকাশ ঘটায়। আপনার শিশুর যদি ট্যানট্রম থাকে, তবে শপিং মল, রেস্টুরেন্ট এই জায়গাগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। শপিং মলে সাজিয়ে রাখা খেলনাগুলো শিশুদের পেতে ইচ্ছে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তখন সেই খেলনাগুলো না পেলে সে জেদের মাধ্যমে তার মনের ভাব প্রকাশ করে।

তাছাড়া রেস্টুরেন্টে গেলেও খাবারের অতিরিক্ত সমাহার শিশুকে উত্তেজিত করে তোলে। ট্যানট্রম থাকলে এই জায়গাগুলোতে শিশুদের না নিয়ে যাওয়াই ভালো। যদি একান্তই নিতে হয় তবে বাসা থেকে আগেই কাউন্সিলিং করে নিতে হবে। তাদেরকে খেলার মাঠে নিয়ে যেতে পারেন। এতে যেমন শিশু মনের ভাব প্রকাশ করা শিখবে, তেমনি তার মানসিক বিকাশও সুষ্ঠুভাবে হবে।

জেদ করলে অভিভাবকের আচরণ কী হবে

আপনার শিশু যখন রাগ দেখাতে শুরু করবে, সেই রাগকে দমন করার জন্য উল্টো রেগে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। শিশুদের গায়ে হাত তোলা বা বকাঝকা করা উচিত না। এ সময় চিৎকার চেঁচামেচি না করে তাদের কোলে তুলে নিতে হবে, নরম সুরে কথা বলতে হবে এবং যথাসম্ভব স্থান ত্যাগ করতে হবে।

অনেক শিশুর মধ্যে মারামারির প্রবণতা দেখা যায়। জেদের সময়টা তাকে মমতা দিয়ে ধরে রাখুন। স্বাভাবিক হয়ে এলে তাকে বোঝান, এভাবে মনোযোগ পাওয়া যাবে না। যদি সে কিছু চায় সেটা তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হবে। অভিভাবক হিসেবে এতটুকু ধৈর্য আপনাকে ধরতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ৪ বছরের নিচে শিশুদের অতিরিক্ত জেদের কারণে কঠিন শাস্তি দেওয়া উচিত না। অভিভাবক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মারধর করলে শিশুর মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

মূলত ৩ বছরের পর থেকেই শিশু তার নিজের মনের ভাব সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ধীরে ধীরে অতিরিক্ত রাগ কমে আসে। কিন্তু ৪ বছর বয়সের পরও যদি অতিরিক্ত রাগের কারণে শিশু নিজেকে বা অন্যকে আঘাত করতে থাকে, জেদ না কমাতে পারে তবে একজন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Session delays, irregularities, and lack of central planning cited as reasons

10h ago