স্কুল শিক্ষক থেকে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান কাকার

পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার। ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার। ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানের অষ্টম তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আগামীকাল সোমবার শপথ নেবেন বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টির (বিএপি) সিনেটর আনোয়ারুল হক কাকার। বেলুচিস্তানের এই নেতা তার চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতায়।

'অখ্যাত' আনোয়ারুল কাকার

২০১৩ সালে মীর হাজর খান খোসোর পর বেলুচিস্তান প্রদেশের দ্বিতীয় নেতা হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন কাকার।

গত শনিবার পাকিস্তানের সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও জাতীয় পরিষদের বিদায়ী বিরোধীদলীয় নেতা রাজা রিয়াজ ইসলামাবাদের এক বৈঠকে কাকারের নাম নিয়ে ঐকমত্য পোষণ করার পর এই ঘোষণা আসে।

পাকিস্তানের সবচেয়ে কম জনগোষ্ঠীর প্রদেশ বেলুচিস্তানের কিলা সাইফুল্লাহ অঞ্চল থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদ আনোয়ারুল হক কাকার এর আগে কোনো আলোচনাতেই ছিলেন না। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কীভাবে শিক্ষক থেকে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদায়ী জোটের এক সদস্য বলেন, জোটের অনেকের কাছেই কাকারের মনোনয়ন ছিল 'বিস্ময়কর'। 'যারা কাকারের মনোনয়ন পত্রে সই করেন, তাদের অনেকে এমনকি তার নামও জানতেন না।'

যেভাবে এলেন রাজনীতিতে

শিক্ষকতা ছেড়ে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশ নেন কাকার। তিনি পিএমএল-কিউ দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিলেও পিপিপির প্রার্থী নাসির আলি শাহের কাছে পরাজিত হন।

পরবর্তীতে তিনি পিএমএল-এন দলে যোগ দিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সানাউল্লাহ জেহরির মুখপাত্র হিসেবে ৩ বছর কাজ করেন।

২০১৮ সালে তিনি জেহরির বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটে নেতৃত্ব দেন। যার ফলে জেহরি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং নতুন মুখ্যমন্ত্রী হন আবদুল কুদ্দুস বিজেনজো।

একই বছর তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সিনেটর হন। এর কিছুদিন পরেই তিনি সৈয়দ সাইদ আহমেদ হাশমীর সহযোগিতায় বিএপি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএপি বেলুচিস্তানে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। তখন থেকে তিনি সিনেটে বিএপির সংসদীয় নেতা, প্রতিনিধি ও প্রধান মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করে আসছেন। তবে এ বছরের শুরুতে তিনি দলে রদবদলের পর সংসদ নেতার ভূমিকা হারান।

আনোয়ারুল কাকার ২০১৮ সালে বেলুচিস্তান থেকে ৬ বছরের জন্য সিনেটর নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের মার্চে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।

পাশাপাশি তিনি প্রবাসী পাকিস্তানি ও মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সিনেটের স্থায়ী কমিটির চেয়ারপারসন। একই সঙ্গে তিনি ব্যবসায়ী, উপদেষ্টা কমিটি, অর্থ ও রাজস্ব, বৈদেশিক বিষয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক কমিটিরও সদস্য।

কাকার ২০২০ সালে জোরপূর্বক ধর্ম পরিবর্তন প্রতিরোধ সংক্রান্ত একটি সংসদীয় প্যানেলেরও প্রধান ছিলেন।

পাকিস্তানের সাংবাদিক জিয়াউর রহমানের ভাষ্যে, 'সাম্প্রতিক সময়ে কাকার পিএমএল-এনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছেন।' বিশেষত, বেলুচিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জাম কামালের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন তিনি।

পাকিস্তানের নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার। ছবি: এএফপি
পাকিস্তানের নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার। ছবি: এএফপি

এ বছরের মার্চের শেষের দিকে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের আগে তার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করেন কাকার। বিএপি ছিল ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) জোট সরকারের অন্যতম শরীক। পাশাপাশি পাকিস্তান মুসলিম লীগ কায়েদ (পিএমএল-কিউ) ও মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম-পি) নামের ২টি দলও তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, যা পরবর্তীতে ইমরানের অনাস্থা ভোটে হেরে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত।

ইন্ডিয়া টাইমস জানিয়েছে, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে আনোয়ারুল কাকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

বিএপির প্রতিষ্ঠাতা

সিনেটর কাকারকে বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টির (বিএপি) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৮ সালে দলটি গঠিত হয়। সে বছর নির্বাচনের আগে বেলুচিস্তানের অনেক জনপ্রিয় প্রার্থী এই দলে যোগ দেন।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জালাল নুরজাই বলেন, 'বিএপি গঠনের প্রাথমিক চিন্তাধারা কাকারের মাথা থেকেই এসেছিল। সে বছর তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সিনেটের সদস্য হন।'

প্রথাগতভাবে রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য না হলেও তার কয়েকজন আত্মীয় সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

পারিবারিক জীবন

আফগানিস্তানের সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত জেলা কিলা সাইফুল্লাহতে একটি মধ্যবিত্ত পশতুন পরিবারে ১৯৭১ সালের ১৫ মে জন্ম নেন কাকার।

কালাত রাজ্যের রাজনীতির সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরা যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৮ সালে এই রাজ্য পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।

কাকারের দাদা ড. নুর মোহাম্মদ কাকার পেশায় ছিলেন চিকিৎসক এবং বাবা ইহতিশামুল হক কাকার কালাতের নায়েব তহশিলদার, তহশিলদার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বেলুচিস্তান রাজ্যের অন্যান্য অংশেও কাজ করেন। তার মামা আরবাব ইউসুফ কাসি ও অন্যান্য আত্মীয়রা সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।

কাকারের স্ত্রী বা পরিবারের অন্যান্য সদস্য সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি।

শিক্ষা জীবন

কাকার কোয়েটার বেসরকারি সেইন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে কোহাটের ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। সেখানে লেখাপড়া শেষে তিনি কোয়েটায় ফেরে বেলুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তিনি সামাজিক বিজ্ঞান ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার। ছবি: রয়টার্স
পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার। ছবি: রয়টার্স

পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্যে আইন পড়তে গেলেও ডিগ্রি শেষ না করেই দেশে ফেরেন।

নিজ শহরের একটি স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি তার চাকরিজীবন শুরু করেন।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হামিদ মীর জিও নিউজকে বলেন, 'রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও আনোয়ারুলকে দেশের একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য করা হয়। বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টির এই আইনপ্রণেতা পশতুন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। তাই তিনি পশতুন ও বেলুচ উভয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন।'

ইন্ডিয়া টাইমস জানিয়েছে, কাকার ইংরেজি, উর্দু ও বেলুচসহ মোট ৬টি ভাষায় দক্ষ।

ক্রান্তিলগ্নের কাণ্ডারি

ডনের সম্পাদকীয়তে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্রান্তিলগ্নে আনোয়ারুল কাকারের মতো স্বল্প পরিচিত, বিতর্কহীন একজন ব্যক্তিই পারবেন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে ভালো অবদান রাখতে।

বিদায়ী বিরোধীদলের নেতা রিয়াজ বলেন, 'আমরা এর আগে সিদ্ধান্ত নেই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী এমন একজন ব্যক্তি হবেন যিনি ছোট একটি প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং ব্যক্তিগত জীবনে যাকে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।'

 

Comments

The Daily Star  | English
Overall situation of foreign direct investment

Net foreign direct investment hits six-year low

The flow of foreign direct investment (FDI) in Bangladesh fell to $104.33 million in the July-September quarter of fiscal year 2024-25, the lowest in at least six years, as foreign investors stayed away from Bangladesh amid deadly political unrest, labour agitation, and a persistent economic crisis.

12h ago