প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় ‘তৃতীয় শ্রেণির’ সড়ক
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রধান সড়কটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের। এই সড়কটি ছাড়া পৌর এলাকার প্রায় অর্ধেক সড়কই চলাচলের অযোগ্য। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে সংস্কার করা এসব সড়কের পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ।
১৫০ বছরেরও বেশি পুরনো এই পৌরসভাটি কাগজে-কলমে প্রথম শ্রেণির হলেও এর অধিকাংশ সড়ক 'তৃতীয় শ্রেণির'।
পৌরসভার প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এই পৌরসভায় ২২৯ কিলোমিটার পাকা ও ২৮ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক রয়েছে।
এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সড়ক খানাখন্দে ভরা।
পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ সড়কের পাশে কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। এতে দিনের পর দিন পানি জমে বেশির ভাগ জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য খানাখন্দের। অধিকাংশ স্থানে পিচ-কংক্রিটের লেশমাত্র নেই। বৃষ্টির পানিতে সব সড়ক ডুবে গেছে।
সড়কে জমে থাকা নোংরা পানি ও ময়লার দুর্গন্ধে পরিবেশ নষ্টের পাশাপশি চলাচলে বিড়ম্বনায় পরেন সাধারণ মানুষ। এমন বেহাল চিত্র চোখে পড়েছে ফকিরাপুল থেকে টান বাজার পর্যন্ত সড়কে। এ ছাড়া, ফুলবাড়িয়ার শ্যামলিবাড়ির মোড়, মুন্সেফ পাড়া, পশ্চিম পাইকপাড়া, পশ্চিম মেড্ডা, মেড্ডা বাসষ্ট্যান্ড, কলেজ পাড়া ও দাতিয়ারা এলাকার চিত্রও একই।
১৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভায় প্রায় ৩ লাখ মানুষের বসবাস। সড়কের বেহাল দশার কারণে এই এলাকার সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সঙ্গীত শিল্পী, নারী নেত্রী, নাগরিক কমিটি, স্কুল শিক্ষক ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সড়ক সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন খোদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাবেক পৌর কাউন্সিলররাও।
সম্প্রতি শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ফুলবাড়িয়া এলাকার নাগরিকরা রাস্তা সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধ করেছেন। এমনকি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সড়ক সংস্কার করা না হলে পৌরসভা কার্যালয় ঘেরাও করারও হুশিয়ারি দেন তারা।
ফুলবাড়িয়া এলাকার শ্যামলীবাড়ি মোড়ে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বাংলাদেশের কোনো পৌরসভায় এত দীর্ঘ সময় ধরে সড়ক সংস্কারবিহীন অবস্থায় থাকে বলে মনে হয় না। এই জেলার কোথাও এর চেয়ে খারাপ সড়ক নেই। এই পৌরসভার চেয়ে ইউনিয়নের সড়কও অনেক ভালো।'
জানা যায়, শহরের প্রধান সড়কসহ পাড়া-মহল্লার সড়কগুলো দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা চলাচল করে।
পৌরবাসীর ভাষ্যমতে, প্রায় প্রতি বছরই পৌরসভার পক্ষ থেকে কয়েকটি সড়ক সংস্কার করা হয়, যা খুবই দায়সারাভাবে। ফলে সংস্কারের কয়েক মাস না যেতেই সড়কগুলো পুরানো চেহারায় ফিরে যায়। আর দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় কিছু সড়কে চলতে অবর্ণনীয় কষ্ট পোহায় মানুষ।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার সভাপতি আবদুন নূর বলেন, 'পৌরসভার অধীনে সড়ক সংস্কার কাজের গুণগত মানে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। যেকোনো কাজের গুণগত মান নিশ্চিত না হলে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি থাকলে জনগণের ভোগান্তি থাকবেই। এ জন্যই দুর্ভোগ এই পৌরসভার নাগরিকদের নিত্যসঙ্গী।'
জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, 'যেদিক দিয়েই শহরে প্রবেশ করবেন সেদিকেই কঙ্কালসার রাস্তা আপনাকে স্বাগত জানাবে। প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লার সড়কের চেহারা ক্ষত-বিক্ষত। বর্ষা মৌসুমে চলাচল করা দায় হয়ে পড়ে।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রতন কান্তি দত্ত বলেন, '১৫৫ বছরের পুরানো একটি পৌরসভার রাস্তাঘাট এমন হবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। সড়কের পাশাপাশি এই শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থাও নাজুক। পানি নিষ্কাশনের জন্য শহরের একমাত্র টাউন খালই ভরসা। এ ছাড়া শহরের যত্রতত্র পড়ে থাকে ময়লা-আবর্জনা। এখানকার তৃতীয় শ্রেণির সড়কগুলো দেখলে আর বোঝার উপায় থাকে না যে এটি একটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা।'
পৌর এলাকার বণিক পাড়ার বাসিন্দা বিপ্লব বণিক বলেন, 'সড়কের পানি নিষ্কাশনের পথ না থাকায় বৃষ্টির পানি জমে থাকে। এতে অধিকাংশ রাস্তাঘাটের অবস্থা শোচনীয় ও যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। রোগী তো দূরের কথা, সুস্থ মানুষও এই রাস্তায় চলাচল করতে কষ্ট পায়।'
সঙ্গীত শিল্পী হৃদয় কামাল বলেন, 'পাড়া-মহল্লার অধিকাংশ সড়ক এতটাই ভাঙাচোরা যে কোনো কোনো মহল্লায় যেতেই চান না রিকশাচালকরা। ভাঙা সড়কের অজুহাত তারা ভাড়াও বেশি নেন।'
পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল কুদ্দুস বলেন, 'এই পৌরসভায় তহবিল সংকট রয়েছে। এ অবস্থায় নিজস্ব অর্থায়নে সড়ক সংস্কার ও ড্রেন নির্মাণে মোট ৬৫টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ৫৪টির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ১১টি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। আরও ১৪টি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সম্প্রতি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।'
Comments