শৈশবের গ্রামে হারানো বর্ণিল সেই কোরবানির ঈদ

ছবি: সংগৃহীত

কোরবানির ঈদের কথা মনে হলেই প্রথমেই মনে পড়ে যায় সোনালি শৈশবের ঈদের কথা। বেশিরভাগ মানুষের জীবনে তার ছোটবেলা আর বেড়ে ওঠার সময়টিই সম্ভবত সবচেয়ে ঐশ্বর্যময়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে গ্রামে আমাদের কাদামাটি মাখা শৈশবের সেই ঈদগুলো ছিল ভীষণ প্রাণোচ্ছল আর নিখাদ আনন্দে ভরপুর।

ফেলে আসা গ্রামের সেই দুরন্ত জীবনের দিকে পিছু ফিরলেই চোখে ভেসে উঠে সেই দিনগুলোর স্মৃতিমধুর অধ্যায়। আমাদের নস্টালজিয়ার অনেকটুকু অংশজুড়ে আছে গ্রামে শৈশবের সেই কোরবানির ঈদ। দুরন্ত ছেলেবেলার গ্রামের সেই কোরবানির ঈদের স্মৃতিচারণা রইল এই লেখায়।  

প্রথম হাটে যাওয়ার প্রতীক্ষায়

ঈদ আসার তখনো হয়তো সপ্তাহ দুয়েক বাকি। কিন্তু তখন থেকেই শুরু হয়ে যেত কোরবানির পশু কেনার প্রস্তুতি। আর সে প্রস্তুতি শুরু হতো প্রথম হাটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। গ্রামে প্রথম হাটটি বসতো ঈদের কমপক্ষে ১৫ দিন আগে। অস্থায়ী সেই হাটের মধ্য দিয়েই ঈদের আগাম সুবাস ছড়িয়ে পড়তো গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে।

আমাদের গ্রামের সাপ্তাহিক হাটটিই ঈদের আগমনী বার্তা বহন করে আনত। সাপ্তাহিক হাট বিকেলবেলা বসলেও প্রথম হাটটি শুরু হতো সকালবেলা। হাটবারের কদিন আগে থেকেই আমরা ছোটরা তক্কে তক্কে থাকতাম কী করে সেই হাটে যাওয়ার ফুসরত মিলে। হাটবার নিয়ে সমবয়সী বন্ধু কিংবা স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে চলত শলাপরামর্শ।  সবার মধ্যেই দারুণ উত্তেজনা। হাটটি ঈদের বেশ আগে হতো বলে স্কুলের ছুটি তখনো শুরু হতোনা। তাই আমরা ও আমাদের সহপাঠীদের কেউ কেউ অপেক্ষা না করেই স্কুলের মধ্যাহ্ন বিরতিতে স্কুল পালাতাম।

গ্রামের হাট মানেই কেবলই গরু ছাগল দেখার পর্ব নয়। আমরা সেই আকর্ষণেও হাটে যেতাম না। মূলত কোরবানির প্রথম হাটকে কেন্দ্র করে হাটের পাশে নানান পসরা সাজিয়ে বসা অস্থায়ী দোকানগুলোই ছিল আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। প্রথমেই আমরা  কমবয়সী স্কুল পালানো ছোকড়ারা হাটের পাশে বসা নাড়ু বাতাসার দোকানে ঢুঁ মারতাম। সঙ্গে জমানো দু-চার-পাঁচ টাকাই ছিল এক্ষেত্রে বড় সম্বল। আমাদের সেকালে আট আনায় একটি করে জিলাপি মিলত; নাড়ু, বাতাসা কিংবা তেলেভাজা পাওয়া যেত টাকায় চারটি করে।

শুকনো কাঁঠালপাতায় মোড়ানো সেই জিলাপি, নাড়ু আর বাতাসা খেতে খেতে আমরা হাটের চারদিকে ঘুরপাক খেতে খেতে দেখতাম হাটে ওঠা গবাদিপশু, তৈজসপত্র আর খেলনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই রঙ-বেরংয়ের মুখরোচক খাবার খেতে খেতে জমানো টাকা ফুরিয়ে যেত।  হাটের এককোণে হাঁপরের বাতাসে গণগনে লোহায় হাতুড়িপেটা করত কামার আর তার সাগরেদ।  সে জায়গাটি ছিল ভীষণ উষ্ণ। কামারের হাতুড়িপেটায় ক্রমেই পেটানো লোহা পরিণত হতো দা, ছুরি, বটি কিংবা চাপাতিতে। কতক্ষণ সেখানেই দাঁড়াতেই বিকেল হয়ে আসত। আর তখনই আমাদের সেখান থেকে সরে যেতে হতো। কারণ বিকেল হলেই বাপ-চাচাদের চলে আসার সম্ভাবনা থাকত। সেক্ষেত্রে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ও ছিল।

উন্মুক্ত প্রান্তরে গ্রামের পশুর হাট। ছবি: সংগৃহীত

সে ঈদে ছিল না নতুন পোশাক কিংবা জুতা কেনার পর্ব

আমাদের সময়ে আমর নতুন পোশাক ও জুতা কেনার সুযোগ পেতাম কেবল রোজার ঈদেই। রোজার ঈদের শেষে   আলমারিতে তুলে রাখা জামাকাপড়ই ফের বের করে পরা হতো কোরবানির ঈদের সময়। ফলে কোরবানির ঈদে নতুন পোশাক কিংবা জুতা কেনার পর্ব ছিল না। এ নিয়ে আমাদের চাহিদাও ছিল না তেমন।

রোজার ঈদের আগে আমাদের মধ্যে চাঁদ দেখার আগ্রহ থাকত। এ জন্য অপেক্ষাও করতাম খুব। কোরবানির ঈদে সেটি ছিল না।

কোরবানির পশু কেনা ও হাটে যাওয়া

ঈদের কদিন আগে কোনো এক বিকেলবেলা আমরা ছোটরা বাবা, চাচা কিংবা দাদার হাত ধরে চলে যেতাম গ্রামের হাটে। সেদিনই হয়তো গরু কিংবা ছাগল কেনা হবে। আগের রাতেই বাবা-চাচাদের আলোচনা শুনে আমরা এটা ধারণা করে নিতাম। সেদিন সকাল থেকেই আমরা ছোটরা তক্কে তক্কে থাকতাম বাবা-দাদা কখন হাটে যাবে! স্বভাবতই সেই সময়টা দুপুরের পরে হতো।

কিন্তু বাপ-দাদারা কখনোই আমাদের সঙ্গে নিতে চাইতেন না। যারা অনেকটাই ছোট তারা কান্না জুড়ে দিত। তখন বয়োজ্যেষ্ঠরাও গরুর লাথি খাওয়ার ভয় দেখাত। কিন্তু আমাদের হার না মানা সেই পণে এই ভয় কোনো বাগড়া দিতে পারত না।

দুপুরের খাবারের পর একটুখানি জিরিয়েই অপেক্ষাকৃত ছোটদের রেখে বাপ-চাচারা হাটে চলে যেতেন। আমরা সমবয়সী চাচাতো-জেঠাতো ভাই-বোনদের তাতে কী আর আটকায়। গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে ক্রোশখানেক দূরের সেই হাটে পৌঁছাতেই ভিড়ের মাঝে দেখা মিলত বিক্রেতার সঙ্গে দর কষাকষিরত বাপ-দাদাদের। তাদের দেখতে পেয়ে আমাদের মুখে যতখানি হাসি ফুটে উঠত, ঠিক ততখানিই বিরক্ত হতেন তারা।

দর কষাকষির এক পর্যায়ে শেষ বিকেলের কোন এক ফাঁকে কেনা হয়ে যেত কোরবানির পশুটি। সেই পশুর দড়ি ধরার সুযোগ পেতে সে কী অধীর আগ্রহ ছিল আমাদের। সেই অসীম আগ্রহে পুরোপুরি জল না ঢেলে ছাগলটির দড়ি ধরার সুযোগ দিতেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। সেই দড়ি হাতে বিজয়ীর বেশে বাড়ির দিকে যাত্রা করতাম কনিষ্ঠরা।

বয়োজ্যেষ্ঠরা গরু নিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেলেও আমরা সব বাধা উপেক্ষা করে তখনই ছাগলটিকে বাড়িতে না নিয়ে আশপাশের বাড়িগুলো ঘুরে নিজেদের কোরবানির পশুটির উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এর মধ্যে যদি কেউ ছাগলটি কার জানার চেষ্টা করত, তবে আমরা সমস্বরে গর্বভরে মালিকের সঙ্গে ছাগলের দামটিও প্রকাশ করে দিতাম।

এরপর সেই মহান পশুটির খেদমতে নিজেদের সঁপে দিতাম আমরা সবাই। কেউ তরতর করে কাঁঠাল গাছ বেয়ে পাতা পাতা সংগ্রহ করে আনতো। কেউ ছাগলটির গায়ে কিংবা গলার নিচে হাত বুলিয়ে আদর করত। বয়োজ্যেষ্ঠদের আপত্তি সত্ত্বেও কোন এক ফাঁকে আমরা ছাগলটির স্নানকার্যও সম্পাদন করিয়ে দিতাম। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে যাদের বাড়িতে গরু লালনপালন করা হতো তাদের অবশ্য হাট অব্দি যেতে হতো না বলে, গৃহপালিত পশুকেই তারা বিপুল সমাদরে দেখভাল করত। আমাদের দুদিনের রাখালপনা আর নিখাদ আবেগকে কদাচিৎ তারা কটূক্তি করলেও আমরা তা গায়ে মাখতাম না।

এভাবে ক্রমেই এগিয়ে আসত বহুল প্রতীক্ষিত ঈদের দিনটি। তবে ঈদের দিনটির চেয়ে ঈদের আগমনী বার্তা বহনকারী দিনগুলোই বোধহয় বেশি আনন্দের ছিল। ঈদের আগের রাতে মেয়েরা মেহেদি পরত। আমাদের ছোটবেলায় প্যাকেট বা টিউব মেহেদির চল ছিলো না। তাই পাটায় মেহেদি পাতা বেটে নারিকেল পাতার শলাকা দিয়ে নকশা করে তা লাগাত বাড়ির মেয়েরা।

বহুল প্রতীক্ষিত ঈদের দিন   

গ্রামের ঈদ জামাত। ছবি: রাহুল ভূঁইয়া

ঈদের দিন সাতসকালেই কোরবানির পশুটিকে গোসল করানো হতো। আগেই ধার তোলা দা, ছুরি, বটির ধার পরখ করিয়ে নিতেন বড়রা। আমাদের ছোটদের মনে বদ্ধমূল ধারণা ছিল, আগের রাত থেকেই কোরবানির পশুটি আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে কাঁদতে থাকে। কারণ, ফেরেশতারা কোরবানির পশুটিকে জবাই করার বার্তাটি জানিয়ে দিতেন। আমরাও সেই শোকে সহানুভূতি জানিয়ে পশুটির গায়ে শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে আদর করে দিতাম।

ঈদের দিন সকালে আমরা বাড়ির পুরুষরা বড় পুকুরে একসঙ্গে গোসল করতাম। বছরে দুই ঈদের দুদিনই হয়তো সুগন্ধি সাবান ব্যবহারের সুযোগ পেতাম আমরা। তাতে যেন আনন্দের মাত্রা দ্বিগুণ হতো। গ্রামের পুকুরে গোসল শেষে ভেজা কাপড়েই বাড়ি ফিরে আসতাম আমরা। রোজার ঈদের মতো কোরবানির ঈদে নতুন কাপড়ের বালাই ছিলো না বলে পোশাক নিয়ে টানটান উত্তেজনাও থাকতো না আমাদের মাঝে।

রোজার ঈদের মতো কোরবানির ঈদে আমাদের কালে ছিল না কোন সালামির পর্ব। রোজার ঈদে যত সালামি পাওয়া যেত, তার কিছুই মিলতো না কোরবানির ঈদে। এই ঈদে আমরা সালামি পেতাম কেবল বাবা কিংবা মায়ের কাছ থেকেই। রোজার ঈদে যদি সালামি পাওয়া যেত ২০ টাকা, তবে কোরবানির ঈদে তা নেমে আসত অর্ধেকে; অর্থাৎ বড়জোর ১০ টাকায়। 

কোরবানির ঈদে রোজার ঈদের মতো রকমারি খাবার তৈরির আয়োজন হতো না। বরং আগের রাত থেকেই চলত মসলা বাটার আয়োজন।সকাল থেকে চলত হালুয়া আর রুটি তৈরির তোড়জোড়। রোজার ঈদের পর তুলে রাখা পাঞ্জাবি পায়জামা পরে আতর লাগিয়ে সেই হালুয়া-রুটি খেয়ে বাপ-দাদাদের সঙ্গে আমরা যেতাম ঈদগাহের পানে।

রোজার ঈদের মতো কুরবানির ঈদে ঈদগাহের পাশে তেমন বড় পরিসরে খেলনার দোকানের পসরা লক্ষ্য করা যেত না। অন্যদিকে ছিল সালামির সংকটও। ফলে ঈদের নামাজ শেষে কোনক্রমে কোলাকুলি পর্ব সেরেই আমরা পা বাড়াতাম বাড়ির দিকে।

কোরবানি ও অন্যান্য

পশু কোরবানির প্রহরটি আমাদের ছোটদের জন্য ছিল ভীষণ বিষাদময়। কারণ নামাজের পরই শুরু হতো গরু-ছাগল কোরবানির পালা। কয়েকদিন ধরে পশুটিকে লালনপালনের কোন এক ফাঁকে যেন সেই প্রাণীটির প্রতি আমাদের মায়া জন্মে যেত। ফলে আমাদের চোখের সামনেই সেই পশুটিকেই জবাই করার বিষয়টি নির্মম হয়ে উঠত খুব। অবশ্য বড়দের মুখে শোনা কোরবানির মাহাত্ম্যের গল্প আমাদের সান্ত্বনা দিত।

কোরবানি করা শেষে বাড়ির উঠানে মাটিতে হোগলা পাতার চাটাই বিছিয়ে তার ওপর কলাপাতা ফেলে চলত মাংস কাটাকুটির কাজ। এদিন বড় থেকে ছোট; সবাই হয়ে যেত একদিনের কসাই।

দুপুর নাগাদ কোরবানির মাংস পুরোপুরি কাটাকুটির পালা শেষ হয়ে যেত। তখন সেই মাংস তিন ভাগ করে এক ভাগ নিয়ে চলে যেতাম ঈদগাহের মাঠে। প্রতিটি বাড়ি থেকেই আসা মাংস মাঠজুড়ে স্তূপাকারে ছড়িয়ে রাখা হতো।

পরে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা দরিদ্রদের মাঝে সেই মাংস ভাগ করার দায়িত্ব নিতেন। দরিদ্রদের মাঝে সেই মাংস বিতরণের পরপরই আমরা সমবয়সী বন্ধুরা একে অন্যের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। তখনকার সময়ে ঈদের পরদিন নানার বাড়ি যাওয়ার চল ছিল। তবে আমরা ছোটরা নানার বাড়ি যেতাম যতোটা না বেড়ানোর আনন্দে তার চেয়েও বেশি কিছু সালামি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। এই ঈদে বাড়ির লোকদের কাছ থেকে সালামির বিষয়ে হাহাকার জুটলেও নানা কিংবা খালাদের হাত বরাবর প্রসারিতই থাকত। 

কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে আমাদের শৈশবের কাদামাটি মাখা সেই নিখাদ ঈদের আনন্দ। আজও প্রতি বছর ঈদ আসে। ঈদ বিদায় নেয়। কিন্তু শৈশবের সেই অনাবিল আনন্দের ঈদ কি আর ফিরে আসে!

Comments

The Daily Star  | English

Disrupting office work: Govt employees can be punished within 8 days

The interim government has moved to amend the Government Service Act-2018 to allow swift disciplinary action against its employees who will be found guilty of disrupting official activities.

6h ago