গণঅভ্যুত্থানের শক্তি থেকে যেভাবে বঞ্চিত গ্রাম
ছাত্র-জনতার এ গণ-অভ্যুত্থান ছিল মূলত নগর ও নগরাঞ্চলকেন্দ্রিক। এ কারণেই আন্দোলনের স্পিরিট বৃত্তবন্দী নগরে।অভ্যুত্থানের মর্মবাণী গ্রামপরিসর স্পর্শ করেনি। গ্রামাঞ্চলে মূলত দুটো কথা শোনা যাচ্ছে; এক. শেখ হাসিনা পালায়ছে; দুই. জনগণ শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামাইছে।
রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে এমনটি জানা গেলো। এ গণ-অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র সংস্কার বা বৈষম্য রোধের যে আকাঙ্খা তৈরি করেছিল গ্রামের মানুষের মুখে সেসব বিষয়ে কিছু শুনলাম না।
গ্রামের মানুষ আছে ক্ষমতায় কে আসবে সেই চিন্তা ও দুশ্চিন্তায়। তারা জানতে আগ্রহী কবে নির্বাচন হবে? যারা দুর্নীতি করেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, অপরাধ করেছে তাদের বিচার হবে কীনা?
অন্যায়ের বিচার চাইলেও বিচার নিয়ে তাদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। বিচারের ব্যাপারে গ্রামের মানুষ খুব বেশি আশাবাদী নয়। গোদাগাড়ী উপজেলার পলাশী গ্রামের অধিবাসী কৃষক এবাদ আলীর বক্তব্য, ৩০ বছরে তো কম দেখলাম না। কিচ্ছু হবে না? গ্রামের মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে কথা বলেন, কোনো ভূমিকা ছাড়া সিদ্ধান্ত দেন। এ এক বিশেষ ধরনের দক্ষতা। এক ফাঁকে আরেকজন কৃষক নজিবুর রহমান বললেন, জাতিসংঘ হতাহতের তদন্ত এসেছে। কিছু একটা হবে নিশ্চয়। পার পাওয়া অতো সহজ হবে না।
তথ্য-প্রযুক্তির কারণে গ্রামে জানা-অজানার সীমানা ভেঙ্গে গেছে। তথ্যধনী ও তথ্যদরিদ্র বলে যে ধারণা প্রচলিত ছিল তা ধুলোয় মিশে গেছে। গ্রামের মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষত ফেসবুক ও ইউটিউব ব্যবহার করছে।
প্রকৃতার্থে এ গণআন্দোলনের সঙ্গে গ্রামের বিচ্ছ্যুতি ঘটে গেছে। দিন যতো গড়াচ্ছে আন্দোলনের পরিসর নগরে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। মূল ভরকেন্দ্র ঢাকা। এ কারণে গ্রামের মানুষ আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামাত ও জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক ঘোরটোপের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।
গ্রামেও তথ্যের অভাব নেই। যোগাযোগ অভ্যস্ততায় এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া। গ্রামের তরুণেরা এখন খালেদ মহিউদ্দিন ও পিনাকী ভট্টাচার্যকেও চিনে। তানোর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের চাকরি প্রত্যাশী আশিকুর রহমান শুভ জানালেন, মহিউদ্দিন সাহেব এখন ডয়েস এভেলে ছেড়ে আমেরিকায় ঠিকানাতে জয়েন করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ ছিল গ্রামের মানুষের কাছে গণঅভ্যুত্থানের তথ্যের প্রধান উৎস। অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারি সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপে গ্রামের সমস্যাগুলো না আসায় তারা কিছুটা হতাশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোদাগাড়ী উপজেলার আলোকছত্র গ্রামের একজন গ্রাম্য ডাক্তার জানান, এ আন্দোলনে গ্রামের মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। কারণ, আন্দোলন হয়েছে মূলত ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর মতো বড় বড় শহরগুলোতে। গ্রাম পর্যন্ত আন্দোলনের রেশ আসেনি। উপজেলা, ইউনিয়নের সেবা আগের মতো। কোথাও আরও খারাপ।
অথচ গ্রামের মানুষ তো এ আন্দোলন সমর্থন দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ এলাকার যারা ঢাকায় থাকেন, পড়াশোনা করে, বিভিন্ন ধরনের চাকরি-বাকরি করেন তারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আন্দোলনে নেমেছিল। এ আন্দোলনের মূল শক্তি তো গেছে গ্রাম থেকে।
তানোর উপজেলার সরনজাই বাজারে চাস্টলে একজন শিক্ষক সম্পূরক প্রশ্ন তুললেন, যারা আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তারা ছিলেন মূলত গ্রামের মানুষ। ক্ষমতা যেহেতু শহরে থাকে সুতরাং সেখানে গিয়ে তা চ্যালেঞ্জ করতে হয়। তিনি প্রশ্ন তুলেন- কতজন শহরের স্থায়ী বাসিন্দা এ আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন? বাংলা ব্লকেড বা কারফিউ ভাঙ্গার সময় সারাদেশ থেকে মানুষ ঢাকায় গেছে।
তৎকালীন তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী (বর্তমানে জেলহাজতে) গত ২৪ জুলাই ২০২৪ বলেছিলেন, ঢাকায় অতিরিক্ত এক লক্ষ সিম ঢুকেছিল। বড় আশা নিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ ঢাকায় গেছে, আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে, আহত, নিহত ও গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রশ্ন তোলা হচ্ছে আহত-নিহতদের এসব মানুষের খবর কী আমরা রাখতে পারছি? মাও সে তুং বলেছিলেন, কিছু কিছু মৃত্যু থাই পাহাড়ের মতো আর কিছু কিছু মৃত্যু পাখির পালকের মতো হালকা। গ্রাম থেকে এসে যে মানুষগুলো শহিদ তাদের আত্মত্যাগ হয়ত পাখির পালকের মতো হালকা ঠেকছে। সবজীবনের বা মৃত্যুর মূল্য সমান হচ্ছে না।
যেহেতু মহানগর জিতিয়েছে সুতরাং তার আদলেই কি চিন্তা করতে হবে? জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন পরিসর তৈরির চেষ্টা হচ্ছে তাও ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকা শহর এখন কেন্দ্রীয় বুদ্ধিশালা। সব বুদ্ধি, সব আলোচনা, সব সংস্কার, সব আয়োজন ঢাকা ঘিরে।
এ গণঅভ্যুত্থান একটি নতুন কথক/বুদ্ধিজীবী শ্রেণির জন্ম দিয়েছে, তারাও ঢাকাকেন্দ্রিক। নতুন পরিসরগুলোর আলোচক বা অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। এ যেন এক সমঝোতামূলক তৎপরতা। একজন আরেক জনের সভায় যান, কখনও কখনও একে অপরকে প্রত্যাখ্যানও করেন। এরা গ্রামের দিকে যেতে যান বা যেতে পারেন না। ঢাকা এখন কথার খনি। কেবল কথা নয়, নতুন নতুন শব্দ ও কণ্ঠের জোর।
আওয়ামীলীগের দীর্ঘ অপশাসনে গ্রামের মানুষের ভেতর একধরনের ভয় ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষ একধরনের বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতর পড়েছিল। বাধ্যতামূলক ভোটের সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, মামলা-মোকদ্দমা সবমিলিয়ে আওয়ামীলীগ একটি একক অনুগত শাসনের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।
গ্রামপর্যায়ের নতুন কোনো আলোচনা নেই। পুরানো সেই ক্লেদাত্ত রাজনীতির চর্চা চলছে। একে অপরকে দেখে নেওয়ার প্রস্তুতিও কম নয়। জাতীয় রাজনীতি নিয়ে গ্রামের মানুষের ভেতর কাজ করছে গভীর হতাশা। বঞ্চনাবোধ। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত, অপশাসন তারা দীর্ঘসময় প্রত্যক্ষ করেছে। আন্দোলনের সুফল কীভাবে পাবে তা নিয়ে তাদের পরিষ্কার ধারণা নেই। কেবল রয়েছে সংশয়।
প্রকৃতার্থে এ গণআন্দোলনের সঙ্গে গ্রামের বিচ্ছ্যুতি ঘটে গেছে। দিন যতো গড়াচ্ছে আন্দোলনের পরিসর নগরে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। মূল ভরকেন্দ্র ঢাকা। এ কারণে গ্রামের মানুষ আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামাত ও জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক ঘোরটোপের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।
কারণ, মানুষ জেনে গেছে যেখানে শাসনের উন্নত ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি সেখানে দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে তালমিলিয়ে চলা ছাড়া বিকল্প নেই। নতুন সংস্কার/ব্যবস্থা নিয়ে তাদের আশা একেবারে উবে যায়নি। তবে গ্রামের মানুষ আশা নিয়ে বসে থাকতে চায় না। বিদ্যমান নতুন ও পুরানো দুটি কাঠামোর সঙ্গে নেগোশিয়েট করে চলতে চাই। কারণ তাদের ভাষায় কে কখন আসে কে কখন যায় বলা যায় না।
আওয়ামীলীগের দীর্ঘ অপশাসনে গ্রামের মানুষের ভেতর একধরনের ভয় ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষ একধরনের বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতর পড়েছিল। বাধ্যতামূলক ভোটের সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, মামলা-মোকদ্দমা সবমিলিয়ে আওয়ামীলীগ একটি একক অনুগত শাসনের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।
গ্রামপরিসরে বাধ্যতামূলক শাসনপরিস্থিতি ছিল ফ্যাসিস্ট শাসনের পাটাতন। আওয়ামীলীগ শাসনামলে ব্যক্তিক ও সামাজিক সম্পর্কের ধরে ছিল গভীর ভাটল। গ্রামসম্পর্কের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। ভিলেজ পলিটিক্স চরম মাত্রা লাভ করেছিল।
আওয়ামী শাসনামলে গ্রামের মানুষের মধ্যে চাপ ও শক্রতাপ্রবণ অপরাজনীতি প্রবল হয়েছে। যার ঘোর আবেশ এখনও বিদ্যমান। একজন প্রতাপশালী আওয়ামী নেতার মুহূর্তেই বেলুনের মতো চুপসে যাওয়ায় মানুষ হকচকিয়ে গেছে, শক অনুভব করেছে। তাদের কাছে বিষয়টি কিছুটা অবিশ্বাস্যও লেগেছে। কারণ, আওয়ামীলীগের সাজানো শাসন তাদের কাছে জগদ্দল পাথরের মতো মনে হয়েছিল।
অর্থাৎ গ্রামের মানুষের ভেতর ভয়ের আবেশ পুরোটা কাটেনি। আবার যদি আওয়ামী লীগ ফিরে আসে। রাজশাহী তানোর উপজেলার মোহাম্মদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানালেন, ফেসবুকে শেখ হাসিনার কথা শুনলাম। তিনি বলেছেন সীমান্তের কাছাকাছি আছেন যেকোনো সময় দেশে ঢুকে পড়তে পারেন। শিক্ষকের আশঙ্কা সত্যি কী তিনি বাংলাদেশের কাছে আছেন এবং দ্রুত ঢুকে পড়বেন?
আন্দোলনের ভেতর নাগরিক ইস্যু রয়েছে কিন্তু লোকের ইস্যু নেই। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ক্রমশ এলিট রূপ ধারণ করছে। সবকিছু হয়ে উঠছে খুব আয়োশী এবং বর্হিমুখী। আন্দোলনোত্তর যত বেশি কেন্দ্রীকতা বাড়ছে তত উৎস থেকে ছিটকে যাচ্ছে বা গ্রাম থেকে সরে যাচ্ছি।
এর বড় কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের পেশাজীবীতা ও রাজনীতিহীনতা। রাজনীতি এক বিশেষ মূল্যবোধ ও নৈপূণ্যতা তা অর্জন করতে হয়। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদে হাতেগোনা দুইএকজন ছাড়া অন্যদের সেই অর্থে রাজনীতি সংলগ্নতা নেই। হয়তো রয়েছে দূরবর্তীসম্পর্ক। এমনকি যারা আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের চিন্তাও গ্রাম অপৃসয়মান।
কৃষকদের সমস্যা ও তা উত্তরণে উপায় নিয়ে বিশেষ আলোচনা নেই। কৃষকেরা যে জমি হারিয়েছেন, প্রজেক্টের নামে বাধ্যতামূলক চাষাবাদের আওতায় এসেছেন। বীজ, সার ও কীটনাশকের দাম নিয়ে তাদের ত্রাহিত্রাহি অবস্থা সে খবর কে রাখছেন। কৃষকেরা যে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, সব সুবিধা যে নিচ্ছে বাজার সিন্ডিকেট কিংবা মধ্যস্বস্তভোগী সেই দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। গঠিত ছয়টি কমিশন মূল অভিলক্ষ্য কেন্দ্রিকৃত ক্ষমতার নূতন বিন্যস্ত স্থির করা। গ্রাম কোথায়, গ্রামের মানুষ কোথায়, তাদের ইস্যু কোথায়। এমন অন্তরসারশূন্যতা কাম্য নয়।
কার্যকর কিছু করতে হলে গ্রামের মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে, কথা শুনতে হবে তাদের ইস্যু চিহ্নি করতে হবে এবং সমাধান বের করতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ আজও একটি বড় গ্রাম। গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।
Comments