তাপপ্রবাহে পুড়ছে লিচু

গরমে নষ্ট হচ্ছে লিচু
তাপপ্রবাহের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার সেজামুড়া গ্রামে নষ্ট হচ্ছে লিচু। ছবি: মাসুক হৃদয়/স্টার

তীব্র তাপদাহে গাছেই ফেটে যাচ্ছে লিচু। নষ্ট হচ্ছে সুমিষ্ট এ ফলের প্রাকৃতিক স্বাদ। দাবদাহ থেকে ফসল রক্ষায় তাই নির্ধারিত সময়ের আগেই গাছ থেকে পেড়ে বাজারে নিচ্ছেন লিচু চাষিরা।

ফলে একদিকে বাজারে যেমন আসছে না ভালো মানের লিচু, অন্যদিকে উপযুক্ত বাজার দরও পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২৮ থেকে ৩২ সেলসিয়াস ডিগ্রি তাপমাত্রা লিচু ফলনের জন্য সবচেয়ে ভালো। আবহাওয়া কর্মকর্তাদের মতে, গত কয়েকদিন ধরে দিনাজপুর, রংপুর ও রাজশাহীসহ কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।

গত ১০-১৫ দিন ধরে দিনাজপুরে দৈনিক তাপমাত্রা ৩৮-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করেছে। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দিনাজপুরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আশঙ্কায় বাগান থেকে লিচু তুলে বাজারে সরবরাহ করতে শুরু করেছেন চাষিরা। তবে আগে সংগ্রহ করা লিচু মানে ভালো না হওয়ায় বিক্রি অনেকটাই কম।

গতকাল শনিবার সরেজমিনে দিনাজপুরের লিচুর সবচেয়ে বড় বাজার কালীতলা ফলের বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, সদর উপজেলা, নবাবগঞ্জ, বিরল, চিরিরবন্দরসহ অন্যান্য উপজেলা থেকে কয়েক শ কৃষক লিচু নিয়ে বাজারে এসেছেন।

কালীতলা বাজারের লিচু ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লিচুর মৌসুমে এর আগে কোনো বছর এত গরম পড়েনি। গরমের জন্য গাছে লিচু রাখা যাচ্ছে না। সবাই লিচু পেড়ে ফেলছেন। অধিকাংশ লিচুতে দাগ আছে, অনেক লিচু ফেটে গেছে। কৃষকরা লিচুর তেমন দাম পাচ্ছেন না।'

গরমে নষ্ট হচ্ছে লিচু
গরমে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায় নষ্ট হচ্ছে লিচু। ছবি: কংকন কর্মকার/স্টার

গত সপ্তাহের তুলনায় বাজারে লিচুর সরবরাহ প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান তিনি।

নবাবগঞ্জ উপজেলার আফতাবগঞ্জ গ্রামের মো. সোহেল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বাগানে প্রায় ৬০০ লিচু গাছ আছে। এর মধ্যে এ বছর প্রায় ৪০ শতাংশ গাছে ফুল আসেনি। তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ায় বেশিরভাগ লিচু নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক লিচু ঝরে পড়ছে, আবার ঝলসেও যাচ্ছে।'

তাপপ্রবাহের কারণে গত কয়েক দিনে তার প্রায় ১ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন সোহেল।

তিনি আরও বলেন, 'শনিবার প্রায় ২৫ হাজার পিস লিচু নিয়ে বাজারে যাই। বিক্রি করতে পারি মাত্র ৬ হাজার। লিচুর আকার ছোট হওয়ায় দাম পাচ্ছি না। প্রতি ১ হাজার পিস বেদানা লিচু ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করছি। মান ভালো হলে এর দাম হতো প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টাকা। আকারে ছোট ও গরমে ক্ষতিগ্রস্ত মাদ্রাজি লিচু বিক্রি হচ্ছে প্রতি হাজার ১৫০০-১৮০০ টাকায়। ভালো মানের লিচু বিক্রি হচ্ছে প্রতি হাজার ২২০০-৩০০০ টাকায়।'

বিরল উপজেলার চাষি মোজাম্মেল হক ডেইলি স্টারকে জানান, মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় এ বছর লিচুর ফলন কম হয়েছে। লিচুর আকারও তেমন ভালো হয়নি। এপ্রিলের শেষদিকে তাপমাত্রাও বেশি ছিল। মের মাঝামাঝি থেকে দাবদাহ শুরু হওয়ায় লিচু নষ্ট হচ্ছে।

দিনাজপুর উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের বিশেষজ্ঞ ইমরুল আহসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এমন আবহাওয়ায় লিচু ভালো না হওয়ায় এখন বিক্রি কম। তীব্র গরমে লিচু হিট ইনজুরিতে আক্রান্ত হচ্ছে।'

তাপপ্রবাহের সময় বাগানে হালকাভাবে পানি স্প্রে করার পরামর্শ দিয়ে তিনি জানান, এ ছাড়াও ছত্রাকনাশক রাসায়নিক ব্যবহার করা যেতে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর দিনাজপুরে সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে লিচু উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৪৫ হাজার মেট্রিক টন।

গরমে নষ্ট হচ্ছে লিচু
তাপদাহে নষ্ট হওয়ায় দিনাজপুরের বাজারে লিচুর ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না। ছবি: কংকন কর্মকার/স্টার

দেশে ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে বার্ষিক লিচু উৎপাদন হয় প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন। সাধারণত সবার আগে মাদ্রাজি জাতের লিচু বাজারে আসে।

এরপর বেদানা, চায়না-১, ২ ও ৩ ও বোম্বাইসহ অন্যান্য জাতের লিচু ধীরে ধীরে বাজারে আসতে শুরু করে। এবার তাপদাহের জন্য চাষিরা সব লিচু একসঙ্গে বাজারে আনায় এগুলোর সরবরাহ বেড়েছে।

তীব্র খরায় গাছেই ফেটে যাচ্ছে লিচু

এদিকে, ভালো ফলন হলেও তীব্র খরার কারণে এ বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্বাঞ্চলের ১ হাজারেরও বেশি বাগানের লিচু গাছেই ফেটে গেছে।

চাষিরা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, গত বৈশাখ ও চলতি জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম দিকে বৃষ্টি না হওয়ায় এ বছর লিচুর আকার বেশি বড় হয়নি। স্বাভাবিক রঙ ধরার আগেই লিচু ফেটে যাওয়ার পাশাপাশি এর মিষ্টি স্বাদের ঘাটতি হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার একাধিক লিচু চাষি ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব সমস্যার কারণে লিচু চাষিরা অনেকটা কাঁচা অবস্থায় লিচু বাজারজাত করেছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার বিজয়নগর, আখাউড়া ও কসবা উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে লিচুর আবাদ হয়। এসব এলাকার অনেক বাড়ির আঙিনায় ও আশপাশের ভিটায় লিচুর চাষ করা হয়।

গরমে নষ্ট হচ্ছে লিচু
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার সেজামুড়া গ্রামে গরমে নষ্ট হচ্ছে লিচু। ছবি: মাসুক হৃদয়/স্টার

বিজয়নগর উপজেলায় এবার ৪৩০ হেক্টরে লিচু চাষ হয়েছে। গত বছর এ উপজেলায় ৪১৪ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ করা হয়েছিল।

এখানকার লিচুর মধ্যে বোম্বাই, পাটনাই ও চায়না থ্রি উল্লেখযোগ্য।

জানা গেছে, ২০০২ সাল থেকে বিজয়নগর উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে লিচুর আবাদ শুরু হয়। কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় এখানকার ধানের জমিকে লিচু বাগানে পরিণত করতে থাকেন চাষিরা।

পাহাড়পুর ইউনিয়নের বাগান মালিক ও স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলী আকবর ডেইলি স্টারকে জানান, এ বছর তিনি ৫ বিঘা জমিতে লিচু চাষ করেছেন।

তিনি বলেন, 'সময় মতো বৃষ্টি না হওয়ায় স্বাভাবিক রঙ ধরার আগেই বোম্বাই জাতের লিচু গাছেই ফেটে গেছে। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এবার লিচুর আকার ও স্বাদে পরিবর্তন এসেছে।'

একই এলাকার কচুয়ামোড়া গ্রামের লিচু চাষি রুনা আক্তার বলেন, '২ বিঘা জমিতে ২৫টির মতো লিচু গাছ আছে। বৈশাখে প্রচণ্ড দাবদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে লিচুর দানা পরিপুষ্ট হয়নি। লিচুতে টক স্বাদ বেশি হয়েছে।'

প্রায় ৮ বিঘা জমিতে লিচুবাগান তৈরি করেছেন সেজামোড়া গ্রামের শরীফ ভূঁইয়া। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর বাগানিদের ভিটামিন ও কীটনাশক বেশি স্প্রে করতে হয়েছে। গাছে মুকুল ধরার সময় থেকেই আবহাওয়া বৈরী ছিল‌। রোগ-বালাই ও ফেটে যাওয়া থেকে লিচুকে রক্ষা করতে কৃষকরা বেশি পরিমাণে স্প্রে করেছেন।'

পাহাড়পুর ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুরো উপজেলার প্রায় ৯০০ লিচু বাগানের মধ্যে‌ ৫০০টির বেশি বাগান এই ইউনিয়নে। এ এলাকায় বোম্বাই জাতের লিচু বেশি চাষ হয়েছে। এ জাতের লিচুতেই ফেটে যাওয়া রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যায়।'

তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে খরা চলতে থাকলে লিচু বাগানের মাটিতে বোরন ও ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দেয়। ফলের বাইরের খোসাও শক্ত হয়ে যায়। ফলের ভেতরের অংশের সঙ্গে তা সুষমভাবে দ্রুত বাড়তে না পারার কারণে লিচুর খোসা ফেটে যায় এবং ফেটে যাওয়া জায়গায় রোগ-জীবাণুর আক্রমণ হয়।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

8h ago