গাছে গাছে মুকুলের সমারোহ, লিচুর বাম্পার ফলনের প্রত্যাশা
দিনাজপুরের সঙ্গে লিচুর সম্পর্ক সুগভীর। এক সময় দিনাজপুরের লিচুর খ্যাতি ছিল সারা দেশে। সময়ের পরিক্রমায় এই মৌসুমি ফলের অন্যতম উৎপাদনস্থল হিসেবে খ্যাতি পাচ্ছে উত্তরের অপর জেলা পাবনাও। দিনাজপুরকে যদি লিচুর 'পুরোনো রাজধানী' হিসেবে সম্মান দেওয়া হয় তবে 'নতুন রাজধানী'র তকমা পাচ্ছে পাবনা।
এবার এই দুই জেলায় গাছে গাছে মুকুলের সমারোহ হওয়ায় লিচুর বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষকরা। এই প্রতিবেদনে দিনাজপুর ও পাবনার লিচু বাগানের চিত্র তুলে ধরা হলো।
দিনাজপুর
লিচু বাজারে পেতে অন্তত আরও দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর শীতের তীব্রতা বেশি হওয়ায় গাছে ফুল আসতে একটু দেরি হয়।
জেলার কৃষকরা জানিয়েছেন, সাধারণত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে মুকুল আসা শুরু হলেও এ বছর তা আসতে শুরু করে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে।
এ বছর দিনাজপুরে লিচুর চাষে জমির পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার ৬৯০ হেক্টর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আরও জানান, জেলায় লিচুর বাগানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। অন্যান্য ফসলের তুলনায় লাভজনক হওয়ায় অনেকে বাণিজ্যিকভাবে লিচু চাষে আগ্রহী হওয়ায় প্রতি বছর জমির পরিমাণ বাড়ছে।
এ বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ৪৫ হাজার টন লিচু উৎপাদনের আশা করছে।
বাণিজ্যিক উৎপাদনের পাশাপাশি এখানে বেশ কয়েক হাজার পরিবারের লিচু গাছ আছে যা প্রতি বছর লিচু উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
দিনাজপুরের অন্যতম ব্র্যান্ডিং ফসল লিচু সাধারণত দিনাজপুরের ১৩ উপজেলায় চাষ হয়। তবে দিনাজপুর সদর ও বিরল উপজেলার লিচু সবচেয়ে সুস্বাদু। আকার ও রঙও আকর্ষণীয়। সবচেয়ে ভালো লিচু হয় সদর উপজেলার মাশিমপুর এলাকায় ও বিরলের মাধবতীতে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার লিচু গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরা। বেশি ফুল আসায় এ বছর কৃষকরা বেশি ফলনের আশা করছেন।
দিনাজপুর সদর উপজেলার মাশিমপুর গ্রামের লিচু চাষি জিয়াউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর আবহাওয়া এখনো ফলনের অনুকূলে। আগামী দুই মাস যদি আবহাওয়া ভালো থাকে, তাহলে লিচু উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।'
জেলার হাকিমপুর উপজেলার লিচু চাষি আশরাফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার তিন বিঘা লিচু বাগানের সব গাছে প্রচুর ফুল এসেছে। পরপর দুই বছর ফুল কম আসায় আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়নি। লোকসান গুণতে হয়েছিল।'
'আশা করছি, এ বছর ভালো মুনাফা হবে। লোকসান পুষিয়ে নিতে পারব', যোগ করেন তিনি।
এ ছাড়াও, আগের বছরের তুলনায় এ বছর ফুল থেকে গুটিতে রূপান্তরের সময় ঝরে পড়ার হারও অনেক কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাশিমপুর গ্রামের অপর কৃষক গোলাম মোস্তফা ডেইলি স্টারকে জানান, এখন পর্যন্ত আবহাওয়া যেমন আছে তেমন থাকলে এ বছর সবচেয়ে ভালো ফলন পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। মে মাসের শেষ থেকে লিচু তোলা শুরু হবে বলেও জানান তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কৃষকরা জানিয়েছেন—দিনাজপুরে মাদ্রাজি, বোম্বাই, বেদানা, চায়না-১, ২ ও ৩, কাঁঠালি ও হড়িয়াসহ অন্য কয়েকটি জাতের লিচু চাষ হয়। এর মধ্যে মাদ্রাজি জাতের লিচু সবার আগে বাজারে আসে।
রঙ, স্বাদ, পরিমাণ ও ছোট বীজের জন্য বেদানা ও চায়না জাতের লিচুর চাহিদা অনেক।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লিচু গাছে প্রচুর ফুল এসেছে। এখন পর্যন্ত যে অবস্থা তাতে চাষিরা ভালো ফলনের আশা করছেন।'
জেলায় উৎপাদিত লিচুর প্রত্যাশিত বাজারমূল্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন তিনি।
পাবনা
শুধু ঈশ্বরদী নয়, পুরো পাবনা জেলার প্রতিটি লিচু বাগানেই পর্যাপ্ত মুকুল দেখা দেওয়ায় এ বছর আশানুরূপ লিচুর উৎপাদন আশা করছেন লিচু চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে পাবনার কয়েকটি লিচু বাগান ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাগানের বেশিরভাগ গাছেই এ বছর লিচুর মুকুল শোভা পাচ্ছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রচুর মুকুল এসেছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাহাপুর গ্রামের লিচু চাষি মিরাজুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লিচুর মুকুল আসার সময় তাপমাত্রা বেশি থাকলে সেগুলো শুকিয়ে ঝরে যায়। এ বছর চৈত্রের শুরুতে খুব একটা খরার প্রকোপ না থাকায় মুকুল গুটিতে পরিণত হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'নিজের আর কেনা বাগান নিয়ে প্রায় দুই শ লিচু গাছের পরিচর্যা করছি। প্রায় ৮০ শতাংশ গাছে অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি মুকুল এসেছে। সাধারণ দেশি জাতের একটি গাছ থেকে সাত-আট হাজার লিচু পাব বলে আশা করছি।'
কয়েকটি গাছে আগাম মুকুল আসায় চৈত্রের শুরুতে লিচুর গুটি বের হয়। সে সময় তিন দিন বৃষ্টির কারণে গুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।
একই এলাকার লিচু চাষি রাকিব উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় এক শ লিচু গাছের বাগান আছে। বেশিরভাগ গাছেই এবার আগের বছরের তুলনায় বেশি মুকুল আসায় আশা করছি, উন্নত জাতের প্রতি গাছ থেকে ১২-১৫ হাজার লিচু পাওয়া যাবে।'
গত বছর গাছপ্রতি আট থেকে ১০ হাজারের বেশি লিচু পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তিনি জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার লিচুর উৎপাদন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হবে।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় চার হাজার ৭২১ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। শুধু ঈশ্বরদীতেই লিচু চাষ হয়েছে তিন হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে।
কৃষি বিভাগ এ বছর পাবনায় লিচুর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৪৮ হাজার ৮০১ টন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উন্নয়ন শাখার কর্মকর্তা মো. শাহ আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রতিটি গাছেই অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি লিচুর মুকুল এসেছে। লিচুর ফলন হওয়ার সময় বড় ধরনের ঝড় না হলে এ বছর উৎপাদন গত বছরের তুলনায় কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।
লিচুর বাম্পার ফলন আশা করলেও চাষিরা দুশ্চিন্তায় আছেন কালবৈশাখী নিয়ে।
লিচু চাষি মেহেদি হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি বছর ঝড়ের কারণে লিচুর অনেক ক্ষতি হয়। ফলে চাষি ও ব্যবসায়ীদের এখন প্রকৃতির দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে।'
ব্যবসায়ীরা জানান, মুকুলের সমারোহ থাকায় প্রতিটি লিচু গাছ ভালো দামে আগাম বিক্রি হচ্ছে।
Comments