প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি ও অধরা কৃষিবিমা
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং শেষ। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কৃষকসহ দেশের হাজারও মানুষের মুখে এই রোদ হাসি ফোটাতে পারবে না।
কৃষকদের ফসলের খেত লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড়। ভেসে গেছে মাছের ঘের। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকদের জন্য সিত্রাং ছিল ভয়াবহ এক ঘূর্ণিঝড়। ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন তা ভেবেই দিশেহারা এখন তারা।
গত সোমবার রাতের এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষক সুকেশ রক্ষিত এবং রূপসা উপজেলার চিংড়ি ও মাছ চাষি মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন।
সুকেশ রক্ষিতের আশঙ্কা, তার পেঁপে ও অন্যান্য সবজির যে ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ টাকা।
জুয়েল হোসেনের মাছ ও চিংড়ি ঘের পানিতে ভেসে গেছে। তিনি আশঙ্কা করছেন, প্রায় ৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে তার।
জুয়েল জানেন না এই ক্ষতি তিনি কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন।
কৃষিবিমা না থাকায় এই ২ জনের মতো হাজারো ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক অসহায় হয়ে পড়েছেন।
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষকদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার ও সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরে দেশে কৃষিবিমা চালুর আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু কৃষকদের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো বিমা স্কিম চালু হয়নি।
রাষ্ট্র-পরিচালিত সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি) অবশ্য কৃষিবিমা চালুর একটা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এটিসহ দেশে এখন পর্যন্ত কৃষিবিমা চালুর যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই মূলত পরীক্ষামূলক স্কিমের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত 'বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ইনস্যুরেন্স সিচুয়েশন অ্যানালাইসিস' অনুযায়ী, দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বার্ষিক ক্ষতি গড়ে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার।
এখন পর্যন্ত শুধু গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি (জিডিআইসি) বাণিজ্যিকভাবে শস্য বিমা চালু করেছে।
এছাড়া ২০২১ সাল থেকে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্য বিমার একটি পাইলট স্কিম চলছে। এটি ব্র্যাক এবং সিনজেনটা ফাউন্ডেশনের অংশীদারত্বে এবং সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ মাইক্রোইন্স্যুরেন্স মার্কেট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত হয়।
এই প্রকল্পের অধীনে এসবিসি ও জিডিআইসি কৃষকদের শস্য বিমা পলিসি দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠান দুটি কৃষকদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে বলেও জানিয়েছে।
ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির অধীনে নন-লাইফ বিমার প্রধান মনিরুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই প্রকল্পের আওতায় কৃষকরা খরা, অসময়ের বৃষ্টি এবং নিম্ন ও উচ্চ তাপমাত্রায় ফসলের ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারেন।'
'আমরা ইতোমধ্যে বোরো ও আলু চাষিদের অনেক দাবি নিষ্পত্তি করেছি। কৃষকরা এ বিষয়ে ভালোই সাড়া দিচ্ছেন। দ্রুত দাবি নিষ্পত্তি বিমার প্রসারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার,' বলেন তিনি।
এখানে ব্যবসারও সুযোগ আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'কৃষকরা সহায়তা খোঁজেন। তাদের প্রয়োজন বুঝে তাদের কাছে কার্যকর পলিসি উপস্থাপন করা আমাদের কাজ।'
ওই প্রকল্পের অধীনে ব্র্যাক ২০২১ সালে স্কিম চালুর সময় ৯৬৬ জন কৃষককে বিমা পলিসি দিয়েছিল। এ বছর এর আওতায় কৃষকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৩ জনে।
সংস্থাটি শিগগির ৫০টি শাখার মাধ্যমে চাল, আলু ও সবজিতে শস্য বিমা সুবিধা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে।
মনিরুল হক বলেন, 'প্রয়োজনে আমরা আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা দিয়ে কাজ চালিয়ে যাব।'
তিনি অবশ্য বলেছেন, 'কৃষিবিমা টেকসই করতে কৃষকদের দীর্ঘসময়ের সহযোগী হয়ে থাকা, প্রাথমিক ক্ষতি মেনে নেওয়া, ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়াসহ উদ্ভাবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'
তিনি আরও বলেন, 'দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু-বিমা পলিসি সফল করতে দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা, তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা ও তাদের ওপর বিনিয়োগ করা এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তির জন্য বিনিয়োগ করা উচিত।'
জিডিআইসি ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখ কৃষককে সহায়তা করেছে।
বেসরকারি বিমা কোম্পানিটির ইমপ্যাক্ট বিজনেস টিমের ডেপুটি ভাইস-প্রেসিডেন্ট মো. মারুফ হোসেন ডেইলি স্টারকে জানান, শুধু চলতি বছরেই তারা ১ লাখের বেশি কৃষকের প্রায় ৮ কোটি টাকার দাবি নিষ্পত্তি করেছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা ঝুঁকির কারণগুলোর ওপর ভিত্তি করে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি।'
জিডিআইসি আগামী বছর মৎস্য বিমা চালু করার পরিকল্পনা করছে বলে জানান তিনি।
মারুফ হোসেন অবশ্য জানান যে ঘূর্ণিঝড়ে শস্যের ক্ষতির জন্য তাদের কোনো পলিসি নেই।
এ ধরনের পলিসি চালু করার পেছনের বাধা হিসেবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির তথ্যের অপর্যাপ্ততার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
জিডিআইসি ৪০ বছরের আবহাওয়ার তথ্যের ভিত্তিতে আবহাওয়াভিত্তিক সূচক তৈরি করেছে।
এসবিসির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শস্য বিমা কৃষকদের জন্য উপকারী।
'কৃষকদের সক্ষমতার একটি বিষয় আছে', উল্লেখ করে তিনি এ বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ, ভর্তুকি এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের উচিত সব অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে কৃষিবিমার জন্য নীতিমালা তৈরি করা।
একইসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উচিত ফসল, পশুসম্পদ ও অন্যান্য কৃষি-সম্পর্কিত বিমাকে উৎসাহিত করতে কৃষকদের প্রিমিয়ামের ওপর মূল্য সংযোজন কর মওকুফ করা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কম্বোডিয়া, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়ার ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্সের সোশ্যাল ফাইন্যান্স ফেলো আলী তারেক পারভেজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেসরকারি খাত, বিশেষ করে বিমা কোম্পানিগুলোর এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত।'
তিনি বলেন, 'তারা উদ্যোগ নিলে সরকারও এগিয়ে আসবে। প্রান্তিক মানুষের ক্ষুদ্র বিমার চাহিদা অনেক।'
'মানুষ সমাধান খোঁজে। কিন্তু তারা নিজেরা এটি করতে পারবে না। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এবং এনজিওর একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আছে, যা ক্ষুদ্র ও কৃষি বিমা চালু করার ক্ষেত্রে অনুঘটক হতে পারে,' বলেন আলী তারেক পারভেজ।
যোগাযোগ করা হলে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী ডেইলি স্টারকে জানান, তারা অন্যান্য কোম্পানিকেও কৃষিবিমা চালু করতে উৎসাহিত করছেন।
ঘূর্ণিঝড়ে শস্য ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির শিকার কৃষকদের জন্য বিমার আওতায় আনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ঝুঁকির তীব্রতা মূল্যায়নে গবেষণা প্রয়োজন। তার ওপর ভিত্তি করে কোম্পানিগুলি সিদ্ধান্ত নেবে যে তারা বিমা দেবে কি না। মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।'
শস্য বিমার এসব জটিলতা বোঝেন না কৃষক জুয়েল হোসেন কিংবা সুকেশ রক্ষিতরা। তবে তারা এটা বোঝেন যে বিমা তাদের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে, এবং এই সহযোগিতা তাদের খুবই প্রয়োজন।
Comments