বিশেষ নিবন্ধ

চিরস্মরণীয় আবদুল কাদির কেন কম চেনা

বাঙালি মুসলমানের আত্ম প্রতিষ্ঠার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা যুগান্তকারী এক ঘটনা। যাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয় বাংলাদেশের নবজাগরণ। যারা এই জাগরণের ভরকেন্দ্রে ছিলেন আবদুল কাদির তাদের অন্যতম। বয়সে ছিলেন সবার থেকে কনিষ্ঠ। কিন্তু জ্যেষ্ঠতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রতিভায়, শ্রমে, সাহসিকতায় ও আত্ম নিবেদনে। সমাজ, রাষ্ট্র, জাতি, দেশ নির্মাণে যে সাধনায় নিমগ্ন থাকা লাগে, তাতে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন ইহজাগতিকতা জুড়ে। 'শিখা' গোষ্ঠীর আবদুল কাদিরের প্রচেষ্টায় আমরা পাই প্রথম নজরুল রচনাবলী। এসবের মাঝে সদর্থক অর্থেই জীবনকে তিনি রাঙায়িত করেছেন ইর্ষণীয় সব কাজে, যা জাতিকে দিয়েছে আত্মপ্রতিষ্ঠার দিশা। অথচ তিনি আজও রয়ে গেছেন সর্বজন মাজে 'কম চেনা বড় মানুষ' রূপে। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা পরিস্কার করা যাক।

একজন নাট্যচর্চা করেন, নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, নির্দেশনা-লেখালেখিতেও পরিচিত। পাঠ নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। টিএসসি কেন্দ্রিক একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্তও ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সক্রিয় ও। তিনি কিছুদিন আগে একটা স্ট্যাটাস লিখলেন : 'কবরের নীরবতায় পাঠ করি এপিটাফ। এই কবি সম্পর্কে জানাশোনা নাই। এপিটাফ তার নিজেরই লেখা মনে হয়।' লেখাটির সঙ্গে দিয়েছেন একটা কবরের ফটোগ্রাফ। যাতে লেখা রয়েছে : ''কবি আবদুল কাদির/ জন্ম ১.৬.১৯০৬/ মৃত্যু ১৯.১২.১৯৮৪ 'অজস্র সংকট মাঝে গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ভাবিয়াছি; আমরণ জ্ঞানের অন্বেষা-এ জীবন।/ দেশে দেশে ছিল যারা সত্য-ছন্দ যুগ-যুগান্তর তারা মোর মর্মমূলে দিয়েছে উৎসাহ উৎপ্রেরণ।/ প্রজ্ঞার প্রান্তরে দেখিয়াছি সৌন্দর্যের আনন্দ নির্ঝর অবিরাম বহি চলে বিমোহিয়া উন্নিদ্র নয়ন,/ তারি বোধি বটচ্ছায়ে মরা আসি হয়েছে অমর-ছিল সেই দৈব বর-লভিবারে মম অকিঞ্চন।/ আজি রোগ শয্যাশ্রয়ে নবভাব হয়েছে উদয়, রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে ফুটিয়াছে অন্তিম প্রহরে/ এই বাণী: 'আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন।' বোধ নহে, রূপ নহে, এই পূর্ণ প্রেমের প্রত্যয়/ আমাকেও আকর্ষিছে, সুখ-সুধা শত লীলাভরে দুঃখের সাধনা পাত্রি সিঞ্চিতেছে রস চিরন্তন।/ আবদল কাদির  ১৮.১২.১৯৮৪/ বাড়ী নং ৬/এ সড়ক নং-১৩. গুলশান, ঢাকা।/ কবর নং ১৯০৩''

তিনি আবদুল কাদিরকে চেনেন না। উনার দেয়া স্ট্যাটাস পড়ে মনে হচ্ছে জীবনে কোনদিন নামও শোনেননি। আবদুল কাদির এমন একজন ব্যক্তিত্ব, গুগল সার্চ দিয়ে উনার পরিচয়  কিংবা উনি কে তা জানার প্রয়োজন পড়ে না। উনি অবশ্য চাইলে সার্চ দিয়েও জেনে নিতে পারতেন। কারণ, খুব বেশি বিস্তারিত না হলেও প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার মতো উপাদান ঠিকই রয়েছে। আবদুল কাদির প্রকৃতার্থে বহুমাত্রিক পরিচয়ের ব্যক্তিত্ব তিনি। অগণন কাজ দিয়ে এ জাতিকে ধন্য করেছেন। ঋণী করেছেন। অন্য সব পরিচয়ের কথা যদি উহ্যও রাখা যায়, কেবল নজরুল রচনাবলীর প্রথম সম্পাদক হিসেবে উনি চিরস্মরণীয় একজন। এদেশের বিদ্বৎসমাজের ঘরে ঘরে যে নজরুল রচনাবলী, জাতীয় কবিকে পাঠ, পরিচিতি ও গবেষণার প্রয়োজন মেটাচ্ছে সেই নজরুল রচনাবলীর সম্পাদক ও সংকলক তিনি। সময় পরিক্রমায় ধীমান অনেকেই এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন কিন্তু কারোরই সাধ্যি নেই আবদুল কাদিরের অবদানকে উপেক্ষা করার। অথচ সেই আবদুল কাদিরকেই চেনা হয়ে উঠেনি একজন সংস্কৃতিজনের। এটা মোটেই উনার দোষ বা অপরাধ নয়। এর ভেতর দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে, এ দেশ, এ সময়, এ সমাজ গুণীজনদের চেনার চর্চায় নেই। এতে আবদুল কাদিরের মতো প্রতিভাধর, গুণীজনদের কিছুই যায় আসে না। উনারা এসবের ঊর্ধ্বেও। যায়, আসে আমাদের, যায় আসে বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশের। কেননা যে জাতির সন্তানেরা নিজেদের অতীত জানে না, অতীতের রেনেসাঁ পুরুষদের চেনে না, তারা কোন্ আলোয় বড়ো হয়ে উঠবে? কোন্ প্রেরণায় নিজেদের মহৎ মানুষ তৈরীর তপস্যায় নিমগ্ন হবেন?

'কালের ধ্বনি' পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা হাতে কবিকন্যা অধ্যাপক রোকসানা কাদির। ছবি: ইমরান মাহফুজ

আবদুল কাদিরকে নিয়ে আশিক রেজা ও ইমরান মাহফুজ সম্পাদিত 'কালের ধ্বনি' পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। যার শিরোনাম ছিল 'কম চেনা বড় মানুষ আবদুল কাদির'। এই শিরোনামই রাষ্ট্র করে আবদুল কাদিরকে আমরা কতটুকু চিনেছি। রাষ্ট্রীয়ভাবে উনাকে চেনানোর জন্য আদতে কতটুকু কোশেশ করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কালের ধ্বনির ওই সংখ্যা প্রকাশের পাঁচ বছর পর একজন সংস্কৃতিজন যখন ‍নিজে থেকেই জানান দেন 'আবদুল কাদির' এর নামের সঙ্গেই উনার কোন পরিচয় নেই, তখন বিষয়টা কেবল বেদনার নয়, সামগ্রিকভাবে লজ্জার।

আবদুল কাদিরের কবি প্রতিভা, ছন্দ বিশ্লেষণের ক্ষমতা, সম্পাদকতার সার্থকতা, বাংলা সাহিত্যের গুণী লেখক কবি সাহিত্যিকের রচনাবলী সংকলন ও সম্পাদনা করার দুঁদে সামর্থ্য, এখনও তুলনারহিত উদাহরণ। উনার সবচেয়ে বড়ো অবদান হল 'শিখা' গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ততা এবং নজরুল রচনাবলী সম্পাদন।

'শিখা গোষ্ঠী'র হাত ধরেই বাংলাদেশে, তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে নবজাগরণের সূচনা ঘটে। ঢাকায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে নবজাগরণের শুরু  এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয়। তিন পর্বে সংঘটিত হয় এই নবজাগরণ হল বাংলাদেশের নবজাগরণ। এর প্রথম পর্বের সময়কাল হল ১৯২১ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্ব ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত এবং তৃতীয় পর্ব হল ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত। ঊনবিংশ শতকে সংঘটিত বাংলার নবজাগরণের সঙ্গে বিংশ শতাব্দে সংঘটিত বাংলাদেশের নবজাগরণের বেশকিছু সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলার নবজাগরণে হিন্দু কলেজ যেমন ভূমিকা পালন করেছে। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা তেমন। বাংলাদেশের নবজাগরণ মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং একে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠা লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের সম্মিলিত প্রয়াসে সংঘটিত হয়। ওখানকার ডিরোজিওর ভূমিকা এখানকার আবুল হুসেনের মধ্যে দেখা যায়। দুজনের জীবনরেখা সমাপ্ত হয় একেবারে অল্প বয়সে-অকালে। 

বাংলাদেশের নবজাগরণ বা রেনেসাঁর বিরল বৈশিষ্ট্য হল আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মানবতাবাদ, ইহজাগতিকতা, উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয় কুসংস্কার মুক্তি, আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার চর্চা, ন্যায্যতাভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণ ও সম্পদের সুষম বন্টনের প্রত্যাশা পুরণ। রেনেসাঁ বা নবজাগরণ কীভাবে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো বাংলাদেশের রেনেসাঁ। যেখান উপ্ত হয়েছিল পুরো জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার বীজমন্ত্র। এই রেনেসাঁর শুরু ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। এই সূত্রে সেই সময়ের বিদ্বৎ সমাজের একট বড়ো অংশের এখানে বসবাস ও একত্রিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। যার কল্যাণে ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ'। যার মুখপাত্র ছিল 'শিখা' পত্রিকা। যাদের শ্লোগান ছিল, 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব'। উল্লেখ্য, 'মুসলিম সাহিত্য সমাজে'র আদর্শ ছিল, ইউরোপের নবজাগরণ-ইতালীয় রেনেসাঁ, উনিশ শতকের নবজাগরণ-বঙ্গীয় রেনেসাঁ, তুরস্কের নবজাগরণ কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে সংঘটিত মুসলিম রেনেসাঁ।

'মুসলিম সাহিত্য সমাজে'র নেতৃত্বে ছিলেন আবুল হুসেন। সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন অনেকেই। উল্লেখযোগ্যরা হলেন: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদির, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ আবদুর রশীদ প্রমুখ।

মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক মুখপত্র 'শিখা'র সঙ্গে আবদুল কাদিরের যুক্ততা ও সক্রিয়তা কেমন ছিল তা স্পষ্টাকারে ধরা পড়েছে 'শিখা'র দ্বিতীয় সংখ্যার নিবেদন অংশে। যেখানে বলা হয়েছে, ''এই বৎসরের 'শিখা' প্রকাশ করিতে যাহারা বিশেষ সাহায্য করিয়াছেন তাদের মধ্যে শ্রীমান আবদুল কাদির ও সাহিত্যরত্ন আবদুল মজিদের নাম বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য। ইহারা প্রেসের কাজে, প্রুফ দেখা ইত্যাদি ব্যাপারে বিষে সাহায্য করিয়াছেন। তাহাদের সাহায্য ব্যতিরেকে এবার 'শিখা' প্রকাশ করা অসম্ভব হইত। এজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে ও 'সমাজে'র তরফ হইতে তাঁহাদের নিকট কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি।''

মুসলিম সাহিত্য সমাজ'কে খুব বেশিদিন আলো ছড়াতে দেওয়া হয়নি। ১৯৩৬ সালে সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে ১৯৩৮ সালে। আবুল হুসেনের মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত স্মরণানুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। 'শিখা' পত্রিকার সংখ্যা বেরিয়েছিল পাঁচটি। প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন আবুল হুসেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যার সম্পাদক হন কাজী মোতাহার হোসেন। চতুর্থ ও পঞ্চম সংখ্যায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে মোহাম্মদ আবদুর রশীদ ও আবুল ফজল।

ঢাকার রেনেসাঁ কতোটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ও ধর্মের ধ্বজাধারী কূপণ্ডুকদের ধাক্কা দিতে পেরেছিল তা আবুল হুসেনের ওপর নেমে আসা খড়গ থেকেই বোঝা যায়। চার্চের কাছে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও হয়ে উঠেছিলেন যেমন, 'মুসলিম সাহিত্য সমাজে'র বিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে তিনিও হয়ে উঠেছিলেন ঠিক তেমনই।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আত্মপ্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' ত্রিমুখী ষড়যন্ত্র ও আক্রমনের শিকার হন। 
এরা হলো :
এক. ঢাকার আশরাফতন্ত্রী আলেম সমাজ
দুই. ঢাকার নবাব পরিবার
তিন. কলকাতার 'মোহাম্মদী' পত্রিকা গোষ্ঠী।

আবুল হুসেন একটা লেখায় সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে চাকরি সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছিলেন। সাপ্তাহিক 'মোহাম্মদী'তে গোলাম মোস্তফা ওই লেখার তীব্র সমালোচনা করেন, যা ব্যক্তিগত আক্রমনের পর্যায়ে পড়ে এবং অশোভন ও আপত্তিকর হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। তিনি বলেন, মুসলমানদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকার কারণেই আবুল হুসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন। এতে ভীষণ অপমান বোধ করেন আবুল হুসেন এবং শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে আইন ব্যবসায় যোগ দেন।

মাসিক 'মোহাম্মদী' পত্রিকার পরপর চারটি সংখ্যায় কাজী আবদুল ওদুদের লেখা নিয়ে আক্রমনাত্মক সমালোচনা করেন মাওলানা আকরম খাঁ। এই বিতর্কের ইতি টানতে কাজী আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেন পৃথক 'ঘোষণাপত্র' দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে 'মুসলিম সাহিত্য সমাজে'র সভা বন্ধ পর্যন্ত করে দেয়া হয়। বাধ্য হয়ে পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হয় জগন্নাথ ও লিটন হলে।

আবুল হুসেন এর ওপর ক্ষিপ্ত ও বিরাগ হওয়ার নেপথ্যের কারণ বুঝতে 'মুসলিম সাহিত্য সমাজে'র দফাগুলোর দিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের ১৯২৯ সালের তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশন শেষে গ্রহণ করা হয়েছিল সমাজ সংস্কারের পাঁচ দফা প্রস্তাব :

এক. এই সভা বাংলার মুসলমান নর-নারীকে বিশেষভাবে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত বাঙ্গালীকে কোরানের সহিত পরিচিত হইবার অনুরোধ জানাইতেছে।
দুই. এই সভা বাংলার পল্লীর বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠাগার ও গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠায় বিশেষভাবে উদ্যোগী হইবার জন্য দেশের কর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানাইতেছে।
তিন. এই সভা বাংলার বিভিন্ন মক্তব ও মাদ্রাসায় যাহাতে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যায়াম শিক্ষার ব্যবস্থা হয় তজ্জন্য গভর্নমেন্টকে অনুরোধ জানাইতেছে।
চার. এই সভা বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের নেতৃবৃন্দকে পর্দাপ্রথা দূরীকরণার্থে আদর্শ স্থাপন করিতে অনুরোধ জানাইতেছে।
পাঁচ. এই সভা সাহিত্য সমাজের কর্মীবৃন্দকে মুসলিম ইতিহাস, দর্শন ও ধর্মবিষয়ক আরবী ও ফার্সি গ্রন্থ সমূহ অনুবাদ করিবার জন্য একটি অনুবাদ কমিটি গঠন করিতে অনুরোধ জানাইতেছে।

উল্লিখিত দফাসমূহেই স্পষ্ট হয় যে, 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' কতোটা প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক ছিল। শুধু দফা দিয়েই তারা আলোকিত সমাজ গঠণের দায়িত্ব শেষ করেন নাই। লেখালেখি করেছেন এইসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন করার নিমিত্তে।

মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র 'শিখা' সম্পর্কে আবুল ফজল বলেছেন, 'শিখার টাইটেল পৃষ্ঠায় একটি ক্ষুদ্র রেখাচিত্র ছিল, শুনেছি তা-ও এঁকেছিলেন আবুল হুসেন সাহেব। একটি খোলা কোরান শরিফ-মানব বুদ্ধির আলোর স্পর্শে কোরানের বাণী প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে, এই ছিল রেখাচিত্রটির মর্ম। কিন্তু এর একটা কদর্থ বের করতে বিরুদ্ধবাদীদের বেগ পেতে হয়নি। তারা এর অর্থ রটালেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের সমর্থকরা কোরানকে পুড়িয়ে ফেলে শুধু মানব বুদ্ধিকেই দাঁড় করাতে চাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, গোড়া থেকেই গোঁড়ারা মুসলিম সাহিত্য সমাজের বিরোধী ছিল।'

বলা প্রয়োজন, কেবল মুসলিমরাই 'মুসলিম সাহিত্য সমাজের সভ্য ছিলেন এমন নয়। কবি মোহিতলাল মজুমদার, ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো বহু অমুসলিম মনীষী সভায় অংশ নিতেন এবং তাদের মুখপত্র 'শিখা'য় লিখতেন।

'মুসলিম সাহিত্য সমাজে'র প্রাণ ছিলেন আবুল হুসেন। শুধু বৌদ্ধিকভাবে নয়, আর্থিকভাবেও। 'শিখা' পত্রিকা প্রকাশের পুরো ব্যয়ভার বহন করতেন নিজে। ফলে, অনেকেরই জানা ছিল যে, আবুল হুসেনকে কোনোভাবে পর্যুদস্ত কিংবা বাধাগ্রস্ত করতে পারলেই 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' ও তার 'শিখা'কে নিভিয়ে দেয়া সম্ভব হবে। এলক্ষ্যে তাদের সকল ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটায় ঢাকার নবাব পরিবারের সভ্যরা।

১৯২৯ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার নবাব বাড়িতে আবুল হুসেনকে নিয়ে বসেছিল এক সভা। যার সমাপ্তি ঘটে এভাবে-নবাব হাবিবুল্লাহ ঘোষণা দেন, 'আপনি (আবুল হুসেন) জীবনে আর কখনো কিছু লিখবেন না- এই শর্তে মুচলেকা লিখে দিন, তবেই আপনার দণ্ড শিথিল হতে পারে বা আপনাকে ক্ষমা করা যেতে পারে।' উত্তরে আবুল হুসেন বলেন, 'আমি ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কিছু লিখব না, কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে লিখব-এই শর্তে আমাকে মুক্তি দেওয়া হেক।' ক্ষমাপত্র লিখে দেয়ার বিনিময়ে ভোর রাত সাড়ে চারটায় আবুল হুসেনকে ছেড়ে দেয়া হয়।'

ঢাকার রেনেসাঁর প্রধান পুরুষ আবুল হুসেনকে এভাবেই সরিয়ে দেয়া হয়, প্রকারান্তরে ঠেলে দেয়া হয় মৃত্যুর দিকে। গ্যালিলিওকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। আবুল হুসেনকে করা হলো দেশান্তরী। ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আবুল হুসেনকে এমন ব্যবস্থার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো যাতে মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। এই ঘটনার এক দশকের মধ্যেই মারা যান তিনি। 'মুসলিম সাহিত্য সমাজে'র সবচেয়ে প্রতিভাবান, সবচেয়ে কর্মঠ, সবচেয়ে সুঠাম দেহের অধিকারী মানুষটাই মারা যান সবার আগে। যদিও স্বল্পায়ুর জীবনেই ঢাকার রেনেসাঁয় যে দীপশিখা তিনি জ্বালিয়ে যান, তা কখনোই নিভে যাওয়ার নয়।

মুসলিম সাহিত্য সমাজের ওপরে নেমে আসা এই খড়গের পরও আবদুল কাদির মুসলিম সাহিত্য সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন সংশয় বোধ করেননি। শেষ সময়েও তিনি এঁদের সঙ্গে ছিলেন। শিখা গোষ্ঠীর সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন তিনি। ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। অথচ 'শিখা'র প্রথম সংখ্যাতেই উনার নাম প্রকাশক হিসেবে ছাপা হয়েছে। দ্বিতীয় সংখ্যাতে উনার অবদান ও সম্পৃক্ততাকে নিবেদন অংশে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসবেই বোঝা যায়, আবদুল কাদির প্রগতিপন্থায় ও দেশ-জাতির জন্য সবিশেষ কল্যাণমূলক কাজে কতোটা নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পরে এসে এখন গবেষণায় স্পষ্ট হচ্ছে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড়ো অবদান হলে একে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশের নবজাগরণ। এবং সেই নবজাগরণে সলতে পাকানোর কাজ যারা করেছিলেন তাদের অন্যতম হলেন আবদুল কাদির।

বাঙালি জাতির নবজাগরণে কিংবদন্তীতুল্য ভূমিকা পালনকারীকে না চেনাটা কোন ব্যক্তির জন্য বিশেষ কোন দোষের না হলেও পুরো জাতির জন্য সবিশেষ বেদনা ও লজ্জার। এর ভেতর দিয়ে প্রতীয়মান হয় পুরো জাতির সঙ্গে তার কীর্তিমান ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কের খাসলত কেমন এবং কোন সুতোয় বাঁধা।

আবদুল কাদির 'শিখা' গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ততার সুবাদে সেই সদ্য তরুণ বয়সে দেশ জাতি রাষ্ট্র সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে সদর্থক ভূমিকা পালন করার যে ব্রত নিয়েছিলেন তা আমৃত্যু ধারণ করেছিলেন। এক জীবনে নানা সময়তরঙ্গ পাড়ি দিয়েছেন, কিন্তু পণভঙ্গ হননি। বৃন্ত বা পথচ্যুত হননি কখনোই। 'শিখা' গোষ্ঠীর আবুদল কাদিরকেই আমরা খুঁজে পাই 'নজরুল রচনাবলী'র সম্পাদকরূপে। সেই নজরুল 'শিখা' গোষ্ঠীর কালে যাকে এই সমাজের কিছু মানুষ দিয়েছিল কাফের ফতোয়া। মুসলিম সাহিত্য সমাজের অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে নজরুল এ কারণেই বলেছিলেন, 'আজ আমি দেখছি এখানে মুসলমানের নতুন অভিযান শুরু হয়েছে। আমি এই বার্তা চতুর্দিকে ঘোষণা করে বেড়াব। আর একটা কথা- এতদিন আমি মনে করতাম আমি একাই কাফের, কিন্তু আজ দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম যে, মৌলভী আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ কতগুলি গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে, এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আর আমি চাই না।'

আবদুল কাদির নজরুল প্রতিভা বিকাশের ঊষালগ্নে-মধ্যগগণে থাকা অবস্থায় যেমন উনার সঙ্গ, সংশ্রব, পৃষ্ঠপোষণা ও সতীর্থতা ত্যাগ করেননি। নজরুল যখন নীরব, কেবলই দেহসর্বস্ব তখনও ছেড়ে যাননি, এমনকি মৃত্যুর পরও না। এ কারণেই আবদুল কাদিরের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে নজরুলের মতো বাউন্ডুলে এক প্রতিভার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রচনা সমূহকে রচনাবলীর মলাটে বাঁধার মতো কঠিন কাজটা যথাযথভাবে সম্পাদন করা। এ কাজ কেবল প্রেম ও সাধনাতেই সম্ভব, যা আবদুল কাদিরের শোণিত প্রবাহে শতভাগ ছিল। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শুধু 'নজরুল রচনাবলী' সম্পাদনা নয়, নজরুলকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চর্চায় এবং নজরুলকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণে যারা সর্বাগ্রে স্বপ্ন দেখেছিলেন-নানামুখী চেষ্টায় নিমগ্ন হয়েছিলেন তাদেরও অন্যতম হলেন আবদুল কাদির।

সময় পরিক্রমায় নজরুল চর্চা নানাভাবে প্রসারিত হয়েছে। নজরুল আমাদের জাতীয়  কবি, নজরুলের নামে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,সরকারীভাবে ইনস্টিটিউট করা হয়েছে, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুলের নামে হল রয়েছে। স্কুল-কলেজ থেকে উচ্চতর শিক্ষায় নজরুল এখন অবশ্য পাঠ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে নজরুল চেয়ার। কিন্তু সেসবই যে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোয় পরিণত হয়েছে তা বুঝতে- গবেষণার প্রয়োজন হয় না। সেসব যতোটা কাগজ-কলমে, কাঠামোসর্বস্বতায় মোড়ানো ততটা যে প্রয়োজনে নয় তার একটা নিরাভরণ উদাহরণ হল ওই সংস্কৃতিজনের স্ট্যাটাসটা। যে নজরুলকে চেনা, জানায় অনেকখানি সহায়ক হলেন আবদুল কাদির। যার অবদান 'নজরুল রচনাবলী' নজরুলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রচনাসমূহকে মলাটবন্দী করে আমাদের হস্তগত হয়েছে, তাকেই আমরা ভুলে গেছি। অথচ তার বদৌলতে নজরুলকে চেনা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে প্রায় এক দশক আগে বাংলা একাডেমির প্রযত্নে আবদুল কাদির গবেষণা কেন্দ্র  খুললেও আবদুল কাদিরকে নিয়ে কোন প্রকাশনা চোখে পড়েনি। বরং আবদুল কাদির রচনাবলী প্রকাশের উদ্যাগ একাধিকবার নিলেও আলোর মুখ দেখেনি আজও।

মনে রাখতে হবে, আবদুল কাদিরকে ছাড়া বাংলাদেশের নবজাগরণের পাঠ যেমন পূর্ণ হয় না তেমনি নজরুল পাঠ-গবেষণা-অধ্যাবসায়সহ সকল প্রয়াস ও প্রচেষ্টাও অপূর্ণাঙ্গ থাকে। উনাকে না চেনার অর্থ নিজেদের শূন্যতাকে মান্যতা দেয়া, যা এখনও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। প্রতিষ্ঠানের কাঠামো যেমন বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা। প্রশ্ন হল বুদ্ধিবৃত্তিক শুন্যতার এই দায় কি আমাদের নজরুলকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এড়াতে পারবে?

Comments

The Daily Star  | English

Grim discovery: Five bodies found on vessel in Meghna

The incident had occurred on the Meghna river under Chandpur Sadar upazila in an area adjacent to Shariatpur

2h ago