অতি নাটকীয়ভাবে ম্যাচ জিতে সিরিজ বাংলাদেশের

রোববার চেমসফোর্ডে অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ খুইয়ে বাংলাদেশের কাছে হেরেছে আইরিশরা। আয়ারল্যান্ডকে ৫ রানে হারিয়ে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ নিশ্চিত করেছে তামিম ইকবালের দল।
Bangladesh cricket team

৫০ বলে দরকার ছিল ৫০ রান, হাতে ৭ উইকেট। দাপট দেখিয়ে ব্যাট করছিলেন হ্যারি টেক্টর আর লোরকান টাকার।  ম্যাচ তখন পুরোপুরি আয়ারল্যান্ডের মুঠোয়। এই ম্যাচই কিনা শেষ পর্যন্ত বদলে গেল। তাও নাজমুল হোসেন শান্তর বলে! অনিয়মিত বোলার হিসেবে এসে শান্ত হ্যারি টেক্টরকে ফেরানোর পর মোস্তাফিজুর রহমান এসে জোড়া আঘাত হানেন, শেষ ওভারে নেন আরেক উইকেট। তার স্পেলে বদলে যায় পরিস্থিতি। মার্ক অ্যাডায়ার এসে মিনি ঝড় তুলে ফের উত্তেজনা ফেরালেও আর পেরে উঠেনি আইরিশরা।

রোববার চেমসফোর্ডে অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ খুইয়ে বাংলাদেশের কাছে হেরেছে আইরিশরা। আয়ারল্যান্ডকে ৪ রানে হারিয়ে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ নিশ্চিত করেছে তামিম ইকবালের দল।

বাংলাদেশের করা ২৭৪ রানের জবাবে ২ উইকেটে ২২৫ থেকে ২৭০ রানে থেমেছে আয়ারল্যান্ড। বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতানোয় বড় ভূমিকা মোস্তাফিজের। ১০ ওভার বল করে ৪৪ রানে ৪ উইকেট নিয়েছেন তিনি।

শেষ দুই ওভারে যখন দরকার ২৪ রান তখন আবার নাটক। অ্যাডায়ারের ঝড়ে (১০ বলে ২০) মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ৪৯তম ওভারে এলো ১৪ রান। শেষ ওভারে চাই ১০ রান।  অ্যাডায়ার অতি আত্মবিশ্বাসী হয়েই পুড়লেন। হাসান মাহমুদকে স্কুপ করতে গিয়ে বোল্ড হলেন। খেলা তখনই প্রায় শেষ। অ্যান্ডি ম্যাকব্রেইন আর সমীকরণ মেলাতে পারলেন না।

 

এই ম্যাচে বাংলাদেশের একক কোন নায়ক খুঁজে বের করা মুশকিল। মূলত সম্মিলিত অবদান আর স্নায়ু ধরে রাখার ফল পেয়েছে স্বাগতিকরা। ব্যাট হাতে ৮২ বলে দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৬৯ রান করেন তামিম। তবে মুশফিকুর রহিম ৫৪ বলে ৪৫, শান্তর ৩২ বলে ৩৫, লিটন দাসের ৩৯ বলে ৩৫, মিরাজের ৩৯ বলে ৩৭ রানের অবদান আছে। বোলিংয়ে মোস্তাফিজ ৪ উইকেট নিলেও হাসান, ইবাদত, মিরাজরা রাখেন বড় ভূমিকা।

২৭৫ রান তাড়ায় সতর্ক শুরুর মাঝে ৬ষ্ঠ ওভারেই প্রথম উইকেট হারায় আয়ারল্যান্ড। পুরো সিরিজে ব্যর্থ স্টিফেন ডোহানি আবারও নিজেকে প্রমাণে ব্যর্থ। মোস্তাফিজের অ্যাঙ্গেলে বেরিয়ে যাওয়া বলে খোঁচা মেরে এই ডানহাতি ক্যাচ দেন স্লিপে লিটনের হাতে।

১৭ রানে প্রথম উইকেট হারানোর পর প্রতিরোধ গড়েন দলের দুই অভিজ্ঞ স্টার্লিং আর বালবার্নি। দুজনেই শুরু দেখেশুনে খেলেছেন।

স্টার্লিং অবশ্য খোলস ছেড়ে বেরুতে দেরি করেননি। বালবার্নি আলগা বল না পেলে বিলাসী শটের দিকে পা বাড়াচ্ছিলেন না। শুরুর সময়টায় নতুন বলের শাইন নষ্ট করতে যেন টিকে থাকার দিকে মন দেন তারা।

স্টার্লিং জায়গা বের করে রান খোঁজ করেছেন। ৫৮ বলে ফিফটি স্পর্শের পথে মেরেছেন দুই ছক্কা। অনেকটা সময় নিয়ে ফিফটি করেন বালবার্নি। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে শক্ত ভিত পেয়ে যায় আইরিশরা। দুজনে মিলে সময় নিলেও ১২৫ বলে তুলেন ১০৯ রান।

এই জুটি আরও বিপদজনক দিকে মোড় দিতেই আঘাত হানলেন ইবাদত। শুরু থেকে আঁটসাঁট বল করে আইরিশদের উপর চাপ জারি রেখে উইকেটের দেখা পেয়েছেন তিনি।

একই ভূমিকা নেন মিরাজও। একমাত্র স্পিনার হিসেবে খেলে দলের ভরসা হন রান আটকে রেখে। পরে নিজের ৬ষ্ঠ ওভারে পান স্টার্লিংয়ের উইকেট। আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটার ফিফটির পর আর বেশি দূর এগুতে পারেননি। মিরাজের বলে শর্ট থার্ডম্যানে ক্যাচ দিয়ে ৬০ রানে বিদায় নেন তিনি।

পর পর দুই থিতু ব্যাটারকে হারিয়ে চাপ বাড়লেও তা প্রবল হতে দেননি টেক্টর-টাকার। আইরিশ ক্রিকেটের আগামীর দুই বড় ভরসা দ্রুতই নিয়ে নেন নিয়ন্ত্রণ। আগ্রাসী অ্যাপ্রোচে খেলার ছবি বদলে দিতে থাকেন তারা।

চতুর্থ উইকেটে দুজনে খেলার উত্তেজনা মাটি করে দিচ্ছিলেন। এই নিয়মিত বোলাররা যখন তাদের টলাতে পারছিলেন না তখন নাজমুল হোসেন শান্তর হাতে বল তুলে দেন তামিম। এরপর ম্যাজিকের মতন যেন বদলে গেল সব।

শান্তর অফ স্পিনে উচ্চবিলাসী শটের নেশায় ভুল করে বসেন টেক্টর। ওয়াইড লং অনে তার ক্যাচ বা দিকে ঝাঁপিয়ে দারুণ দক্ষতায় হাতে জমান লিটন। ৪৮ বলে ৪৫ করে থামেন টেক্টর। এই আউটে ভেঙে যায় ৬৫ বলে ৭৯ রানের জুটি।

যদিও ম্যাচ জিততে তখন শেষ ৮ ওভারে কেবল ৪৯ রান চাই আইরিশদের। কিন্তু নাটক যেন তখনো বাকি। প্রথম দুই ম্যাচ একাদশের বাইরে থাকা মোস্তাফিজ ম্যাজিক নিয়ে হাজির। পর পর দুই ওভারে তিনি ফিরিয়ে দিলেন ক্যাম্ফার আর ডকরলকে। ক্যাম্ফার একদম অপ্রয়োজনীয় বাজে শটে দিয়েছেন আত্মাহুতি। ডকরলেন জায়গা বানিয়ে মারতে গিয়ে বদলি ফিল্ডার ইয়াসির আলির দারুণ ক্যাচে পরিণত হন।

৩ উইকেটে ২২৫ থেকে ২৩৬ রানে যেতে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে স্বাগতিকরা। ম্যাচে তখন শক্তভাবেই ফিরে এসেছে বাংলাদেশ। মোস্তাফিজ তার শেষ ওভারে তুলে নেন আয়ারল্যান্ডের শেষ ভরসা টাকারকেও। ৫৩ বলে ৫০ রান করা টাকার স্কুপ করতে গিয়ে হয়ে যান বোল্ড। শেষ দিকে অ্যাডায়ার ছোট্ট ঝড়ে তামিমদের বুকে ভয় ধরালেও কাজটা সারতে পারেননি।

আগের ম্যাচ যে উইকেটে হয়েছিল, একই উইকেটে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে ভোগান্তিতে পড়ে বাংলাদেশ। সাকিব আল হাসানের চোটে অভিষেক করানো হয় রনি তালুকদারকে। তিনি ওপেনার হওয়ায় মিডল অর্ডারে লিটনকে পাঠিয়ে তাকে নামানো হয় তামিমের সঙ্গী হিসেবে।

এই কৌশল কাজে দেয়নি। অভিষিক্ত রনি শুরু থেকে কিছুটা স্নায়ুচাপে ভুগছিলেন। মুভমেন্টের বিপক্ষে ব্যাট চালিয়ে রানের খাতা খুলতে দেরি হচ্ছিল তার। মুখোমুখি ১৩তম বলে মার্ক অ্যাডায়ারকে কাভার দিয়ে উড়িয়ে পান বাউন্ডারি। ওয়ানডেতে রানের খাতা খুলেই থেমেছেন তিনি। পরের বলের মুভমেন্ট না বুঝে এগিয়ে এসে উড়াতে গিয়ে ধরা দেন কিপারের গ্লাভসে।

লম্বা সময় ধরে ওয়ানডেতে রান পাচ্ছিলেন না তামিম। এবারও তিনি থামতে পারতেন শুরুতেই।  ১ রানে জস লিটলের বলে স্লিপে তার সহজ ক্যাচ ছেড়ে দেন আইরিশ অধিনায়ক বালবার্নি। জীবন পেয়ে পরের বলেই বাউন্ডারি মারেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।

তিনে নামা শান্ত  এদিনও ছিলেন চনমনে। এক পাশে তামিমের ভোগান্তির মাঝে স্ট্রাইক নিয়ে দলের রান বাড়ানোর দায়িত্ব সামলান। দ্রুতই থিতু হয়ে আভাস দিচ্ছিলেন আরেকটি বড় ইনিংসের। কিন্তু ক্রেইগ ইয়ংয়ের বলে আউট সাইড এজড হয়ে তার ক্যাচ যায় স্লিপে। এবার বা দিকে ঝাঁপিয়ে তুলনামূলক কঠিন ক্যাচ হাতে জমান বালবার্নি। ৩২ বলে ৩৫ করে থামেন শান্ত।

সাকিব না থাকায় ওপেনিং ছেড়ে চান নম্বরে নামার দায়িত্ব নিতে হয় লিটনকে। নতুন ভূমিকাতেও তাকে দেখা যায় সাবলীল। দ্রুতই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে থিতু হয়ে যান তিনি। ট্রেড মার্কে শটে আদায় করে নেন বাউন্ডারি।  তবে ঝলমলে ইনিংসটা পূর্ণতা দিতে পারেননি লিটন। ৩ চার, ১ ছক্কায় থামেন ৩৫ রান করে।

আগের ম্যাচের হিরোদের একজন তাওহিদ হৃদয় এবার পাননি তাল। ১৬ বলে ১৩ রান করে স্কয়ার কাটের চেষ্টায় ডকরেলের বাঁহাতি স্পিনে বোল্ড হয়ে যান এই ডানহাতি।

তামিম এক পাশে টিকে থাকলেও মোটেও সাবলীল ছিলেন না। ধুঁকতে ধুঁকতে শম্ভুক গতিতে এগুতে থাকেন তিনি। ৬১ বলে বাউন্ডারির মাধ্যমে ৯ ইনিংস পর ওয়ানডেতে পান ফিফটি। ফিফটির পর কিছুটা ডানা মেলার চেষ্টা করলেও মনমতো খেলতে পারছিলেন না। ডকরেলের বলে এগিয়ে এসে যেভাবে ক্যাচ তুলে দিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট বোঝা গেছে তার ক্রিজে থাকার অস্বস্তি। ৮২ বলে ৬৯ আসে তার ব্যাটে।

১৮৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে একটু নড়ে উঠলেও পরিস্থিতি সামাল দেন মুশফিক-মিরাজ। ৬ষ্ঠ উইকেটে দুজনের জুটিতে আসে ৭২ বলে মোড় ঘোরানো ৭৫ রান। ছয় নম্বরে নেমে ফিনিশিংয়ের দায়িত্বটা এদিনও পালন করছিলেন তিনি। তবে দলের চাপে সেভাবে ঝড় তোলা হয়নি। মুশফিক ফেরেন ৫৪ বলে ৪৫ রান করে। খানিক পর ৩৯ বলে ৩৭ করে থামেন মিরাজও। অভিষিক্ত মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী টেল এন্ডারদের নিয়ে আর খুব বেশি রান যোগ করতে পারেননি।

চাহিদার চেয়ে অন্তত ২০ রান কম করলেও দারুণ বোলিং-ফিল্ডিংয়ে শেষ পর্যন্ত হাসি নিয়েই ফিরছে বাংলাদেশ দল।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladeshi-Americans eager to help build new Bangladesh

July uprising and some thoughts of Bangladeshi-Americans

NRBs gathered in New Jersey showed eagerness to assist in the journey of the new Bangladesh forward.

5h ago