বুক রিভিউ

মুরাকামি দেখান আমরা একসঙ্গে থেকেও বিচ্ছিন্ন

ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর প্রথম প্রাণী হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণ করেছিল লাইকা নামের একটি কুকুর। ১৯৫৭ সালের সোভিয়েত মহাকাশযান স্পুটনিক-২ তে চড়ে রওনা দিলেও বেশি দিন বাঁচতে পারেনি কুকুরটি। মহাকাশের অন্ধকার শূন্যতায় হারিয়ে যেতে যেতে লাইকা কি দেখেছিল শুধুই নিঃসঙ্গতা? হারুকি মুরাকামির 'স্পুটনিক সুইটহার্ট' বই জুড়েও রইলো সেরকমই এক অদেখা শূন্যতা।

হারুকি মুরাকামির বেশিরভাগ বইগুলোর মতই, বইয়ের চরিত্রের চোখে আমরা গল্পটা দেখি। যদিও একসময় আমাদের কাছে মূল চরিত্রের চেয়েও অন্য কিছু চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় কথা, একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতা কিংবা নিঃসঙ্গতার অদ্ভুত সংমিশ্রণ যে আসলে যে কোন চরিত্রের জন্যই সমানভাবে প্রকট হয়ে উঠতে পারে, তা মুরাকামি দেখিয়েছেন সাদামাটা ভাবে, সহজেই এই গল্পে।

মুরাকামির বইগুলো পড়েছি খুব সচেতনভাবে। প্রকাশের সালক্রম অনুসারে। সত্তরের দশক থেকে এখন পর্যন্ত হারুকি মুরাকামির লেখালেখির রূপান্তর বোঝার চেষ্টা করেছি। এটা কেন? প্রসঙ্গত আমি অন্তত সতেরো জন মুরাকামি পাঠককে জিজ্ঞেস করেছি, 'মুরাকামির লেখা কেন টানে? কেউই সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর দিতে পারেনি। 

কেউ বলেছেন, ভালো লেখে। কেউ বলেছেন বিষণ্ণতা আছে বলে। তাদের আরও জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা শামানিজমের নাম শুনেছে কিনা। তারা আক্ষরিক অর্থেই জানতে চেয়েছেন জিনিসটা আসলে কী! আমি যখন হারুকি মুরাকামির নাম শুনতাম, তখন দেখতাম অভিজাত পরিবারের ছেলেমেয়েরা 'ইংরেজি' ভাষায় মুরাকামি চর্চা করেন। কেন সবাই ইংরেজিতেই মুরাকামি পড়ে তা জানি না। এমনকি তখন বাংলায় সেভাবে মুরাকামি অনুবাদও হতো না। 

হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর আগে পত্রিকায় একটা কলাম লিখতে শুরু করেন, 'নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ' নামে। সেখানে তিনি লেখেন মুরাকামির সঙ্গে তার একটা মিল তিনি খুঁজে পান। সেটা কি বিচ্ছিন্নতা? নাকি দু:খবোধ? আমি মুরাকামির লেখার ভেতরের ছন্দ নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে শামানিজম নিয়ে খোঁজ পাই। আমি অবাক হয়ে যাই, মুরাকামি কীভাবে আধ্যাত্মিক এক ধর্মীয় রীতি দ্বারা সাহিত্যে প্রভাবিত হয়েছিলেন। যেন 'ম্যাজিক অফ সিম্পলিসিটি!

মোরাকামি আমার এক বছরের ছোট। বাস করেন টোকিও শহরে। যেদিন তাঁর নতুন বই প্রকাশিত হয়, সেদিন বইয়ের দোকানের সামনে ক্রেতাদের লম্বা লাইন পড়ে যায়। এই মুহূর্তে আমি মোরাকামির যে বইটি পড়ছি তার নাম Blind Willow, Sellping Women. এটি একটি গল্পের বই। সর্বমোট ২৪টি গল্প বইটিতে আছে। বেশির ভাগই পড়া হয়েছে। গল্পের নাম 'The kidney shaped stone that moves everyday'। গল্পটির সঙ্গে আমার লেখা 'পাথর' গল্পের অস্বাভাবিক সাদৃশ্য দেখে চমকাচ্ছি। 'আয়না' নামে তাঁর একটা গল্প পড়লাম। 'আয়না' নামে আমার নিজের একটা গল্প আছে। এই দুটি গল্পও কাছাকাছি। আমার একটি গল্পে লিফটে করে এক পত্রিকা অফিসের পিয়ন অন্য এক জগতে চলে যায়, মোরাকামির একটি উপন্যাসের মূল নায়ক লিফটে করে উঠে অন্য এক জগতে চলে যায়। আমি মোরাকামির লেখা আগে কখনো পড়িনি, এই প্রথম পড়ছি। এই জাপানি লেখকের আমার লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তা হলে কি লেখকদের মধ্যে অদৃশ্য অলৌকিক কোনো যোগসূত্র আছে?  (নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ/ হুমায়ূন আহমেদ)

মুরাকামির শূন্যতা প্রথম টের পাই তার উপন্যাস 'আ ওয়াইল্ড শিপ চেজ' নামের বইতে। এটা মূলত একটা ট্রিলজির শেষ বই। মুরাকামির প্রথম লেখা বই 'হেয়ার দ্য ওয়াইন্ড সিং'। এতে মুরাকামির লেখার জগতের 'অস্বাভাবিক' বিষয়গুলো টের পাওয়া যায়। যেমন চরিত্রগুলো প্রচণ্ড বিষণ্ণ। যৌনতার উপস্থিতি। কিংবা প্রধান চরিত্রের চোখ দিয়ে অন্যান্য চরিত্রগুলোই গল্পে প্রধান হয়ে ওঠা। ট্রিলজির মূল চরিত্র, অর্থাৎ যিনি গল্পটা বলেন, তার কোন নাম আমরা জানতে পারি না। যদিও বইজুড়ে চরিত্রটি গল্প বলেন, তাও মুরাকামি যেন আমাদের বুঝিয়ে যান একসঙ্গে থেকেও অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন। 

'স্পুটনিক সুইটহার্ট' বইটি বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতার গল্প। সুমিরে নামের একটি মেয়েকে আমরা দেখতে পাই কৈশোর সময় পার করেও পাগলাটে ভাব রাখছে। যে কিনা একটা উপন্যাস লেখার জন্য সারাদিন অপেক্ষা আর গল্পের মূল চরিত্রকে মাঝরাতে কল দেয়। এর মাঝে তিনি একদিন তারচেয়ে বয়সে বড় বিবাহিতা মহিলার প্রেমে পড়েন। সুমিরে নিজেও অবাক হন, কারণ তিনি সমকামী নন। তবুও তার সেই বয়স্ক মহিলাকে ভালো লাগে এবং  পাশাপাশি থাকতে চান। একসময় তার সঙ্গে কাজও শুরু করেন সুমিরে। দেশ বিদেশ ঘুরতে শুরু করেন ব্যবসার কাজে, সেখান থেকে চিঠি লিখে জানান আমাদের গল্পের মূল চরিত্রকে। আমরাও সেসব চিঠি পড়ে জানতে পারি পৃথিবীর অদ্ভুত সব সংস্কৃতির কথা।

ঠিক সেসময়ই একদিন একটি ঘটনা ঘটে।গল্পের মূল চরিত্র ফোন পান সুমিরের সঙ্গী সেই বিবাহিতা মহিলার কাছ থেকে। পাঠকের মত গল্পের চরিত্রও ভয় পেয়ে যান, সুমিরের সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটেনি তো? আর সেখান থেকেই আমরা চমকে যাই। আমরা বুঝতে পারি মুরাকামি আমাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে কিছুদূর নিয়ে ফেলে দিয়েছেন এমন এক ফানেলে, যেখানে রয়েছে সীমাহীন বিষণ্ণতা।


বইয়ের পুরো 'ল্যান্ডস্ক্যাপ জুড়ে মাত্র তিনটি চরিত্র বাস করে। এদের মধ্যে প্রত্যেকেই প্রেম থেকে দূরে কিংবা প্রেমে ব্যর্থ। তারা শোনে, কথা বলে, সম্মতি দেয় এবং দিনশেষে, তাদের একাকী জীবনে ফিরে যায় এবং কেবল সেই ব্যক্তিকে ভালবাসতে থাকে, যে তাদের আর কখনই ভালবাসবে না। কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিকের মতো একে অপরকে প্রদক্ষিণ করে কিন্তু কখনই কাছে আসে না।

আমি বিশ্বাস করি, মুরাকামি আসলে সমস্ত জাঁকজমকপূর্ণ জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় এবং সবার সামনে নশ্বর পৃথিবীর নগ্নতাকে প্রকাশ করে দেয়। আমরা মানুষকে চিনতে পারি বলি বটে, কিন্তু আদতে চিনতে পারি না। প্রেম কি কেবল একটি স্বপ্ন যা আমরা আমাদের একাকী অস্তিত্বের বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার জন্য দেখি? স্পুটনিক সুইটহার্ট বইতে মুরাকামি আমাদের সামনে প্রশ্নগুলো এনে দাঁড় করায়।

হারুকি মুরাকামির গল্পে যৌনতার উপস্থিতি লক্ষণীয়। তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস 'নরওয়েজিয়ান উড' বই থেকে শুরু করে তুলনামূলক কম জনপ্রিয় বইগুলোতেও যৌনতা, গল্পে একটি আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে আসে। কিন্তু সেগুলো আরোপিত মনে হয় না; বরং চরিত্রগুলোর সংকট প্রকাশের একটি ভাষা হয়ে ওঠে। স্পুটনিক সুইটহার্ট বইতে সুমিরে চরিত্রের পছন্দের ব্যক্তি, বয়স্ক মহিলার একটি অতীতের গল্প বলতে গিয়ে আমরা একটা ইঙ্গিত পাই। গল্পটা বাস্তবতা থেকে দূরে নিয়ে আসলে এক ধরণের নিঃসঙ্গতার গল্পই বলে। তাকে আমরা 'মিউ' বলে সম্বোধন করতে দেখি। যুবতী বয়সে মিউ প্যারিসে ঘুরতে গিয়ে একটা বিপদে পড়ে। একজন ভবঘুরের সঙ্গে তার বিভিন্ন জায়গায় দেখা হয়। একবার তাকে ডেটে যাবার আমন্ত্রণও জানিয়েছিলো, মিউ না করে দেয়। কিন্তু মেয়েটার ধারণা লোকটা তার পিছু নিচ্ছে। এমনই এক রাতে প্যারিসের একটা পার্কের চড়কিতে চড়তে গিয়ে আটকে পড়েন মিউ। বেশ কিছুক্ষণ আটকে থাকার পর মিউ দেখতে পায় তার এপার্টমেন্টটা এখান থেকে একদম সোজাসুজি। ব্যাগ থেকে সদ্য কেনা বাইনোকুলারটা বের করে আগ্রহী হয়ে নিজের ঘরের দিকে তাক করে। হিম হয়ে যার তার শরীর। দেখা যায়, তার ফ্ল্যাটেই নগ্ন হয়ে বিছানার উপর বসে আছে সেই বখাটে যুবক। তার অবাক হবার বাকি ছিল। কারণ ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে সে দেখতে পায়, বখাটে যুবকের সামনে একজন নারী। সেই নারী আর কেউ না; বরং সে নিজেই।

মিউ চরিত্রটিকে আমাদের যখন ভালো লাগতে শুরু করে, আমরা দেখি মিউ নিজেও আসলে একাকী একজন মানুষ। যেমন একাকী মনে হচ্ছিল মূল চরিত্রকে। যার কাছে তার একমাত্র বান্ধবী সুমিরের অনিয়মিত মধ্যরাতের ফোন দেয়া ছাড়া তেমন উত্তেজনাকর মুহূর্ত নেই। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সুমিরে চরিত্রের জন্য মায়া হয়। বুঝতে পারি, বুকের মধ্যে যেই চরম বিষণ্ণতাকে আটকে রেখেও ঘুরছি, যেন আমাদের কিছুই হয়নি।


পিয়াস মজিদের একটি কবিতা আছে। যেখানে তিনি দেখান, আমরা যেই জীবনের মধ্য দিয়ে যাই, সেটা থেকে দূরের এক জীবন চাই। শহরে থেকেও আমাদের মনে হয় গ্রামই হয়তো ভালো। আমরা আমাদের জীবনকে কখনই মেনে নিতে পারি না। মুরাকামির সার্বজনীন এই বিষণ্ণতা ধরতে কবিতাটা প্রাসঙ্গিক।

শীতের সকালে শহরের বহু মানুষ খেজুরের রস পান করে
কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করে
ওতে নিপা ভাইরাস আছে।
বিকেলে পথেঘাটে দেয়াদারসে ১২ রকম ভর্তা দিয়ে
পিঠা খেতে খেতে ভাবে, 
পিঠার প্রকৃত স্বাদ বাস করে দেশগাঁয়ে।

রাতে গায়ে কম্বল টেনে ঘুমিয়ে পড়ে একদিকে
নাগরিক বেঁচেবর্তে থাকার স্বপ্ন দেখে
আর অন্যদিকে ভাবনায় রাখে,
হঠাৎ মরেটরে গেলে
গ্রামে কবর হলেই বোধ হয়
এই ভেজালের যুগে
অনন্ত মৃত্যুর পর অনন্ত শীতকালে
বিশুদ্ধ শিশিরের স্বাদ পাওয়া যাবে।

সবশেষে প্রশ্ন আসে, হারুকি মুরাকামি কেনই বা বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার পাঠকের মনে? আদতে তার সব গল্পেই থাকে সাধারণ এক উপাদান, যা কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে একটা স্বচ্ছ সেতু। সেই উপাদান হলো- বিষণ্ণতা। উপাদানটি  মুরাকামি এতটাই ভালোভাবে ব্যবহার করেন, যা আমাদের দোদুল্যমান মনে ভারসাম্য এনে দেয়। আর আমরাও ভাবি, একদিন হয়তো আমাদের বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব ও বিষণ্ণতা দূর হয়ে যাবে। অথচ আমরা জানি, এটা কখনও দূর হবার নয়!

Comments

The Daily Star  | English

At least 30 hurt as clashes engulf part of Old Dhaka

Suhrawardy college, hospital vandalised as protests over student’s death turn violent

47m ago