ইলন মাস্ক ও অল্টম্যান: যেভাবে বন্ধু থেকে ‘শত্রু’

ইলন মাস্ক ও অল্টম্যান
ইলন মাস্ক ও অল্টম্যান। ছবি: সংগৃহীত

২০১৫ সালে স্যাম অল্টম্যান এবং ইলন মাস্ক যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ওপেনএআই। এই প্রতিষ্ঠানটিই এখনকার ট্রেন্ডিং এআই চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি তৈরি করেছে। অল্টম্যান এবং মাস্কের সঙ্গে এই উদ্যোগে আরও শামিল ছিলেন পিটার থিয়েল, লিংকডইনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রিড হফম্যান, ওয়াই ইনকিউবেটরের সহপ্রতিষ্ঠাতা জেসিকা লিভিংস্টোনের মতো সিলিকন ভ্যালির প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা। 

২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর ওপেনএআইয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক বিবৃতি অনুসারে, উদ্যোক্তারা মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণে কাজে আসবে, এমন অলাভজনক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিলেন।

ইলন মাস্ক তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে 'মানবাজাতির অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি' হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। 

ওপেনেএআই প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কিত একটি বিবৃবিতে বলা হয়েছে, 'মানুষের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটা উপকারী হতে পারে, সেটা অনুধাবন করা মুশকিল। কিন্তু সঠিকভাবে তৈরি করা না হলে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমাজের কতটা ক্ষতি করতে পারে, সেটিও অনুধাবন করা মুশকিল।' 

২০১৮ সালে মাস্ক ওপেনএআইয়ের পরিচালক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। 

সে সময় কোম্পানিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, 'টেসলা যেহেতু দিন দিন এআইয়ের প্রতি আরও গুরুত্ব দিচ্ছে, তাই এটি মাস্কের সঙ্গে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ দ্বন্দ্ব এড়াবে।' বিবৃতিতে যদিও বলা হয় মাস্ক কোম্পানিটির প্রতি তার দিকনির্দেশনা এবং সহযোগিতা অব্যাহত রাখবেন। 

সম্প্রতি জানা গেছে, গুগলকে হঠানোর উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে মাস্ক নিজে ওপেনএআইকে চালানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু অল্টম্যান এবং কোম্পানিটির অন্যান্য  সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরপরই মাস্ক কোম্পানিটি থেকে তার বিনিয়োগ তুলে নেন এবং পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেন। 

২০১৯ সালে মাস্ক এই পদত্যাগ সম্পর্কে কিছুটা ব্যাখ্যা দেন। তিনি দাবি করেন, ওপেনএআই যে পথে পরিচালিত হচ্ছিল, তার সঙ্গে তিনি একমত হতে পারেননি বলেই পদত্যাগ করেছিলেন। 

তিনি তখন টুইটে বলেন, 'টেসলা এবং স্পেস এক্সে তখন অনেকগুলো জটিল ও দীর্ঘ ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যানুফেকচারজনিত সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দিতে হচ্ছিল। আবার, টেসলাও ওপেনএআইয়ের সঙ্গে কিছু বিষয়ে প্রতিযোগিতা করছিল। ওপেনএআই যে পথে যাচ্ছিল, তার সঙ্গে আমি একমত ছিলাম না এবং ভালোভাবে বিদায় বলাটাই তখন ছিল উত্তম সিদ্ধান্ত।'

পদত্যাগের পর মাস্ক ওপেনএআইয়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভিন্ন সময় কড়া সমালোচনা করেছেন। 

ছেড়ে আসার ২ বছর পর কোম্পানিটির গোপনীয়তার সংস্কৃতির ওপর এমআইটি টেকনোলজি রিভিউয়ের একটি প্রতিবেদনের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মাস্ক বলেন, 'ওপেনএআইয়ের আরও ওপেন (উন্মুক্ত) হওয়া উচিত।' 

ওপেনএআইয়ের তৎকালীন স্ট্যাটেজি বিভাগের প্রধান দারিও অ্যামোদেইয়ের সমালোচনা করে মাস্ক তখন বলেছিলেন, 'নিরাপত্তা নিয়ে দারিওর ওপর আমার ভরসা নেই।' 

চ্যাটজিপিটি চালু হওয়ার কয়েকদিন পর, ২০২২ সালে ডিসেম্বরে মাস্ক বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই চ্যাটবটটিকে প্রশিক্ষণের জন্য টুইটারের ডাটাবেজ ব্যবহার করা হয়েছে। 

মাস্ক এখন টুইটারের মালিক। চ্যাটজিপিটি এখন প্রযুক্তি বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। 

মাস্ক তখন আরও বলেন, 'আয় ও পরিচালনা নিয়ে ওপেনএআইয়ের পরিকল্পনা আরও ভালোভাবে বোঝা দরকার। ওপেন-সোর্স এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওপেনএআইয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে এই দুটির কোনোটিই সত্য নয়।' 

সংবাদমাধ্যম সেমাফোরের মার্চ মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ওপেনএআইয়ের সাফল্যে মাস্ক ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গত নভেম্বরে চালু হওয়ার পর এই এআই চ্যাটবটটি প্রযুক্তি দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে ১০ কোটি গ্রাহকের মাইলফলক অতিক্রম করে। 

ফেব্রুয়ারি মাসে মাস্ক সমালোচনা করে বলেন, বর্তমানে ওপেনএআই যেভাবে চলছে, প্রতিষ্ঠানটির আদৌ এভাবে চলার কথা ছিল না।  

এক টুইটে তিনি বলেন, 'ওপেনএআই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ওপেন সোর্স হিসেবে (এজন্য আমি এটির নাম রেখেছিলাম 'ওপেনএআই'), কোম্পানিটির অলাভজনক এবং গুগলের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কথা। কিন্তু এটি এখন হয়েছে ক্লোজড সোর্স, সর্বোচ্চ মুনাফাধারী এবং মাইক্রোসফটের নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানি। আমি যা ভেবেছিলাম, তা মোটেই এমন ছিল না।' 

এক মাস পর মাস্ক আবারও সমালোচনা করে লিখেন, 'আমি এখনো বুঝতে পারছি না একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান- যেটিতে আমি প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিলাম, এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের মুনাফাভোগী কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। তাহলে সবাই কেন একই কাজ করছে না?'

তবে মাস্কের সমালোচনাগুলোর কিছু কিছু জবাব সম্প্রতি দেওয়ার চেষ্টা করছেন অল্টম্যান। 

সম্প্রতি একটি পডকাস্টে অল্টম্যান বলেন, 'ইলনের ব্যাপারে ইতিবাচক কিছু বলতে গেলে বলতে হয়, সে সত্যিই ভবিষ্যতে এজিআইয়ের (আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টিলিজেন্স) সদ্বব্যবহারের ব্যাপারটি অনেক গুরুত্বসহকারে ভাবে।'

'তিনি হঠাৎ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তার সম্পর্কে যা-ই বলা হোক না কেন, প্রতিটি ব্যাপারেই তার নিজস্ব স্টাইল আছে। আমি সেই স্টাইল আমার নিজের মধ্যে দেখতে চাই না। কিন্তু তিনি আসলে ভাবেন (এআই নিয়ে)। ভবিষ্যতে এটি মানবজাতির জন্য কেমন পরিণতি বয়ে আনসবে, তা নিয়ে তিনি সত্যিই চিন্তিত।' 

ওপেনএআই এখন 'ক্লোজড সোর্স, সর্বোচ্চ মুনাফাধারী এবং মাইক্রোসফটের নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানিনে পরিণত হয়েছে'. মাস্কের এই সমালোচনার জবাবে অল্টম্যান বলেন, 'এসবের অধিকাংশই সত্যি নয়। আমি মনে করি মাস্ক নিজেও এটা জানেন।'

মাস্কের দিক থেকে ক্রমাগত সমালোচনায় বিদ্ধ হলেও অল্টম্যান স্বীকার করেছেন যে তিনি যাদের আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করেন, মাস্ক তাদের মধ্যে একজন। 

সম্প্রতি একটি খোলা চিঠিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিগুলোর আরও উন্নত প্রশিক্ষণ অন্তত ৬ মাসের জন্য বন্ধ রাখার আহবান জানানো হয়। চিঠিটিতে এক হাজারেরও বেশি প্রভাবশালী ব্যক্তি স্বাক্ষর করেছেন। মাস্ক তাদের মধ্যে একজন। 

চিঠিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভবিষ্যতে মানবজাতির জন্য কী পরিণতি বয়ে আনবে, সে ব্যাপারে উদ্বেগ জানানো হয়। 

মাস্ক টুইটারে অল্টম্যানকে আনফলো করেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় অল্টম্যান মাস্কের 'বাক স্বাধীনতার একনিষ্ঠ সমর্থক' অবস্থানকে খোঁচা দিয়েছেন।  

সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার, সেমাফোর 
গ্রন্থনা:
আহমেদ হিমেল
 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

15h ago