গ্রাহকের ওপর নজরদারিতে ব্যবহৃত হয় টেসলার গাড়ির ক্যামেরা!

গ্রাহকের ওপর নজরদারিতে ব্যবহৃত হয় টেসলার গাড়ির ক্যামেরা!
টেসলার মডেল-৩ গাড়ি অটোপাইলট ব্যবস্থা। ছবি: রয়টার্স

শীর্ষস্থানীয় ইলেকট্রিক গাড়ি (ইভি) নির্মাতা টেসলা বিশ্বজুড়ে তাদের লাখ লাখ গ্রাহককে আশ্বস্ত করেছিল যে তাদের নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা 'সবসময়ই আমাদের কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে'।

টেসলার গাড়িতে যেসব ক্যামেরা ব্যবহৃত হয়, সেগুলো শুধু নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের নিশ্চয়তার জন্যই এবং কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ক্যামেরাগুলোর 'ডিজাইন করাই হয়েছে এমনভাবে, যাতে এগুলো গ্রাহকের গোপনীয়তার সুরক্ষা দিতে পারে'।

কিন্তু ২০১৯-২০২২ সাল পর্যন্ত টেসলার কর্মীরা প্রতিষ্ঠানটির আভ্যন্তরীণ মেজেসিং প্ল্যাটফর্মে এমন কিছু ছবি ও ভিডিও চালাচালি করেছেন, যেগুলো গ্রাহকের গাড়ির ক্যামেরার সাহায্যে ধারণ করা হয়েছে। টেসলার ঘোষিত নীতি অনুযায়ীই ভিডিওগুলো গ্রাহকের গোপনীয়তা নীতি লঙ্ঘন করে। টেসলার ৯ জন সাবেক কর্মী রয়টার্সকে এ ভিডিওগুলোর ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন।

কিছু কিছু ভিডিও আছে, যেগুলো গ্রাহকের জন্য চূড়ান্ত অবমাননাকর। একজন কর্মী এমন একটি ভিডিওর কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে গাড়ির মালিক সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় গাড়িটির দিকে এগিয়ে আসছিলেন।

২০২১ সালের আরেকটি ভিডিওতে একটি দুর্ঘটনার মুহূর্ত রেকর্ড হয়। চালক আবাসিক এলাকার মধ্য দিয়ে খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিলেন এবং এক পর্যায়ে সাইকেলে আরোহী এক বাচ্চাকে সজোরে আঘাত করেন। ভিডিওতে দেখা গেছে বাচ্চাটি এক দিকে এবং তার সাইকেলটি আরেকদিকে উড়ে গেছে। একজন সাবেক কর্মী বলেন, ক্যালিফোর্নিয়ার সান মাতেওতে টেসলার অফিসে সহকর্মীদের মধ্যে ভিডিওটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল।

গ্রাহকের গাড়ির ক্যামেরায় ধারণকৃত কুকুরের ছবি কিংবা হাস্যকর রাস্তা নির্দেশিকার ছবিকে মিম বানিয়ে তা আভ্যন্তরীণ মেসেজিং গ্রুপে চালাচালি করতেন টেসলার কর্মীরা। এ ধরণের ছবি ও মিম কখনো কখনো দুজনের মধ্যে চালাচালি হতো, আবার কখনো কখনো অন্য সহকর্মীরা সেগুলো দেখতেন। একাধিক সাবেক কর্মী এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছেন।

টেসলার গাড়িতে ব্যবহৃত ক্যামেরার নীতিমালায় বলা হয়েছে, 'ক্যামেরা রেকর্ডিংগুলো বেনামে সংরক্ষিত থাকবে এবং কোন ভিডিও কোন গাড়ির, সেটি নির্ণয় করা যাবে না। কিন্তু টেসলার অন্তত ৭ জন কর্মী নিশ্চিত করেছেন যে, তারা যে কম্পিউটার প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করতেন, সেখানে রেকর্ডিং লোকেশন দেখা যেতো। ফলে সহজেই বোঝা যেত গাড়ির মালিক কোথায় থাকেন।'

একজন সাবেক কর্মী বলেছেন, তাদের দেখা কিছু ভিডিও ধারণ করা হয়েছে গাড়ি বন্ধ থাকা অবস্থায়। কয়েক বছর আগে গাড়ি বন্ধ থাকা অবস্থায় গ্রাহকের অনুমতি সাপেক্ষে টেসলা ভিডিও রেকর্ডিং সংগ্রহ করতে পারতো। তবে এখন এই নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে।

একজন সাবেক কর্মী বলেন, 'আমরা গ্রাহকের গ্যারাজ এবং তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখতে পেতাম। যেমন, কোনো টেসলা গ্রাহকের গ্যারাজে এমন কিছু দেখা গেলো, যা সাধারণত গ্যারেজে দেখা যায় না। কর্মীরা তখন এগুলো নিজেদের মধ্যে পোস্ট করতো।

এ সম্পর্কে রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে দেয়নি টেসলা।

প্রায় ৩ বছর আগে টেসলার কিছু কর্মী হঠাৎ করে একদিন একটি গাড়ির ক্যামেরার সাহায্যে দেখেন যে গাড়িটি যেই গ্যারাজে পার্ক করা ছিল, সেখানে ১৯৭৭ সালে জেমস বন্ড সিনেমা 'দ্য স্পাই হু লাভড মি'-তে ব্যবহৃত সাদা লোটাস এসপ্রিট পার্ক করা আছে।

এই গাড়িটির মালিক টেসলার প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক স্বয়ং। ২০১৩ সালে এক নিলামের মাধ্যমে ৯ লাখ ৬৮ হাজার মার্কিন ডলার দিয়ে তিনি গাড়িটি কিনেছিলেন। টেসলার গাড়ি থেকে রেকর্ড করা ভিডিওটি সম্পর্কে, কিংবা এটি যে টেসলার সহকর্মীদের মধ্যে চালাচালি হয়েছে, সে সম্পর্কে মাস্ক জানেন কিনা, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

বিশেষ এ প্রতিবেদনটি তৈরির স্বার্থে রয়টার্স অন্তত ৩০০ জন সাবেক টেসলা কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। যাদের মধ্যে ডজনখানেক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়।

কর্মীরা যেসব ভিডিও রেকর্ডিংযের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর কোনোটি রয়টার্স নিজে সংগ্রহ করেনি। রয়টার্স এটাও নিশ্চিত হতে পারেনি যে এসব রেকর্ডিং টেসলাতে এখনো সংরক্ষণ করা হয় কিনা কিংবা এসব গোপন রেকর্ডিং টেসলার সহকর্মীদের মধ্যে কতটা ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হতো।

কিছু সাবেক কর্মী অবশ্য দাবি করেছেন, তারা অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে কাজের খাতিরেই ভিডিওগুলো শেয়ার করতেন। হয়তো কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে অন্য সহকর্মী বা সুপারভাইজারের সহায়তা পেতে ভিডিওগুলো তাদের সঙ্গে শেয়ার করা হতো।

পথচারী ও রাস্তা নির্দেশিকা নির্ণয়

টেসলার গাড়িগুলোকে পথচারী, অন্যান্য যানবাহন, বস্তু ও রাস্তা নির্দেশিকা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ২০১৬ সাল থেকে টেসলা আফ্রিকায় ও পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে শত শত কর্মী নিয়োগ করেছিল। তখন এসব ডাটা লেবেলারদেরকে টেসলার গাড়ির ক্যামেরার সাহায্যে ধারণকৃত হাজার হাজার ভিডিও ও ছবির প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল, যাতে ভিডিও ও ছবি থেকে তারা বিভিন্ন বস্তুকে নির্ণয় করে সে সম্পর্কে গাড়ির প্রতিক্রিয়া ও আচরণ কেমন হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশিকা তৈরি করতে পারে।

টেসলা এখন এই কাজটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে করার দিকে ঝুঁকছে এবং ডাটা লেবেলারদের সংশ্লিষ্টতা কমানোর উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। গত বছর ক্যালিফোর্নিয়ার সান মাতেওতে এমন একটি ডাটা লেবেলিং হাব বন্ধ করে দিয়েছিল টেসলা। তবে একই সঙ্গে নিউ ইয়র্কের বাফেলোতে এমন আরও শতাধিক কর্মী নিয়োগ করেছিল।

রয়টার্সের সঙ্গে যেসব কর্মীরা কথা বলেছেন, তাদের কেউ কেউ বলেছেন, এসব ছবি ও ভিডিও অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো চিন্তা নেই। আবার কেউ কেউ বলেছে, জিনিসটা তারা পছন্দ করেননি।

একজন সাবেক কর্মী বলেছেন, 'সত্যি বলতে, এটা গ্রাহকের গোপনীয়তার লঙ্ঘন। গ্রাহকদের সঙ্গে তারা যা করতো, তা দেখে আমি প্রায়ই মজা করে বলতাম যে আমি কখনোই টেসলার গাড়ি কিনব না।'

আরেকজন বলেন, 'এটা নিয়ে আমার খারাপ লাগা কাজ করতো। কারণ যারা গাড়িগুলো কিনেছে, তারা আসলে জানে না তাদের গোপনীয়তাকে কীভাবে সম্মান করা হচ্ছে। টেসলার ক্যামেরার মাধ্যমে আমরা তাদেরকে জামা কাপড় ধুতে দেখতাম, তাদের বাচ্চাদের দেখতাম এমনকি তাদের খুব ঘনিষ্ঠ মুহূর্তও দেখতাম।'

একজন সাবেক কর্মী বলেন, ছবি ও ভিডিও সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগাভাগিতে তিনি কোনো সমস্যা দেখেন না। তবে ডাটা লেবেলাররা গুগল ম্যাপে গ্রাহকের অবস্থান দেখতে পেতেন, যা গ্রাহকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ব্যাপক ও স্পষ্ট লঙ্ঘন।

সেল্ফ ড্রাইভিং প্রযুক্তি তৈরির জন্য টেসলা বিশ্বজুড়ে থাকা তাদের লাখ লাখ গাড়ির সাহায্যে ব্যাপকভাবে ভিডিও ও ছবি রেকর্ড করেছে। তবে গ্রাহকের অনুমতি নিয়েই অবশ্য এটি করা হয়েছে। টেসলা গ্রাহকদেরকে নিশ্চয়তা দিয়েছিল তাদের ব্যক্তিগত তথ্য কোম্পানিটি সুরক্ষিত রাখবে। তবে রয়টার্সের রিপোর্টে এটা উল্লেখ করা হয়েছে যে, টেসলার যেসব কর্মীরা সেল্ফ ড্রাইভিং প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করছিল এবং এসব ভিডিও এবং ছবি দেখার অধিকার যাদের ছিল, তারাই শুধু ছবিগুলো দেখেছে।

সমস্যা শুধু টেসলার নয়

রয়টার্সের প্রতিবেদনটি হয়তো অনেককেই উদ্বিগ্ন করবে। তবে এটাই এখন এক রূঢ় বাস্তবতা।  আধুনিক গাড়িগুলোতে এখন অনেকগুলো ক্যামেরা থাকে। ভবিষ্যতের গাড়িতে হয়তো আরও বেশি ক্যামেরা থাকবে। এসব ক্যামেরার সাহায্যে ধারণকৃত ছবি ও ভিডিও কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে, তা পরিষ্কার নয়। রয়টার্সের প্রতিবেদনটি শুধু টেসলাকে নিয়ে। তার মানে এই নয় যে শুধু টেসলার গ্রাহকরাই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঝুঁকিতে আছে।

সূত্র: রয়টার্স, ভক্স

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

Comments

The Daily Star  | English

Thailand sees growing influx of patients from Bangladesh

Bangladeshi patients searching for better healthcare than that available at home are increasingly travelling to Thailand instead of India as the neighbouring country is limiting visa issuances for Bangladeshi nationals.

13h ago