নব্বইয়ের দশকে গ্রামে আমাদের শৈশব কৈশোরের ঈদ
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে যাদের জন্ম তাদের ডাকা হয় নাইন্টিজ কিড বলে। নব্বইয়ের দশকে যাদের জন্ম গ্রামে তারা জীবনকে দেখেছে দুটি ভাগে। একদিকে শৈশব কৈশোরে মাটির ছোঁয়া, অন্যদিকে তারুণ্যে এসে প্রযুক্তির মেলবন্ধন। গ্রামের কাদা মাটি ডিঙ্গিয়ে, আলো বাতাস ছুঁয়ে বেড়ানো সেই অপ্রতিরোধ্য শৈশব যেমন ছিল প্রাণখোলা, ঠিক তেমনই দেখেছি প্রযুক্তি নির্ভর জীবনের আরেক রূপ।
শৈশব আর কৈশোরের গ্রামের সেই ছোঁয়া এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না। কদাচিৎ দেখা গেলেও তাকে বলা যায় রীতিমতো 'বিলুপ্ত'। নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেওয়া সে প্রজন্মের নস্টালজিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অংশের নাম ঈদ উৎসব। আমাদের যাদের জন্ম একইসঙ্গে গ্রামে এবং নব্বইয়ের দশকের প্রারাম্ভে বা আশির দশকের শেষে তাঁদের কাছে ঈদ ছিল এক তুলনাহীন উৎসব। সে সময় রোজার প্রথম সপ্তাহে স্কুল বন্ধ হওয়ার রেওয়াজ ছিল। কোথাও কোথাও অবশ্য আরও পরে স্কুল বন্ধ হতো।
ঈদকে ঘিরে আমাদের ছিল এক প্রবল প্রতীক্ষা। রোজার শুরু থেকেই চলত ক্ষণ গণনা। ঈদের আর কদিন বাকি তা নিয়ে শৈশব মনে চলত সুতীব্র অপেক্ষা। প্রতিটি রোজা শেষ হওয়া মানে ঈদের দিকে একদিন করে এগিয়ে যাওয়া। প্রতিবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে চলত নিত্য আলাপচারিতা—এবার ঈদের দিন সবাই কীভাবে কাটাবে।
যার যার সামর্থ্য অনুযায়ীই ঈদের পোশাক কিনতাম আমরা। কাপড়ের যেমনই হোক, দাম নিয়ে কখনো আমাদের মাথা ব্যথা ছিল। বরং ছিল ঈদের পোশাক লুকিয়ে রাখার প্রবণতা। ঈদের নামাজের আগে নতুন জামা-জুতা কেউ দেখে ফেলা মানেই ঈদের আনন্দ ও উত্তেজনা পুরোপুরি মাটি। অন্যদিকে বন্ধুদের মধ্যে কারো ঈদের পোশাক দেখে ফেলা মানেই বিপুল আনন্দ।
ঈদ কার্ড ও অস্থায়ী দোকান
আমাদের শৈশব-কৈশোরে ঈদ কার্ডের রমরমা পসার ছিল। বিশেষ করে আমাদের ছোটদের মধ্যে ঈদ কার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়ের চল ছিল। এক, দুই কিংবা পাঁচ টাকার মধ্যেই ছিল ঈদ কার্ডের দাম। বাজারে সর্বোচ্চ শ' টাকার ঈদ কার্ড থাকলেও দশ টাকার চেয়ে বেশি দামের কার্ড কেনার সামর্থ্য আমাদের ছিল না।
কুড়ি রোজা শেষ হওয়ার আগ থেকেই ঈদ কার্ডে বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানাতাম আমরা। সেসব কার্ডে লেখা হতো ঈদের শুভেচ্ছা সমেত ছড়া কিংবা কবিতা। যেসব বন্ধুদের আমরা ঈদ কার্ড দিতাম, তাদের কাছ থেকে ফিরতি ঈদ কার্ড পাওয়ার অপেক্ষা করতাম। নয়তো কোমল বয়সের বন্ধুত্বে যেন খানিকটা ছেদ পড়ত।
কোনো কোনো বন্ধু বাড়ির সামনের রাস্তায় ঈদ কার্ডের দোকান বসাত। সে দোকানই বা আর আহামরি কেমন হবে! চারকোনা চারটে বাঁশের কঞ্চি কেটে পুঁতে দিয়ে, চারপাশ সূতলি দিয়ে বেঁধে উপরে নারিকেল কিংবা সুপারির পাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া। দুই কঞ্চির ব্যবধানে টাঙ্গানো সুতলিতে ঝুলতো এক কিংবা দুই টাকা দামের ঈদ কার্ড। ঈদ কার্ডের সঙ্গে থাকত বিভিন্ন ভিউ কার্ড এবং স্টিকার।
ঈদের চাঁদ দেখা
আমরা যারা তখন শিশু কিশোর ছিলাম, তাদের মাঝে ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে ছিল প্রবল উত্তেজনা ও আগ্রহ। ২৯ রোজার দিনের শুরু থেকেই ছিল প্রতীক্ষা কখন ইফতারের সময় হবে আর পশ্চিমের আকাশের এক কোণে সূক্ষ্ম ফালির মতো অস্পষ্ট চাঁদ দেখা যাবে। কারো কারো ইফতার করার মতো ধৈর্যও থাকত না। কারণ যদি আকাশে কোনক্রমে চাঁদের দেখা মেলে তবে বড়াই করে বলা যাবে, 'ঈদের চাঁদ আমিই প্রথম দেখেছি।'
ঈদের চাঁদ দেখার পর আমরা শিশু কিশোরের দল দলবেঁধে 'রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' গাইতে গাইতে বাড়ির পথ ধরতাম।
২৯ রোজায় যদি ঈদের চাঁদ না দেখা যেত তবে বিরস বদনে আমরা বাড়ি ফিরতাম। কারণ আরও যে একটি দিনের অপেক্ষা। আর সেদিন নতুন চাঁদ দেখার তেমন উত্তেজনাও থাকত না। কারণ মেঘের কারণে চাঁদ দেখা না গেলেও পরদিন অবশ্যই ঈদ। চাঁদ দেখার জন্য উপযুক্ত স্থান ছিল বিল কিংবা ফাঁকা জায়গা। আমরা বেছে নিতাম বাড়ির পেছনের খেত। পেছন দিকে ফসলের খেত ছিল পুরোপুরি উম্মুক্ত।
চাঁন রাতের উচ্ছ্বাস
আমাদের ছোটদের চোখে চাঁদ রাত ছিল বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ রাত। কারণ রাত পোহালে ঈদ বলে এদিন লেখাপড়ার কোনো চাপ নেই। বাঁধনহীন উচ্ছ্বাসে কেবলই ভেসে যাওয়ার পালা। বাড়ির মেয়েরা থাকত মেহেদি লাগানোয় ব্যস্ত। তখন বাজারের টিউব মেহেদীর চল ছিল না। পাটায় মেহেদি বাটা হতো। হাতে তা লাগানো হতো নারিকেল পাতার শলাকা দিয়ে। চাঁদ রাতে আমরা শিশু কিশোররা থাকতাম লুকোচুরি খেলায় মত্ত। পুরো বাড়িতে লেগে থাকত উৎসবের আমেজ। বছরের কেবল এই দিনটিতে কোনো শাসনের বালাই থাকত না। চাঁদরাতে ঘরদোর সাজানো হতো।
ঈদের সকাল ও অন্যান্য
ঈদে ভোরে উঠে বাড়ির পুরুষেরা সবাই একসঙ্গে পুকুরে গোসল করার রেওয়াজ ছিল। তবে তা যতটা না বাড়ির পুকুর তার চেয়ে বেশি গ্রামের বড় পুকুরে গোসল করা। এতে বয়স্কদের চেয়ে আমাদের শিশুদের আনন্দই ছিল বেশি। অনেকে বছরে কেবল ঈদের দিনই সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করার সুযোগ পেত। গোসল শেষে ভেজা পোশাকেই আমরা বাড়ি ফিরতাম। নয়তো ঈদের পোশাক নোংরা কিংবা অন্যের দেখে ফেলার ভয় ছিল।
ঈদগাহে যাওয়ার আগে বাড়িতে প্রথমে খানিকটা মিষ্টিমুখ করে নিত বড়রা। আমাদের ছোটদের অবশ্য খাওয়ার চেয়ে সালামিই ছিল সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
প্রথমে পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য অর্থাৎ দাদা কিংবা দাদির পা ছুঁয়ে সালাম করতেই চকচকে নোটের দেখা মিলত। এরপর বাবা মাকে সালাম করে সালামি আদায় করতে কসুর হতোনা। সালামি আদায়মাত্রই কারও অপেক্ষা না করেই বন্ধুদের নিয়ে আমরা ছুটতাম ঈদগাহে। তখনই প্রথম বন্ধুদের ঈদের পোশাক দেখার সুযোগ হতো। ততোক্ষণে আমাদের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র বন্ধুরা ঈদগাহের পাশে অস্থায়ী দোকান বসিয়ে হাজির।
ঈদের নামাজের আগ পর্যন্ত চলত বন্ধুদের মধ্যে খুনসুটি। নামাজ শেষ করে আমরা ছোটরা কোনক্রমে কোলাকুলি পর্ব সেরেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম জ্যেষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের পায়ে। কারণ তাতে যে সন্ধান মিলবে সালামি নামক মহা আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর।
আদায় করা সালামি দিয়েই ঈদগাহের পার্শ্ববর্তী মেলা থেকে চলত খেলনা সামগ্রী কেনা। তখন টিনের পিস্তল, বারুদের চাকতি, লাদেন বোমা, ইয়ো ইয়ো, মাটির নানা পুতুল আর বাঁশি বেলুনের যুগ ছিল। অন্যদিকে টিনের পিস্তলের সঙ্গে থাকত বারুদ মোড়ানো কাগজ। গুলি করলে ঠুসঠাস শব্দে যে রোমাঞ্চ হতো তা ছিল অতুলনীয়। একইসঙ্গে তালপাতার বাঁশির অনবরত প্যাঁ পোঁ শব্দে বাড়ি মাতিয়ে রাখার যে আনন্দ তারও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না।
সালামির জন্য বাড়ি বাড়ি ভ্রমণ
মেলা থেকে খেলনা কিনে আমরা ঘরে না ফিরেই ছুটতাম বাড়ি বাড়ি। একমাত্র উদ্দেশ্য সালামি আদায়। ঈদগাহে চাচা, জ্যাঠাদের থেকে সালামি আদায় করলেও এবারের লক্ষ্য বাড়ির নারী তথা চাচি জেঠিমাদের থেকে সালামি আদায়। আমাদের শিশু কিশোরের দল দেখে বাড়ির নারীরা মৃদু হেসে রসুই ঘর থেকে বেরোতেন। আর ঠিক তখনই আমাদের মধ্যে কে আগে পা ছুঁয়ে সালাম করতে পারবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হতো। অতঃপর আমাদের বসতে বলে তিনি কিছু খাবার পরিবেশন করতেন। কিন্তু সে খাওয়া কি আর আমাদের মুখ দিয়ে নামবে! যদি না সালামির সন্ধান মেলে। আমরাও খাওয়ার বাহানা করতাম। একপর্যায়ে তিনি আমাদের বসতে বলে শোবার ঘরে ঢুকতেন। ক্ষণিক পরেই কাঠের আলমারি খোলার ক্যাঁৎ শব্দ যে কতোখানি মধুর ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
ঈদের দিনে খাবারের প্রতি আমাদের তেমন কোনো নজর থাকত না। বরং ঈদের দিনে কে কার চেয়ে বেশি সালামি পেয়েছে তা নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। সালামি তোলা শেষে আমরা সে টাকার কিছু অংশ উদারহস্তে ব্যয় করতাম অপেক্ষাকৃত দরিদ্র বন্ধুদের খাওয়ানোর জন্য।
ঈদের পরদিন নানার বাড়ি যাওয়া
আমাদের শৈশব কৈশোরে ঈদের পরদিন নানার বাড়ি যাওয়া চল ছিল। নানার বাড়ি যাওয়ার জন্য আমাদেরও ছিল প্রবল উৎসাহ। কারণ একটিই, সেখানে গেলে পাওয়া যাবে সালামির দেখা। আর মামাতো খালাতো ভাইবোনেরাও প্রতীক্ষায় থাকত সালামির জন্য। অবশ্য যাদের নানার বাড়ি একই গ্রামে ছিল, তারা কিছুটা সৌভাগ্যবানই বলতে হবে; কারণ ঈদের দিনেই তারা নানা-নানী, মামা-মামীর কাছ থেকে সালামি আদায়ের সুযোগ পেত।
তখন ঈদে দূরে বেড়াতে যাওয়ার চল ছিল না। বরং পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলেমিশে একসঙ্গে চলত শৈশব কৈশোরের ঈদ উদযাপন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন আমাদের বয়স বেড়েছে, অনেকাংশেই ফিকে হয়ে এসেছে ঈদ আনন্দ। প্রযুক্তির মেলবন্ধনে পূর্বের সেই নিখাদ আবেগ হারিয়েছে অনেকখানি। তবু শৈশব আর কৈশোরের কোমল মাটির সোঁদা গন্ধের গ্রামের সেই ঈদ আনন্দ রয়ে গেছে স্মৃতির মানসপটে।
Comments