‘সংশোধন নয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির হাতিয়ার এবং এই আইনটি সংশোধন নয়, বাতিল করতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন আইনজীবী, অধ্যাপক ও মানবাধিকারকর্মীরা।
আজ মঙ্গলবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের উদ্যোগে 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: অভিজ্ঞতা ও শঙ্কা' শীর্ষক ওয়েবিনারে এ দাবি জানান তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ ওয়েবিনারে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রতিদিন গড়ে প্রতি মাসে ২৫ জন অভিযুক্ত হচ্ছেন। এসব তথ্য সরকারের কাছে চাইলেও সব পাওয়া যায় না। আমরা সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করি। ২০১৮ সালে আইনটি হওয়ার পর ৪৬৩টি মামলা আমরা ট্র্যাক করতে পেরেছি। সেখানে ১ হাজার ৩৮২ জন অভিযুক্ত। তার মানে গড়ে প্রতিদিন ৪ জন অভিযুক্ত হয়েছেন।'
তিনি বলেন, 'এই আইনের অপপ্রয়োগ বলতে কিছু নেই, এটাই এই আইনের প্রয়োগ। আইনটি এভাবেই করা হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছেন, তারা না বুঝে নিশ্চই এই আইন করেননি।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকার বলার চেষ্টা করে যে তারা মামলা করে না, লোকজন মামলা করলে তারা কী করবে। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার সমর্থক-ক্ষমতাসীন দল সংশ্লিষ্টরা গত সাড়ে ৪ বছরে গড়ে মাসে ৪টি করে মামলা করেছে।'
'জনগণের সুরক্ষার নামে কতিপয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও ক্ষমতাসীনদের সুরক্ষা দিতে তৈরি করা হয়েছে আইনটি। নাগরিকের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, দেশে ভয়–ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করা হয়েছে', যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, 'শুধু এ আইন না, নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা যত ঘনিয়ে আসবে বিভিন্ন আইনের ব্যবহার আরও বাড়বে।'
তিনি বলেন, যে আইন শিশু, নারীসহ নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে পারছে না, সে আইন বাতিলের কোনো বিকল্প নেই।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও বলেন, 'অভিজ্ঞতা স্পষ্ট, পথ সুস্পষ্ট। এই আইন বাতিল করতে হবে। এটি শুধু সাংবাদিকদের দায়িত্ব না, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সামগ্রিকভাবে এই কাজটি করবেন রাজনীতিবিদরা।'
'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় কেউ নিরাপদ নয়' দাবি করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল-১৯ এর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, '২০১৮ সালের অক্টোবরে এই আইন হলো, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৩৪টি মামলা হলো। ২০১৯ সালে ৬৩, ২০২০ সালে ১৯৭, ২০২১ সালে ২৩৮, ২০২২ সালে ১২২টি মামলা হয়েছে। ২০২৩ সালে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ১৬টি মামলা হয়েছে।'
দেশ, গণতন্ত্র ও দল এক না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এটা যদি ধারণা হয় যে একটা আইন দরকার সরকার ও সমর্থকদের রক্ষা করার জন্য, তাহলে মুশকিল। দেশের মালিক জনগণ। সরকারের দায়িত্ব দেশ চালানো। এ ধরনের আইন দিয়ে সরকার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে এবং তা ক্রমেই বাড়ছে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, এ ধরনের অত্যাচার তত বাড়বে বলে আমরা মনে করি।'
এই আইন বাতিল করা উচিত জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'যদি নিশ্চিত করতে পারেন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সরকারের নিরাপত্তার জন্য না, জনগণের নিরাপত্তার জন্য, তাহলে সেরকম একটি আইন থাকা উচিত। যেমন ডিজিটাল মাধ্যমে কারো অর্থ আত্মসাৎ বা বাংলাদেশের ব্যাংকের যে অর্থ হ্যাক করে নিয়ে গেল—এগুলোর জন্য আইন থাকতে পারে। কিন্তু, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা থাকে না।'
ফারুখ ফয়সল বলেন, 'আগামী নির্বাচনের আগে আরও ৩টি আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে—উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ওটিটি নীতিমালা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রবিধান। এগুলোতে জনগণের একদম বারোটা বেজে যাবে। কে কী করে না করে, সবকিছু সরকারের খাতায় থাকবে। ভয়ের সংস্কৃতির কারণে স্বনিয়ন্ত্রণ শুধু সাংবাদিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, সবার মধ্যেই আছে।'
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন বলেন, 'যেখানে গণতন্ত্র আছে, যেখানে মানবাধিকার প্রয়োগ করা হয়, সেখানে এই ধরনের আইন আর নেই। বাংলাদেশে সংবিধানের ৫০ বছর পূর্তির বছরে আমরা কেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আকরে ধরে আছি সেটি একটি বড় প্রশ্ন।'
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, মামলাগুলো করছে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ও ক্ষমতাসীনরা। আইনটি সংশোধনের বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এটা বাতিল করতে হবে।
কোনো আইন প্রণয়নের আগে তা নিয়ে সংসদে যথাযথ আলোচনা হয় না উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, 'পশ্চিমা বিশ্বে মানহানি, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ ও অনুভূতিতে আঘাত লাগার মতো বিষয়কে ফৌজদারি অপরাধ থেকে ১৮৫০ সালের পর বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখানে একটি কথা বলার জন্য বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একাধিক মামলা হচ্ছে।'
এই আইন নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে দ্য ডেইলি স্টার বাংলার সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন, 'এর বিষয়ে একমাত্র দাবি হওয়া উচিত, এটি বাতিল করতে হবে।'
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে এই আইন নিয়ে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা তুলে ধরে সংগঠনটির বাংলাদেশ ও পাকিস্তান কান্ট্রি স্পেশালিষ্ট সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, '২০১৮ সালের অক্টোবরে আইনটি পাশ হওয়ার পর নভেম্বরেই আমরা একটি বিস্তারিত রিভিউ প্রকাশ করি। সেখানে উল্লেখ ছিল, এই আইনের কোন কোন ধারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।'
তিনি বলেন, 'আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, এই আইনটি বাতিল করতে হবে, কিংবা এমনভাবে সংশোধন করতে হবে, যেন তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'এই আইনে অপরাধগুলোকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে অনলাইনে মত প্রকাশ করা হলে সেটাকে কোনো না কোনোভাবে ক্রিমিনালাইজড করার সুযোগ থাকে। এখানে ডিফেমেশনকে অপরাধ হিসেবে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে এটা দেওয়ানি অপরাধ হিসেবে বিচার করা হলেও আমাদের এখানে এটিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করেছি। এর পাশাপাশি এটি জামিন অযোগ্য। মামলার শিকার হয়ে কেউ যদি দীর্ঘদিন জেল খেটে পরে নির্দোষ প্রমাণিত হন, তখন তার প্রতিকার কী হবে?'
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে আইনটি নিয়ে অ্যাডভোকেসী করা হয়েছে এবং ২০২১ সালের জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বিস্তারিত লিখে চিঠি দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত এই আইনটি সংশোধন বা বাতিলের কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।'
অধ্যাপক স্বপন আদনান বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশকে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, শাস্তিযোগ্য অপরাধ বানানো হচ্ছে। এগুলো যদি অপরাধ হয়ে যায়, তাহলে একটি গণতান্ত্রিক সমাজে আলোচনা কীভাবে চলবে? যেখানে একনায়কতন্ত্র নেই, সেখানে তো ভিন্নমত থাকবেই এবং একে অপরের বিরুদ্ধে যৌক্তিক অভিযোগ আনতেই পারেন। সেটাকে যদি ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের মতো ঠুনক অভিযোগের আওতায় আনা হয়, তাহলে ভিন্নমত প্রকাশকেই নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে এবং অপরাধ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।'
গবেষক মুশফিক ওয়াদদু বলেন, 'সাংবাদিকতার যে ওয়াচ-ডগ ভূমিকা সেটা রাখতে পারেনি। তার একটি বড় কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইন ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের সাংবাদিকদের মধ্যে। আমাদের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, যে বিষয়টি সাংবাদিকদের সমস্যায় ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সেটা নিয়ে তারা লিখছেন না। অর্থাৎ, সাংবাদিকেরা স্বনিয়ন্ত্রণে যাচ্ছেন। এর প্রভাব সাংবাদিকতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হবে।'
সভাপতির বক্তব্যে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি নিবর্তনমূলক আইন, কালো আইন। এই আইন থাকাই সমস্যা। কারণ, এটি আমাদের সবার মাথার ওপর খড়গ হিসেবে আছে। এটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার একটি হাতিয়ার।'
তিনি বলেন, 'আমরা যদি এর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার না হই, তাহলে এমন দিন আসতে পারে, যেদিন আমাদের পাশে আর দাঁড়ানোর মতো আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো অসাংবিধানিক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া।'
ফোরামের পক্ষ থেকে মাহমুদুল হাসানের কো-অর্ডিনেশনে ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক মনির হায়দার।
Comments