র্যাগিং বন্ধে এখনো কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারেনি ইউজিসি
কোনো নীতিমালা না থাকার সুযোগে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাধে চলছে র্যাগিং নামে নীপিড়ন। আর এই সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও যেন উদাসীন।
উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে 'আদব-কায়দা' শেখানোর নামে এক মর্মান্তিক নীপিড়নের নাম র্যাগিং। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা নতুন শিক্ষার্থীদের ওপর সিনিয়র শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন আর হয়রানির নাম র্যাগিং। অপমান, নিপীড়ন আর নির্যাতনের এই প্রভাব ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন।
শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য র্যাগিংয়ের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়ে আসছেন। অপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ধরনের ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এখনো এরকম কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারেনি। ফলস্বরূপ, অপরাধীরা যাদের বেশিরভাগ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে নতুন শিক্ষার্থীদের ওপর র্যাগিং করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সব অধিভুক্ত পাবলিক, প্রাইভেট এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সংস্থা ইউজিসি। যার কাজ সারা দেশে উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করা।
হলগুলোতে আসন সংকটের সুযোগ নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা 'গণরুমে' নতুনদের জন্য আসনের ব্যবস্থা করে দেয়। নতুন শিক্ষার্থীদের ওপর র্যাগিং চলে মূলত সেখানেই। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা জানান, হলের গেস্ট রুমেও এই অপরাধ হয়।
গণরুমগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন। নতুন শিক্ষার্থীরা যারা হলে আসন পান না তাদের এই রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় তারা। ৮ জনের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও এসব কক্ষে ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থীকে থাকতে হয়।
অন্যদিকে হলের গেস্ট রুমকে দর্শনার্থীদের জন্য ওয়েটিং রুম হিসেবে বোঝানো হয়। তবে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নবীন শিক্ষার্থীদের জোর করে এসব গেস্টরুমে যেতে বাধ্য করে যেখানে তাদের সিনিয়রদের কেমন করে 'সম্মান' জানাতে হয় শেখানো হয় এবং ডাইনিং হল ও টিভিরুমে তাদের অবস্থান কোথায় হবে তা জানানো হয়।
অনেক ক্ষেত্রে, যারা তাদের নির্দেশ মানতে ব্যর্থ হয় বা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকে, গেস্টরুমে তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, হলে সিট সংকট থাকার কারণেই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন নীপিড়ন, র্যাগিংসহ অন্যান্য অপরাধগুলো করার সুযোগ পায়।
যেহেতু হল কর্তৃপক্ষ তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করে না, তাই শিক্ষার্থীরা প্রয়োজন এমনকি মেধার ভিত্তিতেও হলগুলোতে আসন পায় না। ফলস্বরূপ, তারা (নতুনরা) ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ছাত্র সংগঠনের মর্জির ওপর জিম্মি হয়ে পড়ে।
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, আসন সংকটের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী হল সুবিধা পায় না। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৬ শতাংশ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৮ শতাংশ এবং হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর একই অবস্থা।
এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়েই সম্প্রতি র্যাগিংয়ের শিকার হতে হয়েছে নবীন শিক্ষার্থীদের।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরী খাতুনকে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী নির্যাতনের পর র্যাগিংয়ের বিষয়টি আবার সামনে আসে।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ফুলপরী অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগ নেত্রীদের 'অনুমতি' না নিয়ে হলে অবস্থান করায় সানজিদা চৌধুরী ও তাবাসসুম ইসলামসহ ছাত্রলীগ নেতারা গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে তাকে নির্যাতন করেন।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে প্রথম বর্ষের এক অনাবাসিক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের গেস্ট রুমের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকায় শারীরিক নির্যাতন করা হয়।
ভুক্তভোগী আক্তারুল ইসলামের লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হল কর্তৃপক্ষ তিন শিক্ষার্থীকে হল থেকে বহিষ্কার করে।
হাবিপ্রবিতে র্যাগিংয়ের শিকার স্থাপত্য বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসান গত ২২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার দুই সপ্তাহ পর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান।
এর ঠিক দুই দিন আগে শাবিপ্রবির সৈয়দ মুজতবা আলী হলে ১০ থেকে ১৩ জন নবীন শিক্ষার্থী ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের সিনিয়র শিক্ষার্থীদের কাছে র্যাগিংয়ের শিকার হন।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজন পরদিন ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এ ঘটনায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি পাঁচ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে শাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন বলেন, আদব-কায়দা শেখানোর নামে কাউকে অসম্মান ও অপমান করা অবশ্যই র্যাগিং।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ এনান দাবি করেন, গেস্টরুমে এ ধরনের কর্মকাণ্ড হয় না। সিনিয়র এবং জুনিয়ররা সেখানে সাংস্কৃতিক বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে।
'কেউ র্যাগিংয়ে জড়িত থাকলে আমরা তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিই। ছাত্রলীগ সব ক্যাম্পাসে র্যাগিংবিরোধী প্রচার চালাচ্ছে.' বলেও দাবি করেন তিনি।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, র্যাগিংয়ের কারণে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এতে করে তারা পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারে না, অনেক সময় ক্লাসেও অনুপস্থিত থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'র্যাগিংয়ের কারণে ট্রমা হতে পারে, যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব থাকতে পারে। র্যাগিংয়ের শিকার ব্যক্তির গুরুতর মাত্রার উদ্বেগে ভোগার পাশাপাশি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারও (পিটিএসডি) হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, র্যাগিংয়ের শিকার কেউ ট্রমা থেকে বের হতে না পারলে অনেক সময় পড়ালেখা ছেড়ে দেয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে র্যাগিংবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
যোগাযোগ করা হলে, ইউজিসি সচিব ফেরদৌস জামান বলেন, 'সরকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি অ্যান্টি-র্যাগিং নীতি প্রণয়নের জন্য কাজ করছে। আমাদের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি কেন্দ্রীয় নীতি প্রণয়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে যাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনো ধরনের সমস্যা, হয়রানির সম্মুখীন না হয়।'
তিনি আরও জানান, ক্যাম্পাসগুলোতে র্যাগিং বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন নামে সারা বিশ্বে র্যাগিং একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকট। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ২০০৯ সালে টোল-ফ্রি অ্যান্টি-র্যাগিং হেল্পলাইন চালু করে ভারতের ইউজিসি।
Comments