গাছ কান্নাও করে

গাছের যখন পানির দরকার পড়ে বা কোনোকিছুর কারণে চাপ অনুভূত হয়, তখন গাছ থেকে নির্গত হয় এক ধরনের বায়ুজাত শব্দ। ছবি: লাইলাক হাদানি

বহু বছর আগে এসকোনোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে স্যার জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করেছিলেন, গাছেরও প্রাণ আছে। তিনি এও দেখিয়েছিলেন যে, গাছের নির্দিষ্ট জীবনদশা আছে, তারা বংশবিস্তারে সক্ষম এবং নিজেদের পরিপার্শ্ব নিয়ে সচেতন। কিন্তু গাছের অন্যান্য অনুভূতি, ভালো লাগা-মন্দ লাগা এবং অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ নিয়েও ভাবনার অবকাশ রয়েছে।

গাছের শুধু যে প্রাণ আছে, তাই নয়– গাছেরা কান্নাও করে। অন্তত এমনটাই জানা গেছে বৈজ্ঞানিক জার্নাল 'সেল'-এ সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র থেকে। গাছের যখন পানির দরকার পড়ে বা কোনোকিছুর কারণে চাপ অনুভূত হয়, তখন গাছ থেকে নির্গত হয় এক ধরনের বায়ুজাত শব্দ। কিন্তু সে শব্দ আলট্রাসনিক বা মানুষের শ্রবণের অতীত হওয়ার কারণে মানুষ তা শুনতে পায় না। নয়ত পোষা প্রাণীদের মতো তারা হয়ত গাছের সাহায্যের ডাকেও সাড়া দিতে পারত। এই শব্দের সীমা হচ্ছে ২০ থেকে ১০০ কিলোহার্টজ। মানুষের জন্য শ্রুতিযোগ্য না হলেও প্রকৃতিতেই বেড়ে ওঠা কিছু প্রাণী হয়ত এ শব্দ শুনতে সক্ষম। এদের মধ্যে বাদুর, ইঁদুর এবং কীটপতঙ্গ থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। মজার বিষয় হচ্ছে, এই একই গবেষণা দল পূর্বে প্রমাণ করেছিল যে, গাছেরা প্রাণীর শব্দে সাড়া দিতে সক্ষম।

এ বিষয়ে আগের গবেষণা থেকে জানা গিয়েছিল যে, কোনো ধরনের সমস্যা হলে গাছে একরকম কম্পনের সৃষ্টি হয়, কিন্তু এই কম্পনগুলো যে শব্দে রূপান্তর সম্ভব, তা তখনো বোঝা যায়নি। তর্ক-বিতর্ক বহাল ছিল। এসব তর্কের মীমাংসা ঘটাতে এবার বৃক্ষ জগতে আড়িপাতাতে গিয়েছিলেন ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইলাক হাদানি এবং তার সহকর্মীরা। তারা তামাক ও টমেটো গাছের ওপর এ সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। ছোট ছোট বাক্সে এসব গাছ পুঁতে রেখে তারা তাতে এ আশায় মাইক্রোফোন সংযুক্ত করে দেন যে, নিজেরা শুনতে না পেলেও যন্ত্রে অন্তত শব্দগুলো ধরা পড়বে। হতাশ হতে হয়নি তাদের। সুরেলা কোনো গান না গাইলেও গাছেরা যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শব্দের মাধ্যমে নিজেদের আর্তি প্রকাশ করে, সেটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এ বিষয়ে গবেষক হাদানি বলেন, 'কোনো সমস্যায় না থাকা, চাপমুক্ত গাছেরা প্রতি ঘণ্টায় গড়ে একবারেরও কম শব্দ করে। অন্যদিকে, পানিশূন্য বা আঘাতপ্রাপ্ত গাছের ক্ষেত্রে শব্দ প্রকাশের পরিমাণ অনেক বেশি।'

এমনকি পানিশূন্যতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছানোর পর এ শব্দ একেবারেই থেমে যায়। অনেকটা মানুষের মতো, যেমন- দুর্বলতার চরম সীমায় পৌঁছলে মানুষ আর সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা না করে অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়, তেমন আচরণ গাছের ক্ষেত্রেও দেখা যায়।

কিন্তু এই নতুন আবিষ্কার কি পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য আলাদা কোনো সংকেত বহন করছে? প্রকৃতি ও প্রাণের ওপর কি এর কোনো প্রভাব পড়ে? এ বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কিছু জানতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তবে এই নতুন জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মানুষও লাভবান হতে পারে।

হাদানির ভাষ্যমতে, 'গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে জানা গেছে যে, আমাদের আশপাশের জগত বহু উদ্ভিদসৃষ্ট শব্দে পরিপূর্ণ এবং এসব শব্দ বিভিন্ন তথ্যও বহন করে, যেমন- গাছে পানিশূন্যতা বা কোনো ধরনের আঘাত থাকলে সে বিষয়ে তথ্য জানানোর একটা চেষ্টা থাকে এতে।'

তিনি মনে করেন, সঠিক সরঞ্জামের মাধ্যমে এসব শব্দ চিহ্নিত করা গেলে কখন কোন গাছে পানি বা যত্নের প্রয়োজন, তা নিয়ে সচেতন হওয়া যাবে। যাদের বাগান বা ক্ষেত-খামার আছে, তাদের জন্য এ ধরনের প্রযুক্তি অত্যন্ত সহায়ক হবে।

এ বছরের অস্কারজয়ী সিনেমা 'এভ্রিথিং এভ্রিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স' সিনেমার একটি সংলাপ হচ্ছে– 'প্রতিটি নতুন আবিষ্কারই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা কতটা তুচ্ছ এবং অবুঝ'। আসলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে যত নতুন আবিষ্কার আসে, যত নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়– ততই আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের চেনা জগতেও অনেক অজানা-অচেনা রহস্য রয়ে গেছে। ঠিক যেমন এখনো আমরা জানি না, হরেক রঙের ফুলে ভরে থাকা শস্যখেত বা সারি সারি টিউলিপের মাঝে কাটানো সময়ে কত গাছ আমাদের অজান্তে কান্না করেই যাচ্ছে।

তথ্যসূত্র:

সিবিএস নিউজ, সায়েন্টিফিক আমেরিকান ডট কম ও ইন্ডিয়া টুডে

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

9h ago