সার্কাডিয়ান রিদম কী, যেভাবে কাজ করে

সার্কাডিয়ান রিদম কী, যেভাবে কাজ করে
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীতে বসবাসকারী তাবত প্রাণীরা মিলে দাসত্ব করে চলেছি একটি ঘড়ির। সে ঘড়ি দেয়ালে টাঙানো বহুদিন পুরনো গ্র্যান্ডফাদার ক্লক বা ক্রিং ক্রিং অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙানো ঘড়ি নয়। এ ঘড়ির নাম বায়োলজিক্যাল ক্লক বা দেহঘড়ি। যার সময়ের 'টিক টিক' গণনায় আমরা চলছি রাত-দিন, সন্ধ্যা-দুপুর। 

মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে অবস্থানকারী সুপ্রাকিয়াসম্যাটিক নিউক্লিয়াস হচ্ছে ২০ হাজার কোষের একটি বিশাল দল, যা এই 'ঘড়িগুলোকে' পরিচালনা করে।

আমাদের ঘুমিয়ে পড়া, জেগে ওঠা, শরীরের তাপমাত্রা থেকে শুরু করে মনের আবহাওয়া, সর্বপ্রকার খিদের ব্যাকরণ– সবই ধরা আছে এই ঘড়ির কাঁটার ঘেরাটোপে। ঘুমিয়ে পড়লে দেহের তাপমাত্রা হ্রাস পায়, জেগে থাকা অবস্থায় তা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে। আর এই নিয়মের ছন্দকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় নাম দেওয়া হয়েছে 'সার্কাডিয়ান রিদম'। ল্যাটিন ভাষার 'সার্কাডিয়ান' শব্দের অর্থ দাঁড়ায় 'দিনভর'; কেন না দিনভরই চলতে থাকে এর গতিময় চলাচল।

ব্যক্তিভেদে ভিন্নতা

ব্যক্তির জীবনযাত্রার ধরন, পেশা, মানসিক ও শারীরিক অবস্থা এমনকি বয়স– এই সবগুলো বিষয়ই তার সার্কাডিয়ান রিদমে প্রভাব ফেলে। যেমন একজন ব্যাংকার ও রাতপ্রহরীর সার্কাডিয়ান রিদম এক হবে না, কেন না তাদের পেশার ধরন ও সময়সূচি সম্পূর্ণ আলাদা। সেভাবেই একজন সদ্যোজাত শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক কর্মজীবী বা অবসরপ্রাপ্ত বয়োঃবৃদ্ধের সার্কাডিয়ান রিদমও আলাদা আলাদা হবে। কেন না বয়সভেদে ব্যক্তির ঘুমের চাহিদা ভিন্ন থাকে। 

কে নিশাচর, আর কে দিনের সওদাগর– এর উত্তরও ধরা থাকে যার যার নিজস্ব সার্কাডিয়ান রিদমে। আগেকার দিনের মানুষ ভাবতো, এই ছন্দটি দিবালোকের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ১৯৩৮ সালের দিকে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। 

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আক্ষরিক অর্থেই এক 'ঘুম বিশেষজ্ঞ' নাথানিয়েল কিটম্যান ও ব্রুস রিচার্ডসন নামে তার এক সহকারী মিলে কেন্টাকি পর্বতে ম্যামথ গুহায় আশ্রয় নেন। তারা সেখানে টানা ৩২ দিনের জন্য আঁধারি জীবন বেছে নেন। এই পরীক্ষাটির উদ্দেশ্য ছিল, বাহ্যিক আলো বা অন্যান্য সংকেতের উপস্থিতি না থাকলেও সার্কাডিয়ান রিদম ঠিকঠাক কাজ করে কি না। এবং মাসব্যাপী এই গবেষণাতে তারা দেখতে পেলেন, দিবালোকের প্রভাব ছাড়াই তাদের দেহের তাপমাত্রা ওঠানামা করে, জাগরণ ও ঘুমের বিষয়টিও চলমান থাকে। তবে এই সময়সীমাটি 'দৈনিক' হলেও কাঁটায় কাঁটায় আমাদের মেপে নেওয়া ঠিক ২৪ ঘণ্টার নয়। তাই ধীরে ধীরে তারা এই সময়সীমাটিকে ২৪ থেকে ২৮ ঘণ্টার ধরে নেন। 

আমাদের দেহঘড়ির সময়সূচিতে প্রভাব রাখে মেলাটোনিন ও কর্টিসোলের মতো হরমোনগুলো। মেলাটোনিন নিঃসরণের ফলে আমাদের ঘুম পায়, বিপরীতভাবে কর্টিসোলের নিঃসরণ আমাদের দেহকে আরও সতর্ক করে রাখে– আর এর ফলাফল হচ্ছে জাগরণ। সাধারণত রাতের বেলা মেলাটোনিনের নিঃসরণ বেশি হবার ফলে রাতের বেলাই ঘুমের সময় বলে ধরে নেওয়া হয়। 

মূলত বহুদিনের অভ্যাসগত চর্চার কারণে এ নিয়ম। এখন কোনো ব্যক্তি যদি বেশ কিছুদিন ধরে রাতে জেগে থাকার অভ্যাস করেন, তবে তার সার্কাডিয়ান রিদমে পরিবর্তন ঘটবে। মেলাটোনিনের নিঃসরণও রাতের বদলে দিনের বেলায় বেশি হবে। তার মানে দেহঘড়িই যে শুধু আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তা নয়– উল্টোটাও সম্ভব। 

তবে উল্টোটা হবার কারণে আমাদের জীবনে উল্টো কিছু প্রভাব পড়াও স্বাভাবিক। কেন না দিন মানেই কর্মব্যস্ত জগৎসংসার, আর রাতকে ধরা হয় বিশ্রামের সময়। কেউ যদি দিনকে বিশ্রামের সময় ধরে নিতে চান, তবে জীবনের অন্য সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে তাকে ঝক্কি পোহাতে হবে– এতে সন্দেহ নেই। আর তার ফলে পরিপূর্ণ বিশ্রামও হয়তো সম্ভব হবে না। রাত জাগা মানবরূপী 'প্যাঁচা'দের তাই একটু বিপদেই পড়তে হয়। 

দেহঘড়ি বিগড়ে গেলে

বিমানযাত্রায় জেট ল্যাগের মতো বিশেষ পরিস্থিতির মাঝে মাঝেই বিগড়ে দিতে পারে আমাদের দেহঘড়ি তথা সার্কাডিয়ান রিদমের নিয়মিত গতিকে। নিজস্ব পরিবেশ বা রুটিনের বাইরে গেলে এমনটা হয়। আবার অনেক সময় নিজের অবহেলার কারণেই হয়তো জড়িয়ে পড়া হয় অস্বাস্থ্যকর সময়সূচিতে। 

সেক্ষেত্রে সুস্থ সার্কাডিয়ান রিদমে ফিরে আসতে কিছু পদ্ধতি কাজে লাগানো যায়। টানা কয়েকদিন একই সময়ে ঘুমিয়ে পড়া, একই সময়ে কর্মব্যস্ত সময় বের করা, ঘুমের পরিবেশ আরামদায়ক করে তোলা, নিয়মিত কিছু সময় ব্যায়াম বা শারীরিক চর্চা ইত্যাদি ছোট ছোট বিষয়ে খেয়াল করলে দেহঘড়িকে আবারও সারিয়ে তোলা যাবে। আরেকটি ভালো বুদ্ধি হচ্ছে দুপুরে বা বিকেলের ঘুমের অভ্যাস ত্যাগ করা, এতে করে রাতে ঠিক সময়ে ঘুম চলে আসবে। 

এ ছাড়া, ঘুমের আগে কিছুক্ষণ মেডিটেশন বা ধ্যান করলে বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলো দূরে সরে যায়, মনও শান্ত হয়। 

এসব বিষয়ে সচেতন থেকে নিজের 'দেহঘড়ি'র নিয়মিত যত্ন রাখুন। সার্কাডিয়ান রিদমের সুরেলা ছন্দে বাজুক জীবনযাপন।

তথ্যসূত্র: ন্যাশনালজিওগ্রাফি, হেলথলাইন, সায়েন্সফোকাস

 

Comments

The Daily Star  | English

Finance adviser sees no impact on tax collection from NBR dissolution

His remarks came a day after the interim government issued an ordinance abolishing the NBR and creating two separate divisions under the finance ministry

1h ago