‘সামরিক শাসনের সময়ও দেখিনি যে পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করেছে’

আইনজীবী পেশায় যে অর্জনটা ছিল, সেটা গতকাল আমরা বিসর্জন দিয়েছি। আমি নিজে লজ্জিত।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ছিল গতকাল বুধবার। নির্বাচনটিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে কথা–কাটাকাটি, ধাক্কাধাক্কি হয়। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, পুলিশ সাংবাদিক ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের পিটিয়ে মিলনায়তন থেকে বের করে দেয়।

গতকাল দেশের সর্বোচ্চ আদালত ভবনের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার সঙ্গে।

আইনজীবী জহিরুল ইসলাম খান পান্না সবার কাছে পরিচিত জেড আই খান পান্না নামেই। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বেশ কয়েকবারের নির্বাচিত সদস্য। আইনজীবী ও সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

মানবাধিকার সংগঠন 'ব্লাস্ট' এর প্রতিষ্ঠাকালীন এই সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন 'আইন ও সালিশ কেন্দ্র'র চেয়ারপার্সনের।

 

দ্য ডেইলি স্টার: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের একটা ঐতিহ্য ছিল। গতকাল কি এমন ঘটল যে পুলিশ নির্দয়ভাবে সাংবাদিক ও আইনজীবীদের পেটালো?

জেড আই খান পান্না: আইনজীবী পেশায় যে অর্জনটা ছিল, সেটা গতকাল আমরা বিসর্জন দিয়েছি। আমি নিজে লজ্জিত। আমাদের অবস্থাটা এমন কেন হলো, আমি জানি না। ট্রেড ইউনিয়নের বেলায়ও আমাদের একটা ঐতিহ্য ছিল। সেটা পুরোপুরি জলাঞ্জলি দিয়েছি। আমি মর্মাহত, আমি লজ্জিত। আমরা সবকিছু জলাঞ্জলি দিলাম।

ডেইলি স্টার: এই জলাঞ্জলিতে কি আইনজীবীরা সহায়তা করেছেন?

জেড আই খান পান্না: আইনজীবীরা না, আইনজীবীদের ভেতরে একটা স্বার্থন্বেসী মহল সহায়তা করেছে।

ডেইলি স্টার: স্বার্থন্বেসী মহল বললে কি মানুষ কিছু বুঝতে পারে?

জেড আই খান পান্না: অবশ্যই পারে। এ দেশের সব মানুষ কি খারাপ নাকি? ব্যাংকলুটেরা কয়েকজন, লুটপাট করেছে কয়েকজন। তারা একটা নগণ্য গোষ্ঠী। সাধারণ মানুষ এর জন্য দায়ী না। একইভাবে সাধারণ আইনজীবীরাও এমন চান না।

ডেইলি স্টার: আওয়ামী লীগ বা বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী প্যানেল আগে থেকেই ছিল। সেটা কি একটি ভিন্ন মাত্রায় চলে গেল? যেভাবে মাঠে ২ দলের সমর্থকরা বা ক্যাডাররা মারামারি করে, এখন কি আইনজীবীরাও তাই করবেন?

জেড আই খান পান্না: রাজনীতি আইনজীবীদের পেশার একটি অঙ্গ। বরাবর আইনজীবীরাই রাজনীতি করেছেন। এখন আর আইনজীবীরা রাজনীতি করেন না। রাজনীতি চলে গেছে লুটেরাদের হাতে। উভয় দলেই একই অবস্থা।

দল যারা করতেন, তারা বার অ্যাসোসিয়েশনের ক্ষেত্রে এসে একটি ঐক্যমতে থাকতেন। তারা শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখতেন না। আইনের শাসন, শাসনতন্ত্রকে তুলে ধরা, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা আইনজীবীরাই বলতেন। মানবাধিকার রক্ষার কথা আইনজীবীরাই বলতেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা আইনজীবীরাই বলতেন। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আইনজীবীদের শক্ত ও অগ্রণী ভূমিকা ছিল।

এবার দেখলাম এর সবকিছুরই জলাঞ্জলি হয়ে গেছে। সামরিক শাসনের সময়ও দেখিনি যে পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করেছে।

এটাই একমাত্র জায়গা ছিল, যেটা মানুষকে আশার আলো দেখাত এবং যেখানে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ছিল। বরাবর এখানে নির্বাচনে স্বচ্ছতা ছিল। সেটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো। অবশ্য প্রশ্নবিদ্ধ না, একেবারে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হলো। কবর দিয়ে দেওয়া হলো।

ডেইলি স্টার: গতকাল কী এমন ঘটনা ঘটল বা সাংবাদিকরা কী এমন অপরাধ করেছে যে, তাদের ওপর পুলিশ আক্রমণ করল?

জেড আই খান পান্না: সাংবাদিকদের অপরাধ হচ্ছে, তারা চোখের সামনেই সত্যটা দেখছিলেন। ক্যামেরায় ধারণ করছিলেন। সেই সত্য যদি প্রকাশ করে দেন?

ডেইলি স্টার: সত্যটা কী ছিল?

জেড আই খান পান্না: সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে পুলিশ ঢুকেছে। পুলিশ ঢুকেছে কারো না কারো পক্ষ নিয়ে। কে ঢুকালো তাদের? আমার যদি ভুল না হয়, ভুল হলে ক্ষমা চাই, সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে প্রধান বিচারপতির অনুমতি ছাড়া পুলিশ ঢুকতে পারে না। এটা নিয়ে কোনো আইন নেই, কিন্তু এটা একটা পরম্পরা। প্রধান বিচারপতির পূর্বানুমতি ছাড়া কখনোই পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে ঢুকতো না। তারা গেটে বা অন্যান্য জায়গায় থাকত। আর বার অ্যাসোসিয়েশনের ভেতরে তো পুলিশকে কখনোই ঢুকতে দেখিনি, কখনোই না। বার অ্যাসোসিয়েশনের ইতিহাসে এই প্রথম এমন কিছু হলো।

ডেইলি স্টার: সাংবাদিকদের অপরাধ কি শুধুই এটা যে তারা সত্যটা দেখলেন এবং ভিডিও ধারণ করলেন?

জেড আই খান পান্না: আমি শুধু এটাই বুঝি যে সাংবাদিকরা যেন সত্যটা প্রকাশ না করেন, সেটাই চেষ্টা করা হয়েছে।

ডেইলি স্টার: পুলিশ মাঝে মাঝেই সাংবাদিকদের পেটায়। এই ধারাটা কি অব্যাহতই থাকবে? আইনের মাধ্যমে এ বিষয়ে পুলিশকে ঠেকানোর কোনো পথ থাকবে না?

জেড আই খান পান্না: এই যে বেধড়ক পেটানো বা অত্যাচার, এটা তো মূলত ব্যুরোক্রেটিক অ্যাটিচিউড। এর বিরুদ্ধে আমরা এখনো লড়াই করি।

এসব দেখে আমি মানসিকভাবে এত বিপর্যস্ত, কিছুই বলার আর ভাষা পাচ্ছি না।

তারা অতীত থেকে শিক্ষা নিক। যদিও কেউ নেয় না। স্পেশাল পাওয়ার ১৯৭৪ করেছিল আওয়ামী লীগ। সেটার জন্য সবচেয়ে বেশি ভুগেছিল তারা। র‌্যাব গঠন করেছিল বিএনপি। সেই র‌্যাবের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ভুগেছে তারাই। এখন বিএনপি র‌্যাবের বিলুপ্তি চায়।

ডেইলি স্টার: গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, সাংবাদিক ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের বের করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের ভোটগ্রহণ হলো। এটা কেমন শোনায়?

জেড আই খান পান্না: কি বলব আর। আমার বলার কিছু নেই। এটাই একমাত্র জায়গা ছিল, যেটা মানুষকে আশার আলো দেখাত এবং যেখানে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ছিল। বরাবর এখানে নির্বাচনে স্বচ্ছতা ছিল। সেটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো। অবশ্য প্রশ্নবিদ্ধ না, একেবারে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হলো। কবর দিয়ে দেওয়া হলো।

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশে একটি ঘটনা ঘটলে তার সুষ্ঠু বিচার হয় না। এরপর সেটার সমাধান আমরা করি এই ভাবে যে, যা হওয়ার হয়ে গেছে, নতুন করে শুরু করি। ফলে কোনো কিছুর তদন্তই ঠিকভাবে হয় না। গতকালের ঘটনায় কিছু করার আছে বলে মনে করেন? নাকি এটাও ধরে নিতে হবে যে, যা হওয়ার হয়ে গেছে, নতুন করে শুরু করি।

জেড আই খান পান্না: না, যা ঘটার তা ঘটে গেছে। আমার মনে হয় না ঐতিহ্যের জায়গায় ফিরে যাওয়াটা খুব সহজ হবে। কারণ, এরপর যদি বিএনপি কোনো দিন ক্ষমতায় আসে, তারাও এই ব্যবহারটা করবে। সেক্ষেত্রে তারা উদাহরণ দেবে, ওই সময়ে এই ঘটনাটা ঘটেছিল।

ডেইলি স্টার: একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে আপনিও তাহলে খুব বেশি আশাবাদী নন…

জেড আই খান পান্না: গতকালের ঘটনার পর আমি মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পরেছি। এর আগে কখনো হতাশ ছিলাম না। গতকালের ঘটনা আমাকে হতাশ করে দিয়েছে।

ডেইলি স্টার: এই ঘটনায় কি সুপ্রিম কোর্ট, আইনজীবী, বিচারপতি, প্রধান বিচারপতি বা অন্য কারো কোনো ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ আছে?

জেড আই খান পান্না: অবশ্যই সুযোগ আছে। সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট সুয়োমোটো রুল ইস্যু করতে পারে। হাইকোর্ট ডিভিশনের প্রত্যেক বিচারপতির এই এখতিয়ার আছে।

ডেইলি স্টার: তারা সেটা করবেন কি না, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে?

জেড আই খান পান্না: সেটা তারা করবেন না, এটুকু আমি বুঝি।

আমি একটু আবেগপ্রবণ মানুষ। গতকাল এই মারপিটের ভিডিও দেখে কান্না করেছি। নিজেকে আইনজীবী পরিচয় দিতে আমার লজ্জা লাগছে। আমি যে ভবনে থাকি, এখানে ৩৬টি পরিবার থাকে। তারা আমাকে যে সম্মান করত, গতকালের ঘটনার পর তারা আমাকে আর সেই সম্মান করবে বলে মনে হয় না। (কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন জেড আই খান পান্না)

ডেইলি স্টার: পুলিশ ঘটনার সামনে ছিল। কিন্তু, যারা নেপথ্যে থেকে এই ঘটনা ঘটালেন, তাদের আমরা চিনি কিন্তু নাম প্রকাশ করি না।

জেড আই খান পান্না: যারা পুলিশের এই কাজকে সমর্থন করছেন, তারাই তো এই ঘটনা ঘটিয়েছেন।

ডেইলি স্টার: তাদের উদ্দেশে আপনার কিছু বলার আছে?

জেড আই খান পান্না: তারা অতীত থেকে শিক্ষা নিক। যদিও কেউ নেয় না। স্পেশাল পাওয়ার ১৯৭৪ করেছিল আওয়ামী লীগ। সেটার জন্য সবচেয়ে বেশি ভুগেছিল তারা। র‌্যাব গঠন করেছিল বিএনপি। সেই র‌্যাবের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ভুগেছে তারাই। এখন বিএনপি র‌্যাবের বিলুপ্তি চায়। এই ২টি উদাহরণ আমি দিলাম।

এটা হয়েছে কোথায়? বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে, সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের নির্বাচনে। এখানে যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে সারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হবে?

ডেইলি স্টার: বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে যাদেরকে পিটিয়ে বের করে দেওয়া হলো, তারা নতুন করে নির্বাচন দাবি করছেন। এখানে কি সামান্যতম কোনো সম্ভাবনা দেখেন, তদন্ত বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় হারানো সম্মান ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার?

জেড আই খান পান্না: এখন তো কোনো কিছুই নিরপেক্ষ না। তবে সত্য আছে একটা। সত্যটা কখনো কারো পক্ষে যেত পারে বা বিপক্ষে যেতে পারে। গতকালের সত্য হচ্ছে, এটা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপক্ষে, আইনের শাসনের সম্পূর্ণ বিপক্ষে, সম্পূর্ণ বেআইনি কার্যকলাপ।

আর এটা হয়েছে কোথায়? বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে, সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের নির্বাচনে। এখানে যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে সারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হবে? এটা খুবই চিন্তার বিষয়। যদি কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার।

ডেইলি স্টার: কোনো ব্যবস্থা যে নেওয়া হবে, সে ব্যাপারে আপনি আশাবাদী নন বলে মনে হচ্ছে।

জেড আই খান পান্না: কোথাও তো দেখি না। গতকাল সিনিয়র আইনজীবীদের সাক্ষাৎকার দেখলাম। তারা এখানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র দেখে। আমার প্রশ্ন ২টা। প্রথমে, পুলিশ এলো কার কথায়? পিটালো কার কথায় বা কোন কারণে? এবং দ্বিতীয়, এটাকে কারা সমর্থন করছে?

আমি একটা ভিডিওতে দেখেছি, এক পুলিশ একজন আইনজীবীর গালে চড় দিচ্ছে। শুনলাম, দেড়শ জনের বেশি আইনজীবী আহত হয়েছেন। তারা বাসায় চলে গেছেন। সাংবাদিকরা তো বলছেন যে তাদের মারধর করা হয়েছে। ছবি, ভিডিওতেও তা দেখলাম।

আমি একটু শারীরিকভাবে অসুস্থ। গতকালের এই ঘটনা দেখার পর আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। এখন পর্যন্ত আমি স্থির হতে পারিনি। গতকাল এটা কি হলো?

Comments

The Daily Star  | English

Drug smuggling via air, land routes on the rise

This grim picture emerges as Bangladesh, like other countries around the world, observes the International Day Against Drug Abuse and Illicit Trafficking today.

14h ago