শব্দ বেশি মানেই কি গাড়ির ইঞ্জিন শক্তিশালী

শব্দ বেশি মানেই কি গাড়ির ইঞ্জিন শক্তিশালী
ছবি: ফোর্ড মাস্টাং

গাড়ির ইঞ্জিনের বিকট গর্জনকে বিশ্বের বহু মানুষ বহু দশক ধরে ইঞ্জিনের ক্ষমতা ও কার্যকারিতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেন। নিজের গাড়িটি কত দামি কিংবা ইঞ্জিন কত শক্তিশালী, সেটি বোঝাতে রাস্তাঘাটে অনেক সময় চালকরা ইচ্ছা করে ইঞ্জিনের শব্দ সবাইকে শোনান। 

কিন্তু জেনে অবাক হবেন, এটি পুরোটাই একটা ভুয়া বা মিথ্যা বিষয়। গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কৌশলে এমন ব্যবস্থা করে রাখে যাতে ইঞ্জিন থেকে বিকট গর্জন বা শব্দ উৎপন্ন হয়। বাস্তবে এই শব্দের সঙ্গে ইঞ্জিনের সক্ষমতার কোনো সম্পর্কই নেই। 

ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফোর্ড মাস্টাং বা এফ-১৫০ এর মতো আমেরিকার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া গাড়ি ও ট্রাকগুলোতে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ এক ধরনের স্পিকার, পাইপ এবং ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে ইঞ্জিনের গর্জনকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়, যাতে শব্দটি অনেক জোরে শোনা যায়।  

ইঞ্জিনের মিথ্যা শব্দ গাড়ি শিল্পের অনেকগুলো গোপন প্রতারণার অন্যতম। বিএমডব্লিউ কিংবা ভক্সওয়াগনের মতো প্রতিষ্ঠিত ও সুনামধারী কোম্পানিগুলোও অনেক নিত্যনতুন উপায়ে এই প্রতারণা করে আসছে। যদি ইঞ্জিনের এসব বাড়তি শব্দ যোগ করা না হতো, তাহলে এখনকার অনেক শক্তিশালী ও জ্বালানী-সাশ্রয়ী গাড়ি আরও নীরবে রাস্তায় চলতে পারতো। কিন্তু গাড়ি নির্মাতারা মনে করেন, যে ইঞ্জিনের গর্জন নেই, ক্রেতারা সেটিকে কম শক্তিশালী মনে করে। তাদের ধারণা, যে ইঞ্জিনের গর্জন যত বেশি, সে ইঞ্জিনকে মানুষ তত বেশি শক্তিশালী মনে করে এবং নীরব ইঞ্জন তৈরি করলে তারা সম্ভাব্য ক্রেতা হারাবে। 

ইঞ্জিনের হালকা শব্দই আসলে প্রমাণ করে গ্যাস এবং ইঞ্জিনের মিথস্ক্রিয়ার কতটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু গাড়ি নির্মাতারা ইচ্ছাকৃতভাবে কিত্রিম উপায়ে ইঞ্জিনের শব্দকে আরও বাড়ান, কারণ তারা সবসময় ক্রেতাদের একটি প্রবণতা লক্ষ্য করেন- তারা অবশ্যই উন্নত ও জ্বালানী সাশ্রয়ী ইঞ্জিন চান, কিন্তু একই সঙ্গে ইঞ্জিনের গর্জন যাতে বেশি হয়, সেটার চান। 

ইঞ্জিনের এসব বাড়তি 'শব্দ' এখন টয়োটা প্রিয়াস ইলেক্ট্রিক গাড়িতেও ব্যবহার হচ্ছে। 

গাড়ি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম দ্য ড্রাইভের প্রতিবেদক ক্রিস সুই তার প্রতিবেদনে লিখেছেন, তিনি একটি ২০২১ কিয়া স্টিঙ্গার ব্যবহার করতেন। গাড়ির অ্যাক্সিলাটেরে চাপ দিলে যে শব্দ উৎপন্ন হতো সেটি তিনি খুবই পছন্দ করতেন। কিন্তু এই শব্দ ছিল পুরোটাই কৃত্রিমভাবে তৈরি এবং ইঞ্জিনের সক্ষমতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। 

স্টিঙ্গারে টুইন টারবো ৩.৩ লিটার ভি৬ ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়। ইঞ্জিনের শব্দকে আরও বাড়ানোর জন্য এটিতে কৃত্রিমভাবে 'অ্যাকটিভ ইঞ্জিন সাউন্ড' সিস্টেম ব্যবহার করা হয়, যার ফলে বিকট ইঞ্জিনের শব্দে 'বোকা' গ্রাহক ভাবে তার গাড়ির ইঞ্জিন কতটা শক্তিশালী! 

২০১৫ সালে মাস্টাং ইকোবুস্টের জন্য ফোর্ডের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা 'অ্যাকটিভ নয়েজ কন্ট্রোল' সিস্টেম তৈরি করেন, যেটি গাড়ির স্পিকারের সাহায্যে ইঞ্জিনের শব্দকে বাড়িয়ে শোনাতো। পরবর্তীতে ফোর্ড জরিপ চালিয়ে দেখেছে গ্রহাকরা আসলে ইঞ্জিনের এই মিথ্যা ও বাড়তি শব্দ 'খুব উপভোগ' করছে।  
 
৪১ বছর বয়সী সাবেক ডেনভার মাস্টাং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মাইক রাইনার্ড বলেন, 'গাড়ির ব্যাপারে শৌখিন কারও কাছে ইঞ্জিনের এই শব্দ মিউজিকের মতো মনে হয়। এটা একটা সূক্ষ্ম চালাকি। এর মাধ্যমে নির্মাতারা একটা ইঞ্জিনকে এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে, যা আসলে সত্যি নয়। কেউই অবশ্য প্রতারিত হতে চায় না।'

রাইনার্ডের নিজের ২০১২ মাস্টাং জিটির ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে তার 'ভালোবাসা ও বৈরিতার' সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। 

গাড়ি নির্মাতারা ইঞ্জিনের শব্দকে বাড়িয়ে শোনানোর জন্য যে কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করে, এটা স্বীকার করতে চায় না। কারণ, তারা মনে করে স্বীকার করলে গ্রাহকরা প্রতারিত বোধ করতে পারেন বা ক্ষুদ্ধ হতে পারেন। তবে ফোর্ডের এফ-১৫০ মডেলটি যখন বাজারে ছাড়া হয়, তখন প্রতিষ্ঠানটির সাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা এটি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন যে গাড়িটির স্পিকারের সাহায্যে কৃত্রিমভাবে ইঞ্জিনের শব্দকে বিবর্ধিত করা হয়। কিন্তু গ্রাহকরা ক্ষুদ্ধ হবেন, এই ভয় থেকে পরে বিষয়টি আর সেভাবে প্রকাশ্যে আনা হয়নি। 

গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এটা ভেবে উদ্বিগ্ন যে ইঞ্জিনের 'আসল' শব্দে হয়তো গ্রাহকরা সন্তুষ্ট হবেন না। এজন্য অনেক কোম্পানিই অডিও এবং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে মিলে যথাসম্ভব 'বাস্তব' শব্দ কীভাবে তৈরি করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছে। 

এ ক্ষেত্রে ভক্সওয়াগন যে সিস্টেম তৈরি করেছে সেটির নাম 'সাউন্ডাকটর', যেখানে একটি বিশেষ স্পিকারের মাধ্যমে ইঞ্জিনের গর্জনকে আরও বাড়ানো হয়। নিজেদের এলএফএ সুপারকারের ইঞ্জিনের শব্দ আরও কীভাবে বাড়িয়ে শোনানে যায়, সেটি নিয়ে লেক্সাসও ইয়ামাহার যন্ত্রবিদদের সঙ্গে কাজ করেছে।

পোরশের 'সাউন্ড সিম্পোসার' বাড়তি টিউবের মাধ্যমে ইঞ্জিনের গর্জন বাড়ানোর কাজ করে। 

কৃত্রিম শব্দ এখন ইলেক্ট্রিক গাড়ির জন্যও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কারণ এই গাড়িগুলো এতটাই নিরবে চলে যে তা অন্ধ ও পথচারীদের জন্য বড় ঝুঁকির তৈরি করেছে। তবে মার্কিন ফেডারেল সরকার এ সম্পর্কিত একটি নীতিমালা নিয়ে কাজ করছে, যা পথচারী ও বাইসাইকেল চালকদের হাজার হাজার দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করবে। 

তবে গাড়িগুলোতে ইঞ্জিনের শব্দ বাড়ানোর জন্য যে কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করা হয়, তাতে কেউ কেউ কোনো সমস্যা দেখেন না, আবার অনেকে মনে করেন এটা বন্ধ হওয়া উচিত। 

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক যানবাহন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কেলি ব্লু বুকের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক কার্ল ব্রয়ার বলেছেন, গাড়ি নির্মাতাদের এই মিথ্যা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত এবং ক্রেতাদের সঙ্গে সৎ হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, 'আপনি যদি এটা (কৃত্রিমভাবে ইঞ্জিনের শব্দ বাড়ানো) করতেই চান, তাহলে করুন। কিন্তু ক্রেতাকে আসল সত্যিটা জানান। কারও যদি ভি৮ ইঞ্জিনের শব্দ ভালো লাগে, তাহলে তাকে বেশি দাম দিয়ে এই ইঞ্জিনের গাড়ি কিনতে হবে, যেটি কম জ্বালানী সাশ্রয়ী এবং পরিবেশের জন্য বেশি ক্ষতিকর। আপনি প্রতারণার মাধ্যমে গাড়ির আকর্ষণকে বাড়াচ্ছেন। আপনি গাড়িকে ভুলভাবে গ্রাহকের সামনে উপস্থাপন করছেন। এটা আমার কাছে প্রতারণার শামিল।'

সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য ড্রাইভ, কারঅ্যান্ডড্রাইভার, দ্য গার্ডিয়ান 
গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

 

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

4h ago