‘নিয়ন্ত্রণমূলক’ ডেটা সুরক্ষা আইনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ‘ঝুঁকি’
সরকার ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য 'ডেটা সুরক্ষা আইন' নামের যে আইন করতে যাচ্ছে তা একইসঙ্গে নিয়ন্ত্রণমূলক হতে পারে এবং মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
'ডেটা সুরক্ষা আইন, ২০২২'- এর প্রস্তাবিত খসড়া বিশ্লেষণ করে এ কথা বলেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল- এর জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মো. সাইমুম রেজা তালুকদার।
আজ সোমবার সকালে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের আয়োজনে 'প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন: কী সুরক্ষা? কার ক্ষতি-কার লাভ?' শীর্ষক এক ওয়েবিনারে তিনি বলেন, 'এই আইন রাষ্ট্রীয় সাইবার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে'।
এর পাশাপাশি তার পর্যবেক্ষণ হলো, আইনটি রাষ্ট্রের ভিন্নমতাবলম্বী ও গঠনমূলক সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র-১৯৪৮ এর ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি-১৯৬৬ এর ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়েবিনারে সাইমুম রেজা বলেন, 'কোন ব্যাক্তির গোপনীয়তা, পরিবার, ঘর বা ব্যাক্তিগত যোগাযোগের ওপর স্বেচ্ছাচারী হস্তক্ষেপ করা যাবে না এবং তার সম্মান এবং খ্যাতির ওপর আঘাত করা যাবে না। প্রত্যেকেরই এই ধরনের স্বেচ্ছাচারী হস্তক্ষেপ বা আক্রমণের বিরুদ্ধে আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
'মানুষের যে অধিকারগুলো অফলাইনে সুরক্ষিত, সেগুলো অনলাইনেও সুরক্ষিত করতে হবে।'
প্রস্তাবিত আইনে 'ব্যাক্তিগত উপাত্ত' শব্দদ্বয়ের সংজ্ঞাই উল্লেখ করা হয়নি বলেও মন্তব্য করেন সাইমুম রেজা। এ বিষয়ে তার ভাষ্য, 'প্রস্তাবিত আইনের ২(গ) ধারায় উপাত্তের সংজ্ঞাটি আইসিটি আইন- ২০০৬ এর ২(১০) ধারায় সংজ্ঞায়িত উপাত্ত এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮ এর ২৬ ধারায় বর্ণিত 'পরিচিতি তথ্য'র সংজ্ঞার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া সমীচীন।'
এর বাইরে প্রস্তাবিত আইনে উপাত্তের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়নি বলেও জানান সাইমুম রেজা। বলেন, 'এ কারনে রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে উপাত্তের পরিগম্যতা (Interoperability) কীভাবে নিশ্চিত করা হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হতে পারে এবং সর্বোপরি তা রাষ্ট্রীয় সাইবার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'আইসিটি আইন-২০০৬ এর বিলুপ্তকৃত ৫৭ ধারা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর ধারাগুলো নিয়ে সম্প্রতি বাকস্বাধীনতার অধিকার হরণের অভিযোগ উঠেছে এবং এই ধারাগুলো নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইনে নির্বাহী বিভাগকে বিচার বিভাগের কাছে জবাবদিহিতার ব্যাবস্থা বা প্রক্রিয়া না রেখে ব্যাক্তিগত উপাত্ত সংগ্রহের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হলে তা রাষ্ট্রের ভিন্নমতাবলম্বী ও গঠনমূলক সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।'
সাইমুমের ভাষ্য, প্রস্তাবিত আইনের ৪৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী সংবেদনশীল উপাত্ত, ব্যাবহারকারী সৃষ্ট উপাত্ত ও শ্রেণিবদ্ধকৃত উপাত্ত কেবল বাংলাদেশে মজুত করতে হবে এবং তা বাংলাদেশের আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ ব্যাতীত অন্য কোনো রাষ্ট্রের আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের বহির্ভূত থাকবে।
এমনটি হলে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
এ ছাড়া ব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার অধিকারের বিষয়টি সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা হয়েছে জানিয়ে এ বিষয়ে হাইকোর্টের একটি রায়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন সাইমুম। তিনি বলেন, 'যে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক অধিগ্রহনের প্রক্রিয়া ও জব্দের আবেদন ছাড়া কোনো ব্যক্তির মোবাইল ফোনের কললিস্ট ও অডিও রেকর্ড ফোন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সংগ্রহ করা যাবে না।'
হাইকোর্টের আরেকটি রায়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন অপরাধ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পুলিশ ব্যাক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু পুলিশকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নাগরিকদের গোপনীয়তার প্রতি যেন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ না ঘটে।'
প্রস্তাবিত ডেটা সুরক্ষা আইনে এর প্রতিফলন ঘটেনি বলে মনে করেন তিনি।
ওয়েবিনারে আলোচক ছিলেন বিবিসি বাংলা সার্ভিসের সাবেক সম্পাদক কামাল আহমেদ ও ডেইলি স্টারের সাংবাদিক জাইমা ইসলাম। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রিয়াজ এবং নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
কামাল আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, 'প্রস্তাবিত আইনটি নিরাপত্তার বিষয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়টি উহ্য রেখেছে। এটি রাষ্ট্র ও সরকারের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, অপরাধ দমন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বেশি আগ্রহী।'
একইসঙ্গে যুক্তরাজ্যের ডেটা প্রটেকশন অফিসের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'প্রস্তাবিত আইনে ডেটা সুরক্ষা কার্যালয় ও এর মহাপরিচালক স্বাধীন নন এবং এগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রনে থাকবে।'
তার ভাষ্য, ডেটা সুরক্ষা কার্যালয়ের একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হওয়ার বিষয়টি নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সুরক্ষার পূর্বশর্ত।
ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক মনির হায়দার।
Comments