এগিয়ে যাওয়ার অক্সিজেনের নাম মুক্তচিন্তা

দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক
মাহফুজ আনাম। ছবি: স্টার

দ্য ডেইলি স্টারের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা রক্ষা ও প্রচারে নিরলস কাজ করা ১২ কীর্তিমানকে 'সেনটিনেল অব ফ্রিডম অব থট' সম্মাননা দেওয়া হয় গতকাল শনিবার। অনুষ্ঠানে দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনামের বক্তব্য।

দ্য ডেইলি স্টারের ৩২তম বার্ষিকীতে সবাইকে স্বাগত।

প্রথমেই শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক এস.এম. আলী, দ্য ডেইলি স্টারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মিডিয়াওয়ার্ল্ডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আজিমুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস মাহমুদকে, যারা আমাদের পথপ্রদর্শক। তারা আর আমাদের মাঝে নেই।

২০২০ সালের জুলাইয়ে লতিফুর রহমানকে হারানো ছিল আমাদের জন্য একটি বড় ধাক্কা। তিনি ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক, সাহসের উৎস, কোনো চাপে নত না হওয়ার অনুপ্রেরণা এবং সব সংকটের মধ্যেও অবিচল পথচলার সঙ্গী।

শ্রদ্ধা জানাই আমাদের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আ. রউফ চৌধুরীর প্রতি, আজ দুপুরে তাকে আমরা হারিয়েছি।

রোকিয়া আফজাল রহমানের নেতৃত্বাধীন বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাই। রোকিয়া আফজাল রহমানের ২০ বছরের নেতৃত্ব প্রজ্ঞা ও সাহসের এক দুর্দান্ত উদাহরণ। পর্ষদের প্রতিটি সদস্যের মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন সমর্থনের কারণেই আমরা পাঠকদের কাছে বিশ্বস্ততার সঙ্গে খবর পৌঁছে দিতে পেরেছি এবং পারছি।

পরিশেষে আমি আমাদের পাঠক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যারা আমাদের 'সততা, সাহসিকতা, সাংবাদিকতা'র প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন এবং সকল প্রতিকূলতার মাঝেও আমাদের পাশে রয়েছেন। আপনাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ছাড়া আমরা এই অবস্থানে পৌঁছাতে পারতাম না।

আপনাদের বলতে চাই, 'ধন্যবাদ, মুক্ত গণমাধ্যমের পৃষ্ঠপোষক'। হ্যাঁ, আপনারা সবাই দ্য ডেইলি স্টারকে সমর্থন দিয়ে মুক্ত গণমাধ্যম এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সমর্থক হয়েছেন। আর সেটাই আমরা উদযাপন করতে চাই।

গত ৩২ বছরে আপনাদের প্রিয় সংবাদপত্র দ্য ডেইলি স্টার তার পেশাদারিত্ব, মৌলিক সাংবাদিকতা নীতির আনুগত্য, সততা, নির্দলীয় অবস্থান, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ কলামের মাধ্যমে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছে। সাংবাদিকতার প্রতি আমাদের ভালোবাসা, পাঠকদের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং দেশপ্রেমের কারণেই আমরা এটি করেছি। কারণ, সাংবাদিক হিসেবে দেশের সেবা করার সর্বোত্তম উপায় হলো সেরা সাংবাদিক হওয়া, সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের মান অর্জন করা।

এর জন্য আমাদের মূল্য দিতে হয়েছে। অবমাননা, কুৎসা, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধা, অসহযোগিতা, বিজ্ঞাপন কমিয়ে দেওয়া, সর্বোচ্চ স্তরের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান কভার করার অনুমতি না পাওয়া, অসদাচরণ, প্রতিদিনের কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি ইত্যাদি।

তারপরও দ্য ডেইলি স্টার এবং আমরা যারা এখানে কাজ করছি, তারা হাসিমুখেই সেই মূল্য দিয়ে যাচ্ছি এবং পাঠকদের জন্য 'সততা ও সাহসিকতা'র সঙ্গে সাংবাদিকতা করছি।

সেই চেতনায় আমরা ১২ জন অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানাচ্ছি, যাদেরকে আমরা 'মুক্তচিন্তার প্রহরী' হিসেবে অভিহিত করছি। চিন্তার স্বাধীনতার মশাল বাহক হিসেবে তারা দাঁড়িয়েছেন এবং আজীবন সংগ্রাম করেছেন, এর জন্য তাদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

চিন্তার স্বাধীনতা কেন গুরুত্বপূর্ণ? সমাজের উৎকর্ষ সাধনের জন্য যে জিনিসটির সবচেয়ে বড় অবদান থাকে, তা হচ্ছে চিন্তার স্বাধীনতা। এটাই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। বিপরীতে, চিন্তার স্বাধীনতা না থাকলে তা আমাদের নিয়ে যাবে অন্ধকারের দিকে, পরাজয়ের দিকে।

জোর দিয়ে বলতে চাই, একটি জাতির অগ্রগতির জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সড়ক, সেতু, টানেলের মতো অবকাঠামো নির্মাণ করছি, এর সবই প্রয়োজনীয় এবং আমরা এর জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু মেধা বিকাশের, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পরিকাঠামো কোথায়? মানসম্মত শিক্ষা, যোগ্য শিক্ষক, একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কোথায়? নতুন গবেষণায় অনুদান কোথায়? স্কলারদের জ্ঞান সাধনায় জীবন উৎসর্গ করার প্রণোদনা কোথায়?

সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের স্কলারদের সেই সম্মান কোথায়? আমাদের সমাজ, সরকার বা রাষ্ট্রে তাদের মর্যাদা কোথায়?

আমি আবারও বলছি, আমাদের সমাজের মূলধারায় সম্মান দেওয়ার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে, বিশেষ করে শিক্ষক ও স্কলারদের প্রতি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কীভাবে অসম্মান করা হয়, অপমান করা হয়, সেই খবর প্রকাশ করতে করতে আমরা ক্লান্ত। এটা খুব বেশি দিন আগের খবর না এবং আপনাদের মনে থাকার কথা, একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের সামনে কান ধরে উঠবস করানো হয়েছে। কাউকে এরচেয়ে বেশি অপমান আর কীভাবে করা যায়? যে শিক্ষার্থীদের তিনি পড়াবেন, তাদের সামনেই তাকে চূড়ান্ত অপমান করা হয়েছে। এটা আমাদের ঐতিহ্য না। এটা আমাদেরকে ২১ শতকের বিশ্বের দিকে নিয়ে যাবে না।

গর্ব করি, বিশ্বকে জানাই যে আমরা মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিয়েছি। আমরা রক্ত দিয়েছি বাংলায় কথা বলার জন্যে। এখন আমাদের বাংলায় কথা বলার অধিকার আছে। ভাষা পেয়েছি, শব্দ পেয়েছি। সেই সুন্দর ভাষায় আমরা কী বলব? এটা কি শুধুমাত্র সাধুবাদ দেওয়ার জন্য? বিষোদগার করার জন্য? নাকি গভীর, সারগর্ভ, সংবেদনশীল, অর্থপূর্ণ ও সুন্দর কিছু প্রকাশের জন্য? সৃজনশীলতা, মৌলিকতা ও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ধারণা আমরা এসব শব্দের মধ্যমে প্রকাশ করতে পারি। সেই সুযোগ কোথায়?

আমরা আমাদের দুঃখ, কষ্ট, সংগ্রাম, স্বপ্ন, প্রতিবাদের কতটুকু তুলে ধরতে পারি? এখানেই সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি আসে, যা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনকে টিকিয়ে রাখে, সেটা হচ্ছে 'চিন্তার স্বাধীনতা'। আমরা চিন্তার স্বাধীনতা কতটা পাই?

আমাদের ভাষা আন্দোলনের এই মাসে আমি সেই গানের কথা স্মরণ করতে চাই, যে গান আমরা গেয়েছি ছাত্রজীবনে। 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়'। ওরা আমার মুখের ভাষা কেন 'কাইরা নিতে' চেয়েছিল? যাতে আমরা আমাদের অনুভব, সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে না পারি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিবাদ যেন করতে না পারি। পাকিস্তানিরা এটাই করতে চেয়েছিল। তারা আমাদের 'না' বলার ক্ষমতা কেড়ে নিতে চেয়েছিল।

গানের আরেকটি লাইন হচ্ছে, 'ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে'। এই শিকলটা কী ছিল যেটা পাকিস্তানিরা আমাদের হাতে-পায়ে পরাতে চেয়েছে? তারা শিকল পরাতে চেয়েছে, যেন আমরা বন্দি থাকি।

আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, পাকিস্তানিরা চলে গেছে। কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে বলছি, আজও আমাদের শিকল পরানো হচ্ছে। নিজের অজান্তেই আজ আমরা জ্ঞানার্জনের স্বাধীনতা বিসর্জন দিচ্ছি। আমাদের সমাজে মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা কমে যাচ্ছে।

এটা তো মৌলিক অধিকার। বেঁচে থাকতে যেমন অক্সিজেন গ্রহণ করতে হয়, তেমনি বিকাশের, এগিয়ে যাওয়ার, নতুনত্বের অক্সিজেন হচ্ছে মুক্তচিন্তা। অক্সিজেন না থাকলে আমরা যেমন মারা যাব, একই ভাবে মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা না থাকলেও আমরা সৃজনশীলতা হারিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মারা যাব।

মুক্তচিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একটি গণমাধ্যম হিসেবে মুক্তচিন্তার স্বাধীনতার অভাবের কথা প্রকাশ না করে পারছি না। একটি মুহূর্তের জন্য হলেও ভেবে দেখুন, মুক্তচিন্তাহীন একটি সমাজ কেবল সামাজিকতার জন্যই থাকতে পারে, উদ্ভাবনের জন্য নয়।

Comments

The Daily Star  | English

New Hampshire hamlet tied in first US Election day votes

Kamala Harris and Donald Trump each got three ballots in the tiny community in the northeastern state of New Hampshire

6m ago