মুক্তচিন্তার পথিক
প্রতিষ্ঠার ৩৩ বছরে পদার্পণে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার প্রচার ও প্রসারে নিরলস কাজ করা ১২ কীর্তিমানকে 'সেনটিনেল অব ফ্রিডম অব থট' সম্মাননা দিচ্ছে দ্য ডেইলি স্টার।
আজ শনিবার ঢাকার র্যাডিসন ব্লু হোটেলে আয়োজিত এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার পাটাতন তৈরিতে অগ্রগামী এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকারবন্ধ এই ১২ সূর্যসন্তানকে সম্মাননা দেওয়া হবে।
এই ১২ কীর্তিমানের কর্মময় জীবন।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
'আলোকিত মানুষ চাই'- স্লোগানকে উপজীব্য করে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ এমন এক উদ্যোগ নেন, যেটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীদের মাঝে বই পড়ার আগ্রহ ও মননশীল চিন্তাধারা তৈরিতে বৈপ্লবিক ভূমিকা রেখে আসছে। আবু সায়ীদের জন্ম কলকাতায়, ১৯৩৯ সালে। শুধু শিক্ষাবিদ হিসেবে নয়, বরং একজন দূরদর্শী লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারক হিসেবে তিনি আমাদের সমাজে স্থায়ী প্রভাব রেখেছেন।
৩ যুগের শিক্ষকতা জীবনে অধ্যাপক আবু সায়ীদ শত শত তরুণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করেছেন। ৬০' এর দশকে তিনি প্রভাবশালী সাহিত্য সাময়িকী 'কণ্ঠস্বর'র সম্পাদক ছিলেন। সেখানে তিনি তরুণ প্রজন্মের কবি ও লেখকদের পরিচর্যা করার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। তিনি একইসঙ্গে ৭০' এর দশকে বিটিভির সবচেয়ে জনপ্রিয় উপস্থাপকদের একজন ছিলেন। এ সময় সপ্তবর্ণ ও আনন্দমেলার মতো জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন তিনি।
তবে মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে অবদান রাখার কারণে তিনি অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে থাকবেন। কমবয়সীদের মাঝে বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা এবং তাদের সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে জানানোর উদ্দেশ্যে ১৯৭৮ সালে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি সারা দেশে বইপড়ার বিভিন্ন কর্মসূচি চালু করেন। দেশে পাঠাগারের অভাব ঘুচাতে ১৯৯৮ সালে চালু করেন 'ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি' কর্মসূচি। বর্তমানে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের নিবন্ধনকৃত সদস্যের সংখ্যা ২২ লাখ এবং এর ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি মোট ৩ লাখ ৩০ হাজার মানুষকে সেবা দিচ্ছে। তার ৫০টিরও বেশি সাহিত্যকর্ম প্রগতিশীল মূল্যবোধের প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছিলেন স্বাধীন চিন্তাধারা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রচারণার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ এবং এ বিষয়গুলোকে তিনি কেবল তার লেখনীতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি পরিবেশ রক্ষা, গণস্বাস্থ্য ও দুর্নীতি দমন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মতো সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।
তরুণসহ সব বয়সী মানুষের মাঝে বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল ও স্বাধীন চিন্তাধারার প্রচারণায় অগ্রগামী ভূমিকা রাখার জন্য দ্য ডেইলি স্টার আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে সম্মান জানাচ্ছে। তার লেখনী, তার গড়ে তোলা সংস্থা ও বিভিন্ন অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি লাখো তরুণ-তরুণীকে মুক্তচিন্তার চর্চায় উৎসাহিত করেছেন, বাকি বিশ্বকে দেখার দিব্যদৃষ্টিকে প্রসারিত করেছেন এবং বৈশ্বিক বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস সম্পর্কে অবগত করেছেন। এসব কীর্তির মাধ্যমে তিনি আমাদের সমাজে ইতিবাচক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছেন, যা বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত পটভূমিকে ধারাবাহিকভাবে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
আহমদ রফিক
আহমদ রফিক বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ও মানবাধিকার কর্মী। মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার আদর্শের প্রতি তার নিরন্তর অঙ্গীকারের জন্য তিনি সর্বস্তরে পরিচিতি ও বিশেষ সম্মান অর্জন করেছেন। তিনি ১৯২৯ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখতে পেরেছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে আহমদ রফিক ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সে সময় তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, যার ফলে তিনি কর্তৃপক্ষের রুদ্ররোষের শিকার হন।
তবে পরবর্তীতে রাজনীতির বদলে তিনি গবেষণা ও লেখনীর মাধ্যমে দেশের সেবা করার পাশাপাশি স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের আদর্শের প্রচারে নিয়োজিত হন।
ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আহমদ রফিক বেশ কিছু বই লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য একটি বই হল 'ভাষা আন্দোলন: ইতিহাস ও তাৎপর্য', যা তিনি ভাষা আন্দোলনের সহযোদ্ধা ও নেতা আবদুল মতিনের সঙ্গে যৌথভাবে লেখেন। এই বইতে ভাষা আন্দোলনের নিখুঁত ও বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ১৯৫৬ সালে দেশভাগের আগের ঘটনাগুলোও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে এটি এ বিষয়ের ওপর সবচেয়ে তথ্যবহুল বই হিসেবে বিবেচিত।
আহমদ রফিক বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও রচনার বিষয়ে প্রথম সারির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও লেখনী সংক্রান্ত গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার কারণে কলকাতা-ভিত্তিক টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাকে 'রবীন্দ্রত্ত্বাচার্য' উপাধিতে ভূষিত করে।
২ বাংলার বিভাজনের ওপর আহমদ রফিকের লেখনী এই ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর নতুন ভাবে আলোকপাত করেছে। এ বিষয়ে তার সবচেয়ে পরিচিত বইগুলোর একটি হলো, 'দেশবিভাগ: ফিরে দেখা'। বইটি এর অন্তর্দৃষ্টিমূলক বিশ্লেষণ ও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বহুল প্রশংসিত। এছাড়াও তিনি অসংখ্য সাহিত্যকর্ম ও বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র সম্পাদনার কাজ করেছেন, যেগুলো নিজ নিজ খাতে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ও অন্তর্দৃষ্টি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দ্য ডেইলি স্টার আহমদ রফিককে সম্মান জানাচ্ছে। একইসঙ্গে আমরা মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার আদর্শের প্রতি তার জীবনভর সাধনাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। কীভাবে একজন ব্যক্তি কয়েক প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রতি আবেগ, অঙ্গীকার ও অবিচল সংকল্পের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করতে পারেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে আহমদ রফিকের জীবন ও তার কীর্তি।
বদরুদ্দীন উমর
বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, যিনি শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ৬ দশকেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত তার দীর্ঘ কর্মজীবনের প্রায় পুরো সময়টুকু জুড়ে তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে কর্তৃত্বের অবস্থানে থাকা ব্যক্তিদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন এবং সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলোর ওপর আলোকপাত করেছেন। ক্ষমতাবানদের কাছে সব সময় সত্য কথাগুলো পৌঁছে দেওয়ার নিরলস উদ্যোগ তাকে সততা ও সাহসের প্রতীকে পরিণত করেছে এবং এর মাধ্যমে তিনি অন্যদেরও ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামিল হতে অনুপ্রাণিত করেছেন।
বদরুদ্দীন উমর বর্তমানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল লিবারেশন কাউন্সিলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি বামপন্থী ম্যাগাজিন 'সংস্কৃতি'র সম্পাদনায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
১৯৬৩ সালে বদরুদ্দীন উমর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং সেখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে নিজেকে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করবেন। এ সিদ্ধান্তের পেছনে কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সহায়তা দেওয়ার আবেগ কাজ করেছিল। বস্তুত, পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে মতবিরোধের ফল হিসেবেই তিনি এ উদ্যোগ নেন।
বদরুদ্দীন উমর শতাধিক বই ও অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। একটি সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান তৈরির পথভ্রষ্ট চিন্তাধারার প্রতি তীব্র বিরোধিতার কারণে তার ৩ মৌলিক রচনা 'সাম্প্রদায়িকতা', 'সংস্কৃতির সংকট' এবং 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা' পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের মাঝে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার 'পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' শিরোনামের ৩ খণ্ডের রচনা এবং ২ খণ্ডের কালজয়ী গ্রন্থ 'বাংলাদেশের উত্থান' তার রচনার মধ্যে অন্যতম।
দ্য ডেইলি স্টার বদরুদ্দীন উমরের জীবন-ইতিহাসকে উদযাপন করে। তিনি এমন একজন বৈপ্লবিক ব্যক্তিত্ব, যার মানবাধিকার রক্ষা কার্যক্রম, তীক্ষ্ণ সমালোচনা, বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা এবং সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা তাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় বিবেকের এক বিরল আলোকবর্তিকা করে তুলেছে।
হামিদা হোসেন
হামিদা হোসেন একজন অগ্রগামী মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার কর্মী। ১৯৩৬ সালে হায়দরাবাদে জন্ম নেওয়া হামিদা হোসেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি তার অঙ্গীকারবদ্ধতা এবং মানবাধিকার, লিঙ্গসমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের জন্য সুপরিচিত।
হামিদা হোসেন, কামাল হোসেন ও রেহমান সোবহানের সমন্বিত উদ্যোগে ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন 'ফোরাম' চালু হয়। এই প্রকাশনা বাঙালির জাতিগত আকাঙ্ক্ষা, সামরিক ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণার বিরুদ্ধাচরণ এবং সর্বোপরি, পল্লী অঞ্চল ও শ্রমিক সম্প্রদায়ের সদস্যদের নানা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর হামিদা হোসেন যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া নারীদের সহায়তার দিকে বিশেষ নজর দেন। ১৯৭৪ সালে তিনি স্থানীয় হস্তশিল্পের প্রচারণা ও বাণিজ্যিকীকরণের উদ্দেশ্যে সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কারিকা- বাংলাদেশ হস্তশিল্প সমবায় ফেডারেশন লিমিটেডের গোড়াপত্তন করেন।
একইসঙ্গে হামিদা হোসেন বেশ কিছু মানবাধিকার সংস্থা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেন, যার মধ্যে আছে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং শ্রমিকদের সুরক্ষায় নিয়োজিত শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম।
হামিদা হোসেন তার মানবাধিকার কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও সম্প্রসারিত করেছেন। ১৯৭৫ সালে মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সম্মেলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ উইথ ওম্যান ফর আ নিউ এরা (ডন) নেটওয়ার্কের সহ-প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা পালন করেন এবং এশিয়া প্যাসিফিক ফোরাম অন ওম্যান, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। এছাড়াও তিনি সিইডিএডব্লিউ চুক্তির অংশ হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রণীত ছায়া প্রতিবেদনে সহ-লেখকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ড. হামিদা হোসেন নারীদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, নারী শ্রমিকদের দুর্দশা এবং হস্ত ও কারুশিল্প খাত নিয়ে বিস্তৃত আকারে লিখেছেন। তার পিএইচডি থিসিস বাংলার পোশাক উৎপাদনের ইতিহাস এবং কারিগরদের জীবন ও কর্মপরিবেশের ওপর একটি মৌলিক কাজ হিসাবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। পরবর্তীতে এই থিসিস বই আকারে 'কোম্পানি উইভারস অব বেঙ্গল' নামে প্রকাশিত হয়।
ডেইলি স্টার হামিদা হোসেনকে চিন্তার স্বাধীনতার আলোকবর্তিকা, সামাজিক ন্যায়বিচারের চ্যাম্পিয়ন, মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং নারী ক্ষমতায়নের সমর্থক হিসেবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। একটি উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য তার নিরলস প্রচেষ্টা আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করে।
যতীন সরকার
যতীন সরকার একজন মার্কসবাদী বিদ্বান, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী, যিনি চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি অবিচল উৎসর্গের জন্য পরিচিত। তিনি ১৯৩৬ সালে নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন।
যতীন সরকার সব সময়ই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ সমর্থক এবং তিনি বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সব ধরনের সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি নির্ভীকভাবে এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন এবং অগণিত মানুষকে তার পথ অনুসরণ করার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় যতীন সরকার ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় শিক্ষার্থীদের হত্যার প্রতিবাদে নেত্রকোনায় বিক্ষোভের আয়োজনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
যতীন সরকার আজীবন প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি নিবেদিত ছিলেন। তিনি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে তিনি ১ বছর কারাগারে কাটাতে বাধ্য হন। বিভিন্ন সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যতীন সরকার তার নীতির প্রতি অবিচল থেকেছেন এবং পরিবর্তন ও অগ্রগতির কণ্ঠস্বর হিসেবে তার ভূমিকা অব্যাহত রেখেছেন।
যতীন সরকার তার বিস্তৃত কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপটে একটি অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে গেছেন। তার কালজয়ী গ্রন্থ 'পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন' একটি স্মৃতিকথা, যেখানে তিনি পাকিস্তানের ধারণার বিবর্তন এবং পরবর্তীকালে এর পতনের বিষয়ে একটি মনোমুগ্ধকর ও আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানিয়েছেন। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে 'বাংলাদেশের কবিগান', 'বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য' এবং 'সংস্কৃতির সংগ্রাম'।
দ্য ডেইলি স্টার সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার রক্ষাকারী হিসাবে যতীন সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নীতির প্রতি তার আজীবনের অবিচল অঙ্গীকারকে উদযাপন করছে।
কামাল হোসেন
ড. কামাল হোসেনের সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের স্থপতি। এছাড়াও তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিরলস সমর্থক এবং মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অবিচল রক্ষক। একজন আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং আইনজীবী হিসাবে তিনি দেশের রাজনৈতিক ও আইনি পটভূমিতে গভীর প্রভাব রেখেছেন।
ড. কামাল হোসেন ১৯৩৭ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি অন্যান্য বিশিষ্ট আইনজীবীদের সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিনিধিত্ব করেন। সে সময় আইন বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি তার দক্ষতা এবং ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার প্রদর্শন করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ড. কামাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারে আইনমন্ত্রী, তেল ও খনিজসম্পদ মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাকে বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার নেতৃত্বে প্রণীত সংবিধানে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটে। পরবর্তীতে এসব মূল্যবোধই হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি।
বিশিষ্ট সাংবিধানিক আইনজীবী হিসেবে ড. কামাল হোসেন মৌলিক মানবাধিকার, বিশেষ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় তার কর্মজীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে সাংবাদিক ও মুক্ত গণমাধ্যমের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে গেছেন। যখনই কোনো সাংবাদিক তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন, তখনই তিনি তাদের বিনা খরচে বিশেষায়িত আইনি সহায়তা দিয়েছেন। তিনি একইসঙ্গে বাংলাদেশ লিগাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি এবং সভাপতি। এটি একটি আইনি সংগঠন যারা প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আইনি সেবা দেওয়ার দিকে বিশেষ নজর দেয়।
ড. কামাল হোসেন বৈশ্বিক অঙ্গনেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছেন। তিনি জাতিসংঘের কমপেনসেশন কমিশনে ২ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন এবং আফগানিস্তানে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কিত বিশেষ দূত হিসেবেও কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সভাপতি ও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস ও ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউট উল্লেখযোগ্য।
দ্য ডেইলি স্টার গর্বের সঙ্গে ড. কামাল হোসেনকে স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রবক্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে তার অসামান্য ও নিরলস উদ্যোগের উদযাপন করছি।
মুস্তাফা মনোয়ার
বাংলাদেশের 'পাপেটম্যান' হিসেবে পরিচিত শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্বপক্ষের অগ্রগামী পথপ্রদর্শক। ১৯৩৫ সালে জন্ম নেওয়া এই প্রতিভাবান শিল্পী চারুকলার জগতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছেন। পাপেট শিল্পী, চিত্রশিল্পী, পরিচালক, টিভি অনুষ্ঠানের প্রযোজক এবং চিত্রনাট্যকার হিসাবে বৈচিত্র্যময় দক্ষতার সঙ্গে তিনি সৃজনশীল শিল্পের নানাক্ষেত্রে নিজেকে একজন অনন্য ও অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
শৈশব থেকেই মুস্তাফা মনোয়ার বিশ্বাস করতেন যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য উপযুক্ত হাতিয়ার হলো শিল্প। এ বিশ্বাস তার কাজেও প্রতিফলিত হতো। ১৯৫২ সালে নারায়ণগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আঁকা কার্টুনের জের ধরে তাকে সাময়িকভাবে কারারুদ্ধ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাপেটশিল্পী হিসেবে মূল্যবান অবদান রাখেন। পশ্চিম বাংলার শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানুষের মনোবল বাড়ানোর জন্য তিনি তার দক্ষতার পূর্ণ ব্যবহার করেন। আয়োজন করেন পাপেট প্রদর্শনীর। 'আগাছা', 'রাক্ষস' ও 'একজন সাহসী কৃষক' সহ তার বিখ্যাত পাপেট শোগুলো দর্শকদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং অনেক শক্তিশালী বার্তা দিয়েছিল।
মুস্তাফা মনোয়ার তার কর্মজীবন শুরু করেন প্রভাষক হিসেবে। ১৯৬৪ সালে তিনি সদ্য চালু হওয়া পাকিস্তান টেলিভিশনে অনুষ্ঠান প্রযোজনার কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে বিটিভির কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই শিশু-কিশোরদের জন্য নির্মিত অনুষ্ঠানের ওপর বিশেষ নজর দেওয়া হয় এবং এসব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রযোজনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মুস্তাফা মনোয়ার। ১৯৭৬ সালে বিটিভির জাতীয় টেলিভিশন প্রতিযোগিতা 'নতুন কুঁড়ি' শুরুর পেছনেও তার অবদান অনস্বীকার্য।
মুস্তফা মনোয়ার পাপেট শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য লোককাহিনী সংরক্ষণ ও শিশুদের গল্পগুলো পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনিই জনপ্রিয় ও কালজয়ী পাপেট চরিত্র পারুল, বাঘা ও মিনি'র নেপথ্যের সৃজনশীল শক্তি। এ চরিত্রগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শিশুদের আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে।
বিটিভির জন্য তিনি 'রক্তকরবী' এবং 'মুখরা রমণী বশীকরণ' এর চিত্রনাট্য তৈরি করেন এবং প্রযোজনা করেন। এই নাটকগুলো ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে এবং যুক্তরাজ্যের গ্রানাডা টিভি'র 'টিভি নাটকের বৈশ্বিক ইতিহাস' অনুষ্ঠানে অন্তর্ভুক্তির জন্য মনোনীত হয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টার ব্যক্তি মুস্তাফা মনোয়ার ও তার চিরস্থায়ী কীর্তির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। তার জীবন ও উদ্যোগ আরও মুক্ত ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব গঠনে সৃজনশীলতার শক্তির এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
নূরজাহান বোস
নূরজাহান বোস একজন বিশিষ্ট বাংলাদেশি লেখক, যিনি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধানে অবিচল সংকল্প ও দৃঢ় অঙ্গীকার দেখিয়েছেন। তিনি আজীবন বাংলাদেশে নারী অধিকার ও স্বাধীন চিন্তাধারার প্রচারণায় কাজ করে গেছেন।
১৯৩৮ সালে পটুয়াখালীতে জন্ম নেয়া নূরজাহান ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার ঘটনায় তার নিজ বিদ্যালয়ে শোক প্রকাশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন। পুরো শিক্ষাজীবনজুড়ে তিনি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি কলকাতার শরণার্থী শিবিরে নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি কবি সুফিয়া কামালের নির্দেশনায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে যোগ দেন।
পরবর্তীকালে নূরজাহান বোস ওয়াশিংটনে পাড়ি জমান। সেখানেও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতি তার অঙ্গীকার কমেনি; বিদেশে বসেও তিনি এই সংস্থার জন্য তহবিল সংগ্রহে নিয়োজিত থাকেন। ১৯৮৪ সালে তিনি ওয়াশিংটনে 'সংহতি' নামে একটি সমাজকল্যাণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থাটি বাংলাদেশের গৃহহীন নারীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রকল্প রোকেয়া সদন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমানে সংহতি বাংলাদেশের ৪ জেলায় দুর্বল, প্রান্তিক ও নিপীড়িত নারীদের সেবা করছে।
১৯৮৯ সালে নূরজাহান বোস অলাভজনক সংস্থা 'আশা' প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের বাইরে থাকাকালীন যেসব দক্ষিণ এশীয় নারী নির্যাতনের শিকার হন, তাদের এই সংস্থাটি সহায়তা দেয়। বাংলাদেশে ফেরার পর তিনি বিশিষ্ট মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হন।
নূরজাহানের আত্মজীবনী 'আগুনমুখার মেয়ে' অত্যন্ত তাৎপর্যপুর্ণ। এই বইয়ে তিনি আগুনমুখা নদীর তীরে অবস্থিত একটি গ্রামে কৈশোরকাল কাটিয়ে পরবর্তী জীবনে নানা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সব বাধা-বিপত্তি জয় করে বেড়ে ওঠার চমকপ্রদ কাহিনীর বর্ণনা দেন। ২০১৬ সালে তিনি এই অসামান্য আত্মজীবনীর জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
নারীর ক্ষমতায়ন এবং চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি আজীবন নিষ্ঠার জন্য নূরজাহান বোসকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে দ্য ডেইলি স্টার। তার নিরলস কাজ অগণিত মানুষের জীবনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে, তাদের নিজেদের জীবন নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী গড়ে তোলার শক্তি দিয়েছে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সক্ষমতা দিয়েছে।
রফিকুন নবী
রফিকুন নবী বাংলাদেশের শিল্প জগতের এক মহিরুহ ও মুক্তচিন্তা প্রকাশের প্রতীক। 'রনবী' নামেই অধিক পরিচিত তিনি। তার আঁকা কার্টুনগুলোতে প্রায়ই 'টোকাই' চরিত্র দেখা যায়। অমর এই চরিত্র সমাজের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির তীব্র সমালোচক। কখনো কখনো সে জাতির বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সেসব বিষয় নিয়ে উজ্জীবিত কথোপকথন চালায়, যেগুলোকে সাধারণত ধামাচাপা দেওয়া হয়।
রনবী ১৯৪৩ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্ম নেন। বিভিন্ন রঙ ও মাধ্যমের ব্যবহারে, সহজাত প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি পল্লী অঞ্চলের কঠোর পরিশ্রমী জনগণের দৈনন্দিন সমস্যাগুলোকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ক্যানভাসের ওপর প্রিন্ট থেকে পেইন্টিং, জলরঙ থেকে তেলরঙ কিংবা অ্যাক্রিলিক রঙের ব্যবহারে তৈরি হয়েছে রনবীর অসংখ্য মুগ্ধতা জাগানিয়া চিত্রকর্ম। এসব ছবিতে তিনি রঙ ও কম্পোজিশনে অসামান্য দক্ষতা ও প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার ছবিগুলো শুধু দেখতেই চমৎকার নয়, একইসঙ্গে এগুলোর মাঝে রয়েছে শক্তিশালী সব বার্তা, যেগুলো সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে এগুলোতে পরিবর্তন আনতে উৎসাহ জাগায়।
১৯৭৮ সালে রনবী প্রথমবারের মতো তার বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র 'টোকাই' কে সবার সামনে নিয়ে আসেন। টোকাই একটি অবহেলিত শিশু চরিত্র, যার রয়েছে জীবন সম্পর্কে বিস্তৃত অভিজ্ঞতা। এছাড়াও, টোকাইর আছে এক অনন্য ক্ষমতা, যার মাধ্যমে সে খোলাখুলিভাবে সমাজের অবিচার ও অনিয়ম সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারে। এসব মন্তব্যে তার অসামান্য রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায় এবং এগুলোর মাধ্যমে দর্শকরা ভিন্নভাবে চিন্তা করতে ও তাদের চারপাশের জগতের সঙ্গে আরও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হন।
অংকনশিক্ষার জগতে রফিকুন নবীর প্রভাব কিংবদন্তির চেয়ে কম কিছু নয়। বহু বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক হিসেবে তিনি অসংখ্য মানুষের প্রিয়ভাজন। তিনি অসংখ্য উচ্চাভিলাষী ও উঠতি শিল্পীকে সৃজনশীলতার প্রথাগত সীমানা ভাঙার দীক্ষা দিয়েছেন।
দ্য ডেইলি স্টার সংস্কৃতি জগতের এই অসামান্য ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানাতে পেরে সম্মানিত বোধ করছে।
রেহমান সোবহান
অধ্যাপক রেহমান সোবহান একজন কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ, প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী এবং চিন্তার স্বাধীনতার নিরলস সমর্থক। তার অসাধারণ কর্মজীবনজুড়ে তিনি সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং সত্য ও ন্যায়বিচারের নির্ভীক অনুসন্ধানের মাধ্যমে কয়েক প্রজন্মের চিন্তাবিদদের অনুপ্রাণিত করেছেন।
১৯৩৫ সালে কলকাতায় জন্ম নেওয়া রেহমান সোবহান বাংলাদেশের স্বাধীনতার অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকে তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে গবেষণা ও এ বিষয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখির জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। তার এসব উদ্যোগেই 'দুই অর্থনীতি' তত্ত্ব জনপ্রিয়তা পায়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি তৈরি হয়।
ড. কামাল হোসেন ও হামিদা হোসেনের সহযোগিতায় রেহমান সোবহান ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন 'ফোরাম'র গোড়াপত্তন করেন। এই প্রকাশনা বাঙালির জাতিগত আকাঙ্ক্ষা, সামরিক ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণার বিরুদ্ধাচরণ এবং সর্বোপরি, পল্লী অঞ্চল ও শ্রমিক সম্প্রদায়ের সদস্যদের নানা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রেহমান সোবহান প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন এবং বৈশ্বিক সমর্থন ও সহায়তা আদায়ের জন্য নিরলসভাবে কাজ চালিয়ে যান।
স্বাধীনতার পর তিনি পরিকল্পনা কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এবং যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় অমূল্য অবদান রাখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে দীর্ঘ ২০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বাংলাদেশের অগণিত ভবিষ্যৎ অর্থনীতিবিদকে অনুপ্রাণিত করেছেন। অসংখ্য বই, গবেষণাপত্র ও প্রবন্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম। তিনি একাধারে একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক ও অসামান্য বক্তা। তার কিছু মৌলিক কাজের মধ্যে আছে 'দ্য ক্রাইসিস অব এক্সটারনাল ডিপেনডেন্স'', 'রিথিংকিং দ্য রোল অব দ্য স্টেট ইন ডেভেলপমেন্ট: এশিয়ান পারসপেক্টিভস' ও 'চ্যালেঞ্জিং দ্যা ইনজাস্টিস অব পভার্টি: এজেন্ডাস ফর ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ইন সাউথ এশিয়া'। তার ২ খণ্ডের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'আনট্রানকুইল রিকালেকশানস' এ শৈশব থেকে শুরু করে তার জীবনের বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রা, তৎকালীন পাকিস্তানের ২ অংশের মাঝে বাড়তে থাকা বৈষম্য, বাংলাদেশের গঠন ও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের উন্নয়নের এক অসামান্য বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
রেহমান সোবহানের অপর পরিচয় হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান এমন একজন মহান ব্যক্তিত্ব, যার জীবন ও কর্ম তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল, স্বাধীন চিন্তাভাবনা এবং স্বাধীনতার অনুসন্ধানকে মূল্য দেয় এমন জনগোষ্ঠীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত করেছে। একজন প্রথম সারির বুদ্ধিজীবী ও জাতির পথপ্রদর্শনকারী বিবেক হিসেবে রেহমান সোবহানের অতিমানবীয় অবদানের জন্য দ্য ডেইলি স্টার গর্বের সঙ্গে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে অভিহিত করা হয় 'জাতির শিক্ষক' হিসেবে। তিনি বাংলাদেশের একজন শীর্ষ বুদ্ধিজীবী, যাকে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার বিষয়ে শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সমালোচক, ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং কর্মী হিসাবে বিস্তৃত জ্ঞান এবং সমালোচনামূলক অন্তর্দৃষ্টির সমন্বয়ে তিনি একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন। ৬ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ক্ষমতাবানদের কাছে প্রকৃত সত্যগুলো তুলে ধরে আসছেন।
১৯৩৭ সালে মুন্সিগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার জীবনের ৪০ বছরেরও বেশি সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা, লেখালেখি ও নেতৃত্বদানে উৎসর্গ করেছেন। তিনি শুধু একজন শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীই নন, একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিও বটে, যিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই সংস্থাগুলো বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক পরিসরের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি ইউনিভার্সিটি বুক সেন্টার ও দ্য সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন হিউম্যানিটিজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ২টি প্রথম সারির সাময়িকী সম্পাদনা করেন। এগুলো হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা (১৫ বছর) ও ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টাডিজ (৯ বছর)।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্বৈরাচার ও সাম্রাজ্যবাদের কঠোর সমালোচক। তিনি শ্রমিক, কৃষক, নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকারের জন্য নিরন্তর লড়াই করে চলেছেন। তিনি সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি গবেষণা ভিত্তিক সাময়িকী 'নতুন দিগন্ত' প্রকাশ করে থাকে। একইসঙ্গে তিনি বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের সাপ্তাহিক পত্রিকা 'সাপ্তাহিক সময়' সম্পাদনার কাজ করেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মুগ্ধতা জাগানিয়া কাজগুলো তাকে একজন প্রতিথযশা বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থায়ী অবস্থান দিয়েছে। সাহিত্যের জগতে তার প্রধান কাজগুলো হল 'জাতীয়তাবাদ, সম্প্রদায় ও জনগণের মুক্তি', 'গণতন্ত্রের পক্ষে বিপক্ষে', 'রাষ্ট্রের মালিকানা', 'উপনিবেশের সংস্কৃতি', 'পিতৃতান্ত্রিকতার বিপক্ষে'। এসব লেখনী প্রগতিশীল ও স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
সত্য ও ন্যায়বিচারের প্রতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অবিচল অঙ্গীকার তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার একটি শক্তিশালী প্রতীক এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অনুপ্রেরণার উৎস করে তুলেছে। দ্য ডেইলি স্টার আন্তরিক কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জাতির এই প্রিয় শিক্ষাবিদ এবং পথপ্রদর্শককে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
শরিফা খাতুন
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখিকা ও ভাষা আন্দোলনকর্মী শরিফা খাতুন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত।
১৯৩৬ সালে ফেনীতে জন্ম নেওয়া শরিফা খাতুন অল্প বয়সেই পরিচিতি পান। ইডেন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী হিসেবে তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি তার সহপাঠীদের নিয়ে ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেন। ভাষা আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে শরিফা খাতুনকে ২০১৭ সালে সম্মানজনক একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
অধ্যাপক শরিফা খাতুন ১৯৫৮ সালে শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ৫ দশক ধরে তিনি শিক্ষা খাতের বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং এ খাতে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তিনি ১৯৯৩ সালের মে থেকে ১৯৯৬ সালের মে পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক এবং বাংলাপিডিয়া - ন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশের সম্পাদকীয় দলের সদস্য ছিলেন।
শরিফা খাতুনের ছিল শিক্ষাগত বিষয়গুলোর সঙ্গে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বয়ের অনন্য সক্ষমতা, যার বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগে তিনি ৪০টিরও বেশি প্রবন্ধ ও বেশ কিছু প্রভাবশালী বই লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে আছে 'দর্শন ও শিক্ষা' (১৯৯৮), 'অস্তিত্ববাদ ও শিক্ষা' (২০১৩), 'প্লেটোর কাল্লিপলিস' এবং ইংরেজিতে লেখা 'ডেভেলপমেন্ট অব প্রাইমারি এডুকেশন পলিসি ইন বাংলাদেশ'। এই বইগুলো সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর লিখিত এবং এসব বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য এগুলো অবশ্য-পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত।
শরিফা খাতুনের আত্মজীবনী 'আলো ছায়ার দোলা' পাঠককে তার জীবন, সময়কাল এবং তিনি যে সমাজে বাস করতেন তার একটি অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ধারণা দেয়।
ডেইলি স্টার গর্বের সঙ্গে শরিফা খাতুনকে শিক্ষা খাতের বিশেষ অবদান এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় তার অঙ্গীকারের জন্য শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
Comments