একুশে পদক

স্বেচ্ছাসেবকসহ এই অর্জন সবার: কিশোর কুমার দাস

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের লগো এবং ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাস (ডানে) ও প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা কেন্দ্রের সমন্বয়ক সালমান খান ইয়াসিন (বামে)। ছবি: সংগৃহীত

'এক টাকার আহার'-এর মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এ বছর দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হয়েছে। 

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র ও অসচ্ছল শিশুদের মৌলিক শিক্ষা, আহার, চিকিৎসা এবং আইন সেবা প্রদান করে আসছে বিদ্যানন্দ। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

এসব বিষয়ে আজ রোববার বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাস এবং প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা কেন্দ্রের সমন্বয়ক সালমান খান ইয়াসিনের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।

একুশে পদক পাওয়ার খবর শোনার পর বর্তমানে পেরুতে বসবাসকারী কিশোর কুমার দাস বলেন, 'অসহায় ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে যারা অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন, এটা তাদের সাফল্য। এখানে চমৎকার বিষয় হলো- সরকার তাদের সে অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে।'

তিনি বলেন, 'এই কৃতিত্ব আমার একার নয়। স্বেচ্ছাসেবকসহ সেসব মানুষ এগিয়ে এসেছেন এবং অবদান রেখেছেন, এটা তাদের সবার অর্জন। দেশের জনগণই প্রকৃত নায়ক এবং এই পুরস্কারের প্রাপক।'

স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের এ ধরনের স্বীকৃতি একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে আরও বেশি মানুষকে হাতে হাত মেলানোর সুযোগ করে দেবে বলেও জানান কিশোর।

সালমান খান ইয়াসিন বলেন, 'বিদ্যানন্দের কাজ আসলে মানুষের জন্য, পদক বা প্রাপ্তি নিয়ে আমরা কখনো চিন্তা করিনি। অন্য ৮-১০ জন মানুষের মতো ধারণা ও বিশ্বাস থেকেই কিশোর কুমার দাস ২০১৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। গরিব বাচ্চারা পড়াশোনা করবে, শুরুতে এটিই ছিল মূল বিষয়। তবে কিশোর তার নীতিতে অটল ছিলেন এবং তিনি সেটাই চর্চা করেছেন। তিনি ভেবেছিলেন, মানুষ এখানে কাজ করবেন শর্তহীনভাবে। এভাবেই নায়ারণগঞ্জ থেকে শুরু করে ঢাকা, চট্টগ্রাম হয়ে সারাদেশে এর কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। এখানে কিশোরের প্রচেষ্টা যত না, তার চেয়ে দেশের মানুষের অবদান অনেক বেশি।'

তিনি বলেন, 'প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা কখনো টার্গেট সেট করে কাজ করিনি। সামনে যে সমস্যা পাই, সেটা নিয়েই কাজ করি। আমাদের কার্যক্রম একটা যাত্রার মতো। যাত্রাপথে কিছু মানুষ আমাদের সঙ্গী হচ্ছেন, সহায়তা করছেন, স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন। আসলে বিদ্যানন্দের মতাদর্শ যারা বুঝতে পারেন, তারাই বছরের পর বছর ধরে অনুদান দিয়ে আমাদের পাশে থাকছেন। টাকার অভাবে কারও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেলে আমরা তাকে সহায়তা করছি, দরিদ্র কৃষককে গরু কিনে দিচ্ছি। অর্থাৎ, প্রান্তিক মানুষকে আমরা যেভাবে পারছি, সহায়তা করছি।'

'আমাদের কাজের অর্থই হলো- মানুষের ভালো করা। এটাকে অনেকটা আধ্যাত্মিক ধরনের এক যাত্রা বলা যায়। চলার পথে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষের সহায়তা আমরা পাচ্ছি এবং তাদের সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। বিদ্যানন্দ যেকোনো কাজে নামার আগে ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে নেয়। গরিব মানুষদের খাবার, শিক্ষা, আশ্রয় ও চিকিৎসা প্রদানে আমাদের চেষ্টা থাকে সর্বোচ্চ। তবে সেবা গ্রহীতাদের সম্মানের বিষয়টি আমাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে চিন্তা করি বলেই আমাদের কাজগুলো এতো ব্যতিক্রমী হয়। তাছাড়া, আমরা প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার চেষ্টা করি। এটাই বিদ্যানন্দের শক্তির জায়গা এবং আমরা এটা নিয়ে খুবই আশাবাদী', বলেন তিনি।

সালমান খান ইয়াসিন বলেন, 'আমাদের কাজ ৩৬৫ দিনের। আমাদের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট "এক টাকার আহার"। এর মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার মানুষকে খাবার দেওয়া হয়। এ ছাড়াও, চট্টগ্রামে আমাদের একটি হাসপাতাল আছে, ভবনসহ যার সবকিছু মানুষের দানের টাকায় তৈরি। ওই হাসপাতালে প্রতিদিন কয়েকশ মানুষ ফ্রি চিকিৎসা ও ওষুধ পাচ্ছেন, নামমাত্র মূলে ডায়াগনোসিস ও টেস্ট করাতে পারছেন। আত্মকর্মসংস্থানের জন্য আমাদের আরেকটা প্রকল্প আছে "সম্বল"। যার মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে, যেমন- মনপুরা দ্বীপ, হাতিয়া ও আন্ডার চরের মতো জায়গায় কাজ করছে বিদ্যানন্দ। এর মাধ্যমে আমরা পড়াশোনার খরচ বহন, বিয়ের ব্যবস্থা করা, গরু-ছাগল, দোকান, মাছ ধরার জাল ও নৌকা ইত্যাদি কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করে আসছি।'

তিনি বলেন, 'আমাদের ২টি স্কুল ও ৭টি লার্নিং সেন্টার আছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন জায়গায় ৭টি এতিমখানাও আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় হাজার শিশু পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী আমাদের এখান থেকে বৃত্তি পাচ্ছে, প্রতিবছর লেখাপড়ার জন্য শিক্ষা উপকরণ ও টাকা-পয়সা পাচ্ছে। আগামীকালও আমরা বান্দরবানের রুমায় প্রায় ১০০ শিশুকে শিক্ষা বৃত্তি দেবো। এটা একটা চলমান যাত্রা এবং চলতেই থাকবে। প্রতিদিন কোনো না কোনো কাজ করছেন, আমাদের এখানে এমন স্বেচ্ছাসেবক আছেন প্রায় ২০০ জনের মতো। এ ছাড়া, সারাবছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১ হাজারের মতো স্বেচ্ছাসেবক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিদ্যানন্দের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।'

সালমান খান ইয়াসিন বলেন, 'প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আমরা দেশের মানুষের প্রচুর সমর্থন পেয়েছি। করোনা মহামারির পর থেকে সরকারি সহায়তাও পাচ্ছি। সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর সহায়তাও পেয়েছি। এ সমর্থন ছাড়া বিদ্যানন্দ আসলে টিকতে পারতো না। বিশেষ করে ২০২২ সালে আমরা এনজিও হিসেবে লাইসেন্স পেয়েছি। সরকারের জায়গা থেকে তারা নিজেরাই করে দিয়েছেন, আমাদের কোনো টাকা খরচ হয়নি। মানবকল্যাণে ইতিবাচক কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা জাতীয় মানবকল্যাণ পদক-২০২১ পেয়েছি। ২০২২ সালে বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাসকে ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ সম্মানিত করেছেন। তাকে "কমনওয়েলথ পয়েন্টস অব লাইট" পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।'

'তবে আমাদের চলার পথ সবসময় এতটা মসৃণ ছিল না। আমাদের প্রতিষ্ঠাতার ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে এনে অপবাদ দেওয়া হয় যে, আমরা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী, বিদ্যানন্দ ইসকনের গ্রুপ, আমরা খাবার দিয়ে ধর্মান্তরিত করছি, এ ধরনের নানা গুজব ছড়ানো হয়। কিন্তু আসলে আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই কাজ করেছি এবং এখনো করে যাচ্ছি। ২০২০ সালে বিদেশ থেকে অনলাইনে আমাদের বিরুদ্ধে  গুজব ছড়ানো হয়েছিল। আমরা পাহাড়ে কাজ করতে গেলে, বিদ্যানন্দ পাহাড় দখল করছে, এ ধরনের গুজবও ছড়ানো হয়। এগুলো বাদ দিলে আমরা আসলেই অনেক সহায়তা পেয়েছি। যখনই কোনো ট্যাবুর বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করি, সেখানেই আমরা সবচেয়ে বেশি বাধা পাই। এসবে আমাদের মন খারাপ হয়, আমরা সাময়িক হতাশ হই। কিন্তু দিন শেষে জবাব দেই মূলত কাজের মাধ্যমে। আমাদের নিয়ে যত বেশি সমালোচনা হয়, আমাদের স্বেচ্ছাসেবক যারা হৃদয়ে এ প্রতিষ্ঠানকে ধারণ করেন, তারা ততটাই বেশি উৎসাহ নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এটাও আমাদের আরেকটা শক্তিশালী দিক', যোগ করেন তিনি।

সালমান খান ইয়াসিন বলেন, 'চলতি পথে সাধারণ মানুষের জন্য যেখানে কাজের সুযোগ রয়েছে, আমরা তা-ই করে যাচ্ছি। এখন যেমন বইমেলা চলছে, এখানেও আমরা একটা মেসেজ নিয়ে এসেছি। বই বা পাঠকের অভাবে আমাদের পাঠাগার হারিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের মেসেজ হলো, বিদ্যানন্দের স্টল থেকে একটি বই কিনলে আমরা আর একটি বই পাঠাগারে দান করব। এ ছাড়া, বইমেলায় আমরা একটি বই নিয়ে এসেছি, যার গল্পগুলোর রচয়িতা এমন ব্যক্তি, যারা লিখতেই জানেন না। গতমাসেই সেন্টমার্টিনে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে আমরা একটি ক্যাম্পেইন করেছি। প্লাস্টিকের বিনিময়ে চাল-ডাল দেওয়া হয়েছে, যেখানে প্লাস্টিকই কারেন্সি হয়ে গেছে। এটা নিয়ে দেশ-বিদেশে আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি।'

'তবে সময়টা খুবই খারাপ যাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দা, দুর্যোগ, ভূমিকম্প-বন্যা হচ্ছে, আমরা সব দেখছি। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে দাম বাড়ছে, এর কারণে মানুষের অবস্থা যে খারাপ হচ্ছে, এটা হয়তো অনেকেই অনুধাবন করতে পারছেন না। কিন্তু বিদ্যানন্দ এটা অনুধাবন করে। এজন্যই ১০ টাকার বাজার, গরিবের সুপারশপ, হ্যাপিনেস স্টোর ও এক টাকার রেস্টুরেন্ট- এসবের মাধ্যমে বিভিন্ন আইডিয়ার বাস্তবায়ন আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি। মিরপুরে আমাদের একটি রেস্টুরেন্টও আছে, যেখানে মানুষ এক টাকায় খেতে পারেন। সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রামে বন্যার সময় আমরা কাজ করেছি। সামনে রমজান মাস আসছে, সেসময় ১০ লাখ অসহায় মানুষকে খাবার দিয়ে সহায়তা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। অর্থাৎ, যেখানে বঞ্চিত মানুষ, সেখানেই বিদ্যানন্দ', বলেন তিনি।

ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অনুদানের প্রস্তাব পেলেও আইনি ও কাগজপত্র জটিলতার কারণে সাড়া দিতে পারেননি বলে জানান সালমান খান ইয়াসিন।

তিনি বলেন, 'গতবছর আমরা লাইসেন্স পেলেও, এনজিও হিসেবে বিদ্যানন্দের বয়স ৩-৪ মাসের বেশি হয়নি। আমরা এখনো হাঁটছি, আর প্রতিনিয়ত শিখছি। তবে এখন চাইলে আমরা বিদেশ থেকেও অনুদান নিতে পারব, যা আগে পারতাম না। এখন আমাদের পথ কিছুটা সুগম হয়েছে বলা যায়। ফলে যারা আগে আমাদের নক করেছিল, আমরাও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি।'

সালমান খান ইয়াসিন আরও বলেন, 'একুশে পদক বিদ্যানন্দের একার নয়, এটি দেশের সব মানুষের। বাংলাদেশের গরিব মানুষের একটি প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি পেয়েছে, তবে এর মাধ্যমেই যে সব অর্জন হয়ে গেল তা কিন্তু নয়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ- স্বীকৃতি পাওয়ার পর তা ধরে রাখা। এখন আমাদের সামনেও চ্যালেঞ্জ, এই স্বীকৃতির মর্যাদা ধরে রাখা।'

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

6h ago