বিদেশে অর্থপাচার: যেসব কারণে আলোর মুখ দেখছে না দুদকের মামলা

প্রতীকী ছবি

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব দেশে অর্থপাচার হয়েছে সেখান থেকে সহযোগিতার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দক্ষ আইনজীবীর অভাবে অর্থপাচার মামলাগুলো খুব বেশি এগোচ্ছে না।

২০১৮ সাল থেকে বিদেশে অর্থপাচারকারী ২৪ জনের সম্পদের তথ্য চেয়ে ৩৪টি অনুরোধ করেছে দুদক। তবে এ পর্যন্ত এর কোনোটিরই উত্তর পায়নি সংস্থাটি।

দুদকের মহাপরিচালক (মানিলন্ডারিং) মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, 'উন্নত দেশগুলো অনেক কথা বলে, কিন্তু তারা পাচারকৃত অর্থের তথ্য দিতে অনিচ্ছুক। তারা এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত করতে অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রশ্ন করে।'

বিভিন্ন দেশে পাঠানো অনুরোধে প্রায় ৬২ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ১২ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার, ১২ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার, ১১৩ দশমিক ৭২২ মিলিয়ন সিঙ্গাপুর ডলার, ১৬ মিলিয়ন হংকং ডলার, ২ দশমিক ৬২ মিলিয়ন জাপানি ইয়েন, ৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন মালয়েশিয়ান রিংগিত, ৫৯ হাজার ৩৪১ ব্রিটিশ পাউন্ড, ১৮ হাজার থাই বাথ এবং ১৬ দশমিক ৮ মিলিয়ন টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়েছে দুদক।

২০২১ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে পরবর্তী বছরে বিভিন্ন দেশে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড বাংলাদেশি অর্থপাচারকারীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), পরিবেশ অধিদপ্তর এবং দুদককে অর্থপাচার বিষয়ে তদন্ত ও মোকাবিলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এই সংস্থাগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র দুদকের অর্থপাচার বিষয়ে তদন্ত ইউনিট ও প্রসিকিউশন টিম রয়েছে।

কিন্তু এর এখতিয়ার সীমিত। অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর উল্লেখ করে দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, এই ২ ইউনিট কেবল দুর্নীতি ও ঘুষ সংক্রান্ত অর্থপাচার মামলার তদন্ত করতে পারে।

সংগঠনের কার্যক্রম তদারকির জন্য অর্থপাচার প্রতিরোধে একটি কার্যকরী কমিটি রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কার্যকরী কমিটির এক সদস্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় ৮০ শতাংশ পাচার হয় ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এবং তা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব এনবিআর ও সিআইডির।'

কিন্তু তারা এ বিষয়ে পাবলিক প্রসিকিউটরদের ওপর নির্ভর করেন। অথচ, পাবলিক প্রসিকিউটররা অন্যান্য মামলার ভারে ব্যস্ত থাকেন এবং অর্থপাচার মামলার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতারও অভাব রয়েছে।

কার্যকরী কমিটির ওই সদস্য বলেন, 'দুদককে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে এবং অন্যদের অর্থপাচার প্রতিরোধে যথাযথ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। এখানে সরকারের একটি অংশের সদিচ্ছার অভাব স্পষ্ট।'

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ভুল ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি দিতে এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তে অবৈধভাবে অর্থপাচারের কারণে বাংলাদেশ গড়ে প্রায় ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে সিআইডি অনুমান করে যে, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ২০২১-২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা) রেমিট্যান্স হারিয়েছে।

কর্মকর্তারা বলেন, 'অর্থ ফেরানো তো দূরের কথা, পাচার হওয়া অর্থ সম্পর্কে জানতেই তদন্ত কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হয়।'

প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) বিদেশে পাচারকৃত সম্পদের তথ্য নিশ্চিত করতে অনুরোধ করে দুদক। বিএফআইইউ সংশ্লিষ্ট দেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করে।

মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, 'তবে এই তথ্য জনসমক্ষে ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই, আমরা আদালতের সামনে এটি ব্যবহার করতে পারি না।'

এই ধরনের পরিস্থিতিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী তথ্যের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের কাছে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) দায়ের করে দুদক।

এর জন্য ১২টি ধাপ পার করতে হয় জানিয়ে মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, 'দুদক সরাসরি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এমএলএআর দায়ের করতে পারে না।'

প্রথম ধাপে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি লিখতে হয়, যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুরোধটি বাস্তবায়নযোগ্য মনে করে, তাহলে চিঠিটি দূতাবাসের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়।

সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষ তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এর উত্তর পাঠায়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দূতাবাস থেকে তথ্য পায় এবং তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুদক বা অন্যান্য তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠালেই তদন্তকারীরা সেই উত্তর পান।

এক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, 'এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া।'

দুদক ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পাচারকৃত অর্থের বিষয়ে জাপানের কাছে এমএলএআর দায়ের করেছিল।

'প্রত্যুত্তরে দেশটির কর্তৃপক্ষ জাপানি ভাষায় সেই অনুরোধ আবার পাঠাতে বলেছিল,' বলেন তিনি।

তিনি আরও জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এবং স্থানীয় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি অফিসকে চিঠিটি অনুবাদের জন্য অনুরোধ করেছিল দুদক।

কিন্তু দুদকের সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়।

এ পর্যন্ত পাঠানো ৩৪টি অনুরোধের মধ্যে মাত্র ২টির উত্তর এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আরেকটি আবেদনের উত্তর এসেছে সাইপ্রাস থেকে, সেটিও আংশিক এবং গ্রিক ভাষায়।'

দুদক কর্মকর্তাদের মতে, এমএলএআরের প্রধান সমস্যা হলো, কোনো দেশ চাইলে বাংলাদেশের অনুরোধ গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

আরেক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, 'শুধু বিদেশি অফিসই নয়, স্থানীয় অফিসগুলোও প্রায়ই আমাদের অনুরোধ আমলে নেয় না। আমাদের কাছে মনে হয়, তারা এসব নিয়মিত ফলোআপকে বোঝা মনে করেন।'

মো. মাহমুদুল হোসাইন খান জানান, এই প্রক্রিয়ার গতি বাড়াতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দিয়েছিল দুদক। যেসব দেশে অধিক পরিমাণ অর্থপাচার হয়েছে সেসব দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের এমএলএটি রয়েছে মাত্র ২টি দেশের সঙ্গে। এর একটি ভারত এবং অপরটি দক্ষিণ আফ্রিকা।

Comments

The Daily Star  | English

Admin getting even heavier at the top

After the interim government took over, the number of officials in the upper echelon of the civil administration has become over three times the posts.

7h ago