ফিরে দেখা ২০২২

পদ্মা সেতু নাকি মেট্রোরেলে লিখবো ‘তুনাবী+মুনাদ’?

বাসা বদল করার পর নদী কোথায় থাকে?...

বাসা বদলের সব আলামত জানে

সে আর খুঁজবে না কখনো…

যে যায় সে সুখেই থাকে

বাসা বদল মানে কখনো সখনো আলাদা হবার গল্প!

...তুনাবীকে নিবেদিত কবিতা

প্রিয় তুনাবী,

দেশ বদল করার পর ভালোবাসাও কী বদলে যায়? তুমি তো জানো, ভালোবাসার পরীক্ষায় একশতে একশ পেতে হয়। এ বছরের মার্চে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের সময়ে সারা দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা আসে। কিন্তু প্রায় একই সময়ে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ওলটপালট করে দেয় সব। শতভাগ ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়া এই আমি যেমন প্রেমযুদ্ধে তোমার কাছে হেরে গেছি, তেমনি শতভাগ বিদ্যুতের ভালোবাসা পায়নি মানুষ। তোমাকে হারিয়ে আমার জীবনে বিরহ ফিরে আসার দিনগুলোর মতো দেশে ফিরে এসেছিল লোডশেডিংয়ের দিন।

বিদ্যুতের 'রেশনিং' এ নেমেছিল সরকার, ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন জেলার কোন কোন এলাকায় কখন বিদ্যুৎ থাকবে আর কখন থাকবে না। এ বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিদ্যুৎ না থাকার সময়ে বাসা থেকে বের হয়ে আড্ডা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ হোস্টেলের ছাদে ছাদে গালির প্রতিযোগিতা কিংবা একসঙ্গে গান গাওয়ার দিনগুলো যেন ফিরে এসেছিল। শুধু তুমিই ফিরে আসনি তুনাবী, কখনো ফিরবে না জানি!

শীতের পাখির মতো না ফেরো তুনাবী, শীতের পর বসন্ত ফিরবেই। বসন্ত ঋতুটাই কেমন যেন। বসন্ত বাতাসে যেমন বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ ভেসে আসে, তেমনি এই বসন্তকালেই হয়তো মন উতলা হওয়ার গল্প বন্ধুকে বলা যায় না। তুনাবী, তুমি আর কোনো বসন্তে না ফিরলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিজ নৃশংসতায় ফিরবে। রাশিয়ার সঙ্গে যারই যুদ্ধ বাধুক, সেটা নেপোলিয়ন হোক আর হিটলার, শীতকালে নাকি যুদ্ধ জমে না। বসন্তে যুদ্ধের দামামা জমে উঠলে আরও বেশি প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে। যেভাবে প্রভাব পড়েছিল এ বছর তেল-গ্যাসের দামে।

বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে এ দেশে জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় সর্বোচ্চ বাড়ানো হয়েছিল, যা গত ৫০ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেয়। এরপর জ্বালানি তেলের হাত ধরে বাড়ে বাস, লঞ্চ, স্টিমার, সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া। তুনাবী, এ বছর দ্রব্যমূল্যের দাম যেমন বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ, আমার প্রতি তোমার অবহেলাও বেড়েছে তেমন। মানুষের জীবনের দাম শুধু কমে।

তুনাবী, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো কমেনি। সিনেমা দেখার সময়ও আমরা দু-দণ্ড শান্তি পাইনি। রাশিয়ান সেই জিজ্ঞাসাবোধক প্রবাদটার কথা মনে আছে? বলা হতো 'প্রেমাষ্পদকে না পেয়ে যারা আত্মহত্যা করে তাদের কী শহীদ বলা যাবে?' তোমাকে হারিয়ে আমি দেবদাস হতে পারি তুনাবী, মিন্নির 'নয়ন বন্ড' হতে পারবো না। সিনেমা হলের সংখ্যা যতই কমতে থাকুক, বাংলা ছবির হয়তো দিন ফিরছে তুনাবী। মিন্নি আর নয়ন বন্ডের কাহিনী নিয়ে ছবি হয়েছে যার নাম 'পরাণ'।

২০২২ ছিল বাংলা ছবির বাঁক বদলের সময়। দেশে এবং দেশের বাইরে সবচেয়ে আলোচিত হয়েছিল 'রেহানা মারিয়াম নূর', যা কান চলচ্চিত্র উৎসবেও আলোচিত হয়েছিল, আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও জিতেছে। আলোচিত হয়েছিল 'নোনা জলের কাব্য', 'পাপ পুণ্য', 'দেশান্তর' কিংবা 'মৃধা বনাম মৃধা' ছবিগুলো। তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে বাংলা ছবি 'পরাণ', 'দামাল' ও 'হাওয়া'। ভারতে পুরস্কৃত হয়েছে 'কুঁড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া'।

'হঠাৎ বৃষ্টি' ছবিটার কথা মনে আছে তুনাবী? ১৯৯৮ সালে এই ছবি দেখতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলাম আমরা। জানাজানি হয়েছিল আমাদের সম্পর্কের। তারপরও আমাদের জীবনটা যেন ছবিরই গল্প। তোমার বিচ্ছিন্ন হওয়া, ফেরার কথা বারবার বলে এক সময় আমেরিকা চলে যাওয়া, সবকিছুই স্মৃতি এখন। কয়েক বছর আগে এক চিঠিতে লিখেছিলাম, 'হয়তো আমি অচল ঘড়ি/তবুও হাতে রেখো/যে সময়টা স্মৃতি এখন সেটাই না হয় দেখ!'

আমার কোনো চিঠি কী তোমার নজর কেড়েছে তুনাবী?

আমরা যারা আম-পাবলিক, অনেক কিছুই তাদের নজর এড়ায় না। তুনাবী, তোমার সব স্মৃতি সমানভাবে মজুদ থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ আর আগের মতো নেই। আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার মতো রিজার্ভ কমে গেছে অনেক। আমাকে অবমূল্যায়ন করার মতো ডলারের বিপরীতে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে এ বছর। এলসি খোলা যাচ্ছে না ব্যাংকে। ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে পরছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, '২০২৩ এর মন্দাভাব কাটানোর চেষ্টা চলছে। আগামী বছর দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।'

যদি দেখাও দেয় দুর্ভিক্ষ, তোমার কাছে যেতে পারবো না তুনাবী। গণরোষের মুখে যেমন করে এ বছরের জুলাইতে শ্রীলঙ্কা থেকে পালিয়েছিল রাজাপাকসে পরিবার, আমি তেমন করে পালাতে পারবো না। সবাই মিলে সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করবো, তবু দেশ জুড়ে ধ্বংসলীলা চালাতে পারবো না তুনাবী। ভাঙতে যাবো না কারো ক্ষমতার প্রাসাদ।

ভালোবেসে খুনি হওয়ার দিন সম্ভবত আমি পার করে এসেছি। নায়ক শাকিব খান যেভাবে পার পেয়ে যান সংসারের বেড়াজাল, আমি তেমন করেও পার হতে পারবো না তুনাবী। পারবো না লুকোচুরি করে বিয়ে ও সন্তানের বাবা হতে। চাইবো না নায়িকা অপু বিশ্বাস বা বুবলির মতো কেউ এসে বলুক, এই দেখ আমার সন্তান। এই সন্তানের বাবা...

তুনাবী, তারচেয়ে কোনো একদিন, কোনো এক ভিনদেশে ক্রিকেটার শেন ওয়ার্নের মতো হোটেলের কামরায় নীরবেই মরে পরে থাকবো। না হলে তোমার প্রতি নিবেদিত ভালোবাসার গান গাইতে গাইতে হোটেলের কামরা থেকে হাসপাতালের পথেই মারা যাব। যেভাবে মারা গিয়েছেন বলিউড গায়ক কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ (কেকে)।

ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে মনে করবো আবদুল গাফফার চৌধুরীর মুখ। যিনি লিখেছিলেন সেই অমর গান, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাববো অভিনেতা ও নাট্যস্বজন মাসুম আজিজের মতো আমার জন্মই হয়েছিল কান্না করার জন্য। জনপ্রিয় এই অভিনেতাকে বেশিরভাগ সময়ে সিনেমা ও নাটকে কাঁদতেই দেখা যেত। আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো আমরা হারিয়েছি এ বছর মাসুম আজিজকেও।

তুনাবী, তোমার মুখে 'ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে' কিংবা 'ওরে নীল দরিয়া' গানটা বহুবার শুনেছি। অনেক কালজয়ী গানের সুরস্রষ্টা আলম খান ও গীতিকার মাজহারুল আনোয়ারও মারা গেছেন এ বছর। তোমার ভালোবাসা বুকে নিয়ে মরে যাওয়াটাই এক শিল্প। যেভাবে ভালোবাসা ও খেলার কৌশল দিয়ে ফুটবলকে শিল্প বানিয়েছিলেন পেলে। বছরের শেষে এসে মারা গেছেন সেই ফুটবল জাদুকরও।

'সেবা প্রকাশনী' বা 'মাসুদ রানা' খ্যাত কাজী আনোয়ার হোসেন বেঁচে থাকলে হয়তো তার কাছে গিয়ে বলতাম, দয়া করে একটা শেষ 'সেবা থ্রিলার' লেখেন, যার গল্প হবে তুনাবীর চলে যাওয়ার গল্প। সে আশাও পূরণ হয়নি। তারচেয়ে এটাই হয়তো ভালো হবে, রানী এলিজাবেথের দীর্ঘসময় রানী থাকার মতো তোমার ভালোবাসার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা, কিংবা ভারতীয় কিংবদন্তি গায়িকা লতার মতো একা একা থাকা।

বেঁচে থাকাটাই আসল। লড়াই করে বেঁচে আছি তুনাবী। সবার কপালে অবশ্য জোটে না এ সুযোগ। যেমন পারেননি সাবেক ক্রিকেটার মোশাররফ হোসেন রুবেল। ব্রেইন টিউমার হয়েছিল তার। ৩ বছর লড়াই, এরপর মৃত্যুর কাছে হেরে যান তিনি। আমার অবস্থা ইরান কিংবা এ দেশের বিরোধী দলের মতো। হিজাব ঠিকমতো না পরার অপরাধে পুলিশী হেফাজতে মাহশা আমিনীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা এখনো থামেনি ইরানে। আমার ভালোবাসাও যেমন থামেনি। কিন্তু ইরানের মানুষ কি পারবে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সফল হতে? পারবে কি বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কিছু করতে? তুমি যেমন আমেরিকায় থেকে সবকিছু ভুলছো, তেমনি বিদেশে থেকে খালেদা জিয়া তনয় তারেক রহমান চাইছেন বিরোধী দলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে। সেটা কি সম্ভব? নাকি তুনাবী তুমি না ফিরলেও একদিন তারেক রহমানকে ঠিকই ফিরতে হবে? কেউ কি কখনো ফিরে আসতে পারে? 'যতটুকু জল টেনে নেয় ভাটা তার সবটুকু ফেরে না জোয়ারে'!

তবু হাতজোড় করে বলি, ফিরে আসো তুনাবী। তোমাকে নিয়ে এক সুন্দর সকালে ঘুরতে যাবো পদ্মা সেতুতে, যেটি এ বছরই উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতুতে ওঠার আগে সারি সারি সাজানো হোটেলের কোনো একটায় ঢুকে সজোরে অর্ডার দেব, 'সবচেয়ে বড় ইলিশটা কেটে রান্না করো।' কোনো এক বিষণ্ণ সকালে তোমাকে নিয়ে যাব উত্তরা, মেট্রোরেলে চড়ে নেমে আসবো মতিঝিলের শেষ স্টেশনে। ধরে নেব, এটাই শেষ দেখা। তুমি যদি আসো, তাহলে কথা দিচ্ছি, বড় এক অনিয়মের কাজ করবো। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা মির্জা আব্বাসের মতো আমার যে শাস্তিই হোক না কেন, পদ্মা সেতুর পিলার, রেলিং বা মেট্রোরেলের কোথাও খোদাই করে লিখবোই 'তুনাবী+মুনাদ'। আশায় থাকবো 'সুজন সখী, নয়ন মনি, আলী আসমা'র মতো এই নামে ছবি হবে একদিন।

তুমি কি আসবে তুনাবী? ৩৬ বছর পরে যেভাবে বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর্জেন্টিনা, তুমি কি তেমন দেরি করে হলেও একবার আসবে? নাকি যেভাবে বাংলার দামাল মেয়েরা এ বছর সাফ কাপ ছিনিয়ে এনেছে, তোমাকে সেভাবেই ছিনিয়ে আনতে হবে? তুনাবী, মানুষের পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব না। আদালত প্রাঙ্গণ থেকে যেভাবে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তুমি কি আমাকে তেমন খারাপ হতে বলো? কেমন হবে, আমিও যদি খারাপ ছেলে হই?

নাকি তুমি পুঁজি বাজারের মতো অমীমাংসিত, তুনাবী? কখন ভালো আর কখন খারাপ বোঝা না গেলেও তুমি পথে বসাতে পারো মানুষকে। নাকি তুমি ফিলিস্তিন? আজীবন তোমার জন্য লড়াই করে করে মরবো, তবু জিততে পারবো না কোনোদিন। নাকি তুমি শিল্পী সমিতির নির্বাচনে নায়ক (?) জায়েদ খান আর নায়িকা নিপুণের মতো চেয়ার বা বালিশ বদল খেলো অবিরাম? কখন কে যে চেয়ারে থাকে, আমরা বুঝতেই পারি না?

তারচেয়ে বরং তুমি আলীকদমের উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেহেরুবা ইসলামের মতো হও। ১০ হাজার মানুষের সামনে ভেঙে ফেলো পুরস্কারের ট্রফি। কিংবা হতে পারো টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কায়সার খসরুর মতো। ঢাকা পোস্টের সাংবাদিককে যেভাবে গালাগালি করেছিলেন খসরু সাহেব, তুমি আমার সাথেও তেমন ব্যবহার করতে পার। যদি এই সামান্যতে ক্ষোভ না মেটে, তা হলে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল সাহেবের মতো আমাকে অবসরেও পাঠাতে পারো।

তুনাবী, তুমি কিন্তু জানো, কোনো ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু প্রেম? পারবে, আমাকে তোমার ভালোবাসা থেকে অবসরে পাঠাতে? সবাই কী আমার মতো শান্তিপ্রিয় কিংবা অহিংস প্রেমিক? আমি কখনো বলতে পারবো না কায়সার আহমেদ চৌধুরীর মতো, 'আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না'। বলতে পারবো না, কারো কারো মতো তুমি ব্যাংক থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে সিঙ্গাপুর বা আমেরিকায় গিয়ে বসে আছো।

তুনাবী, আমায় একটু শান্তিতে থাকতে দিও। তুমি কি চাও, ২০২৩ এ রাজনীতি যদি সহিংস হয়ে ওঠে তাহলে আমি নূর হোসেনের মতো বুকে আর পিঠে তোমার কথা লিখে রাস্তায় নামি?

ভালো থেকো তুনাবী। জেনে রেখো-

সব হারানো আমি দাঁড়ানো

দেবদাসের বেশে

চোখে রাজার ভালো সাজার

রোগ যে এলো দেশে!

ইতি,

তোমারই চালচুলোহীন

মুনাদ

Comments

The Daily Star  | English

What if the US election ends in a Trump-Harris tie?

While not highly likely, such an outcome remains possible, tormenting Americans already perched painfully on the edge of their seats ahead of the November 5 election

2h ago