বাইগুন ফল Talk

দেশের মানুষ আজ ২ ভাগে বিভক্ত। বেগুনপন্থী আর কুমড়াপন্থী (নাকি ঝিঙাপন্থী?)। আপনি কোন পক্ষে যাবেন?

..কঠিন প্রশ্ন।

স্কুল জীবনে আমাদের বাংলার শিক্ষক প্রচলিত প্রবাদ ব্যবহার করতেন না। 'যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন' না বলে তিনি বলতেন, যাহাই বাহান্ন তাহাই অস্ত্র হাতে একাত্তর। এরপর বায়ান্ন থেকে কীভাবে একাত্তর এলো, সেই বিশ্লেষণ করতেন। যেই লাউ সেই কদু না বলে বলতেন, যাহাই বেগুন তাহাই নিদ্রালু। পরে বিশ্লেষণ করতেন, বেগুনের আরেক নাম নিদ্রালু। বেগুন খেলে রাতে ভালো ঘুম হয়। তাই বেগুনকে অনেকেই নিদ্রালু বলেন।

বেগুনের গুণে পরে আসা যাবে। তবে জন্মলগ্ন থেকে বেগুন সমালোচিত। স্বভাবের দোষে ঢেঁড়সের মতো সে একঘরে হয়ে একা বাঁচতে শেখেনি। একবার ঢেঁড়সের ভরা যৌবনে আলু তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। ঢেঁড়স উত্তরে বলেছিল, আমি স্লিম ও সেক্সি। আলু তুমি গবেট ও সস্তা। তোমার সঙ্গে আমার প্রেম হতে পারে না। আলু দুঃখ পেয়ে অনেকের কাছে গেল। কেউ আলুকে ফেলতে পারলো না। জুটি হলো অনেকের সঙ্গে। যেমন: লাউ ও আলু, কুমড়া ও আলু, টমেটো ও আলু, করল্লা ও আলু, বেগুন ও আলু, পুইশাক ও আলু, মটরশুঁটি ও আলু, গাজর ও আলু, মূলা ও আলু।

এভাবে বাড়তেই থাকলো আলুর প্রেম ও জনপ্রিয়তা। দামও বাড়লো একসময়। সবই দূর থেকে দেখতে হলো ঢেঁড়সকে। কেউ আর ঢেঁড়সের কাছে প্রেম প্রস্তাব দিলো না। ঢেঁড়স একাই ছিল, একাই থেকে গেল।

কিন্তু বেগুন ঢেঁড়সের মতো হতে পারলো না। তাকে নিয়ে টেলিভিশনেও ঝগড়া হলো অনেক। তবে এর আগেই একবার বেগুণের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রধানমন্ত্রী বেগুনির পরিবর্তে মিষ্টি কুমড়ার বেগুনি (কুমড়ানি?) খেতে উপদেশ দিয়েছিলেন। প্রিয় পাঠক, আপনি কোনপন্থী হবেন সেটা আপনার ইচ্ছে। তবে বেগুন সবজি বা বাইগুন ফল এখন টক। বাংলার টক না, ইংরেজির টক। একেবারে টেলিভিশনের টকশোতে আলোচনার বিষয়। এখন বেগুন নিয়ে টানাটানি হচ্ছে, ভবিষ্যতে ঝিঙা বা কুমড়া নিয়েও টানাটানি হতে পারে।

তবে বেগুনের চরিত্র নাকি এমন ছিল না। উইকিপিডিয়ার মতে 'বেগুন মধুর, তীক্ষ ও উষ্ণ। পিত্তনাশক, জ্বর কমায়, খিদে বাড়ায় এবং বেগুন পরিপাক সহজ করে। ইফতারিতে বেগুনি একটি জনপ্রিয় খাবার।'

আয়ুর্বেদ বিজ্ঞানেও বেগুন ভীষণ জনপ্রিয়। আয়ুর্বেদ মতে, আপনি যদি বেগুন পুড়িয়ে গুড় ও খুব সামান্য মধু মিশিয়ে সকাল সকাল খান, তাহলে যকৃতের সমস্যার উপশম হবে এবং রাতে ঘুম হবে দারুণ। ঘুম আনতে বেগুনের জুড়ি নেই। কিডনি সমস্যায় বেগুনের প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিডনির সমস্যা, মূত্রনালির সংক্রমণ ঠেকায় বেগুন। অনেকে বলেন, বেগুন খেলে চুলকানি হতে পারে। (এই চুলকানির সঙ্গে টিভির টকশোর কোনো সম্পর্ক নেই)। কিন্তু আয়ুর্বেদ বলে, বেগুন সুন্দরভাবে পুড়িয়ে বেগুনের ছাই চুলকানির জায়গায় মাখালে চুলকানি কমে যায়। অ্যালার্জি, জ্বর, সর্দি বা কাশি নিরাময় হতে পারে বেগুনে। বেগুনকে ব্যঙ্গ করে যতই নারীবান্ধব সবজি বলা হোক, যতই রাজার বাগান থেকে রাজকন্যার বেগুন চুরির গল্প ফাঁদা হোক, বেগুন আসলে পুরুষবান্ধব ফল বা সবজি। আয়ুর্বেদ বলছে, পুরুষের জন্য এক অবধারিত ফল হচ্ছে বেগুন, যা পুরুষকে বীর্যবান করে।

স্বাধীনতার পর থেকে বছরের একটা নির্ধারিত সময়ে বেগুনের মূল্যবৃদ্ধি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেগুন হয়তো ব্যবসাবান্ধব ফল, এ কারণে রোজা এলে বেগুনের দাম বাড়বেই। বেগুন সম্ভবত আগে থেকেই দামী ছিল এবং বেগুন ফাও কেনার একটা বাতিক ছিল বাঙালির। ফাউ বা ফাও কেনার কথায় পরে আসা যাবে। ময়মনসিংহ গীতিকার জনপ্রিয় গান (মহীনের ঘোড়াগুলো ব্যান্ডের কল্যাণে গানটা জনপ্রিয় হয়েছিল, যা পরে অনেকেই গেয়েছেন) 'নয়াবাড়ি লইয়ারে বাইদ্যা লাগাইল বাইঙ্গন/সেই বাইঙ্গন তুলতে কইন্যা জুড়িল কান্দন/কাইন্দনা কাইন্দনা কন্যা না কান্দিও আর/সেই বাইঙ্গন বেইচ্যা দিয়াম তোমার গলার হার গো/তোমার গলার হার...'

বাইঙ্গন বা বেগুন বেঁচে কী তখন গলার হার কেনা যেত? এ কারণেই কী বেগুন নিয়ে এত তোলপাড়? সরকার বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কী সৎ কিংবা মানবকল্যানমুখী গবেষণাকে ভয় পায়? একবার বাংলাদেশ সরকারের জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের আওতাধীন ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির গবেষণা থেকে জানা গিয়েছিল, খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া গাভীর দুধে কীটনাশক, সীসা ও নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পেয়েছেন গবেষকরা। এমনকি, প্যাকেটজাত গাভীর দুধে সহনশীল মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক, সীসা ও নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। সে সময়ে ব্যবসায়ীদের অনেকের কাছে এটা ষড়যন্ত্রের 'ফসল' মনে হয়েছিল। এর আগেও গরু ও মুরগির খাদ্যে কীটনাশক, ট্যানারির উপাদান ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি সম্বলিত একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকা ও টেলিভিশনে।

২০১৯ সালে ফারুক সাহেবের গবেষণার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে অনেকের। আ ব ম ফারুক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের সাবেক পরিচালক। তিনি ও তার সহযোগী গবেষকরা দুধে ডিটারজেন্ট ও অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়ার গবেষণাধর্মী রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এই রিপোর্ট নিয়ে তোলপাড় হলে মৎস্য ও পানিসম্পদ বিভাগের তৎকালীন সচিব হুমকি দিয়েছিলেন ফারুক সাহেবকে। অনেকেই বিষোদগার করেছিলেন। অধ্যাপক ফারুক জানিয়েছিলেন, বহুজাতিক মিলমালিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের কটূক্তিতে তিনি বিষণ্ণ ও বিব্রত বোধ করেছেন।

এবার বেগুন নিয়ে অধ্যাপক জাকির হোসেন ও বেগুন ফাও কেনার গল্পে আসা যাক। জাকির সাহেবের সত্তরটির বেশি গবেষণাপত্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বেগুন নিয়ে তার গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২২ সালের আগস্টে। গবেষণাপত্রে তিনি দেখিয়েছেন, বিভিন্ন ধাতুর প্রভাবে কীভাবে মাটি ও পরিবেশ দূষিত হয় এবং এই দূষণ কীভাবে আমাদের আবাদি ফসলকে দূষিত করে। এর প্রতিকারের দিকটাও তিনি ও তার সহযোগী গবেষকরা তুলে ধরতে চেয়েছেন। বেগুনে যেসব ক্ষতিকর ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে, সেসব উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এমন বেগুন খেলে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। এরপরের ঘটনা ভাইরাল! তাকে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তিনি সেই টকশোতে যোগ দেওয়ার পর যা ঘটেছিল, তা সবাই জানে এখন।

কিন্তু যেসব ঘটনা চোখের আড়ালে রাখতে চায় ব্যবসায়ী বা বহুজাতিক সিন্ডিকেট, সেসবের কী হবে? দুধ, শিশু খাদ্য, বেগুন বা সবজি, চাল, ডাল, তেল নিয়ে সিন্ডিকেটবাজি কী তেমন কোনো ঘটনা? যেসব বহুজাতিক কোম্পানি বা বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ফসল কিনে মজুত করে, এরপর চড়া দামে বিক্রি করে, তাদের স্বার্থে কী আঘাত করে এসব সঠিক গবেষণা? আমজনতা বেগুন খাওয়া কমিয়ে দিলে কী বহুজাতিকদের ব্যবসা কমে যাবে? বাংলাদেশের পত্রিকা টেলিভিশনগুলো নির্দ্বিধায় এসব বহুজাতিক বা বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের স্বার্থ দেখে বলেই কী টেলিভিশন টকশোতে বাইগুন ফল টক হয়ে যায়? যেসব এলাকার বেগুন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল, সেসব এলাকার বেগুন কারা কিনছে বা কোন কোম্পানি মজুদ করেছে, সেই সংক্রান্ত কোনো রিপোর্ট কী দেখতে পাব পত্রিকা বা টেলিভিশনে?

আমরা জানি প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। দেশের সবগুলো পত্রিকা ও টেলিভিশনের বিপরীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিক্রিয়ায় কোনো কিছু ভাইরাল হলে আমজনতা কিছু কিছু সত্য জানতে পারে। আমরাও দুধের পর বেগুন সম্পর্কে জানলাম বিধায় গবেষক আ ব ম ফারুক ও জাকির হোসেনের জন্য শুভকামনা তুলে রেখে বেগুন প্রসঙ্গে ফিরে আসি।

বাঙালির নাকি বিনে পয়সায় বেগুন কেনার বাতিক ছিল। কেউ বলে, নীচের গল্পটা বাঙালির প্রচলিত হাসির গল্প, কেউ বলে এটা নাসিরউদ্দীন হোজ্জার। কেউ কেউ এর ভেতরে গোপাল ভাঁড়কেও টেনে আনতে পারে। আসলে বেগুনের গল্প নিয়েও টকশো কিংবা গবেষণা হতে পারে। আমরা বরং গল্প শুনে বিদায় নেই।

এক লোক (এখানে হোজ্জা বা গোপালও হতে পারে) গেছেন বেগুন কিনতে। তিনি খেয়াল করলেন, বাজারের শেষ মাথায় তিন দোকানে বেগুন বিক্রি হয়। তিনি তিন কেজি বেগুন চাইলেন। দোকানি তিন কেজি মেপে দেওয়ার পর বললেন, এই দুইটা বাইগুনও রাখেন। ধরে নেন এটা ফাউ বা আপনার জন্য ফ্রি। লোকটা তিন কেজি বেগুন দোকানির সামনে ঢেলে দিয়ে বললো, আমি ফাউ দুইটা নিলাম! একা মানুষ আমি, তিন কেজি বেগুন দিয়ে কী করবো?

বেগুনি অনেক খাওয়া হয়েছে। বেগুনকে এখন একটু একা থাকতে দিন। প্রার্থনা করুন, সিন্ডিকেট আর টেলিভিশনগুলো যেন আর বেগুনের নাগাল না পায়!

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

5h ago