কাগজে কলমে বাধ্যতামূলক আইসিটি, শেখানোর শিক্ষকই নেই

আইসিটি
একটি ল্যাপটপ নিয়ে একাধিক শিক্ষার্থী আইসিটি ক্লাশ করে। এর ফলে সবাই ঠিকভাবে শিক্ষকদের নির্দেশনা বুঝতে পারে না।ছবি: স্টার

কাগজে কলমে বাধ্যতামূলক, বাস্তবে আইসিটি শেখানোর শিক্ষকই নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ৯০ শতাংশ ল্যাবের করুণ অবস্থা, নষ্ট হয়ে পড়ে আছে ডেস্কটপ ও ল্যাপটপ। ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর দেওয়া হচ্ছে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে।

এভাবে খুঁড়িয়ে চলছে হবিগঞ্জ জেলার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের 'শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব'।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, 'সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপন' প্রকল্পের আওতায় ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত দেশের ৬৪টি জেলায় ৬৫টি ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাবসহ হাইস্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা বা তদূর্ধ্ব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৪ হাজার ১টি 'শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব' তৈরি করা হয়।

এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩৯০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় দফায় ব্যয় ধরা হয়েছে আরও ৯৩০ কোটি টাকা। এখন তৃতীয় দফায় মেয়াদ বৃদ্ধিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হবিগঞ্জ জেলায় ২৭২টির মধ্যে ১৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব চালুই হয়নি। ২ কিস্তিতে ১১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। কাগজপত্রে এসব ল্যাব চালু থাকলেও বাস্তবে এগুলোতে কোনো কার্যক্রম চলে না।

বাধ্যতামূলক আইসিটি শিক্ষা অথচ ৯০ শতাংশ ল্যাবের অচলাবস্থা

সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে হবিগঞ্জের ৮টি উপজেলায় ৬০টি ল্যাব চালু করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা ভেদে দেওয়া হয়েছে ১০ থেকে ১৭টি ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী। দ্বিতীয় ধাপে আরও ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

পর্যায়ক্রমে এসব স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোতেও ১৭টি ল্যাপটপ, চেয়ার টেবিল, স্মার্ট টিভি দেওয়া হয়েছে। এর আগে একটি কক্ষকে ল্যাবের উপযোগী করার জন্য প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে সরকারিভাবে ৬৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

সরেজমিনে হবিগঞ্জের ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ল্যাব পরিদর্শন ও আরও ৪৫টি প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে কথা বলে প্রায় ৯০ শতাংশ ল্যাবের অচলাবস্থার চিত্র পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার উচাইল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৫টি, শাহজালাল উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮টি, হবিগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮টি, চুনারুঘাট উপজেলার রাজার বাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৩টি, চুনারুঘাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০টি, মাসুদ চৌধুরী স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৭টি, বানিয়াচঙ্গ উপজেলার ইকরাম নন্দপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭টি, এলআর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১১টি, আইডিয়াল কলেজে ১৭টি, সুফিয়া মতিন কলেজে ৯টি, নাগুড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫টি, মাধবপুর উপজেলার প্রেমদাময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬টি, মাধবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ১১টি, আজমিরিগঞ্জ উপজেলার মমচান ভূঁইয়া দাখিল মাদ্রাসার ৪টি, আজমিরিগঞ্জ সরকারি কলেজে ৩টি, লাখাই উপজেলার অভয়চরণ রাধাচরণ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪টি, নবীগঞ্জ উপজেলার বনকাদিপুর আমজাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৬টি কম্পিউটারই অচল রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটিতে ১৭টি করে কম্পিউটার দেওয়া হয়।

এছাড়া বাহুবল উপজেলার মীরপুর ফয়জুন্নেছা বিদ্যালয়ের ১১টির মধ্যে ৩টি, মীরপুর বালিকা বিদ্যালয়ের ১১টির মধ্যে ৬টি, শাহজালাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২টি, শরৎচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০টির মধ্যে ৪টি কম্পিউটারই অচল। জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা ল্যাব ঘুরে দেখা গেছে, কোনো কোনো কম্পিউটারের মনিটর ভালো থাকলেও সিপিইউ নষ্ট। ল্যাপটপের কিবোর্ড কাজ করে না।

শিক্ষকরা বলছেন, কম্পিউটারগুলোর ভার্সন বেশ পুরোনো। করোনা মহামারির কারণে স্কুল ও কলেজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ল্যাপটপগুলো চার্জ দেওয়া হয়নি। এতে অধিকাংশ ল্যাপটপের ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে চুনারুঘাট মাসুদ চৌধুরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক ফজলুল হক তরফদার বলেন, 'নষ্ট ল্যাপটপগুলো স্থানীয়ভাবে মেরামত করিয়েছি। গত জুলাইয়ে সিলেট টিচার্স ট্রেনিং কলেজের টেকনেশিয়ান দিয়ে মেরামত করিয়েও ৭টি ল্যাপটপ সচল করা যায়নি। এছাড়া সরকারিভাবে মেরামতের জন্য কোনো নির্দেশনা বা অনুদান দেওয়া হয় না।'

তিনি আরও বলেন, 'শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবে ব্যবহৃত কম্পিউটার ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী মেরামতের জন্য সরকারিভাবে প্রত্যেক জেলায় সার্ভিস সেন্টার খোলা প্রয়োজন। এতে বেকার সমস্যা নিরসন হবে, অন্যদিকে নষ্ট কম্পিউটার নিয়ে ঢাকা ও সিলেটে শিক্ষকদের দৌঁড়াদৌড়ি করতে হবে না।'

মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ অনুপযোগী, ব্যবহারিক ক্লাসে ভরসা মুখস্থবিদ্যা

হবিগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, হবিগঞ্জে ১৬১টি হাই স্কুলের মধ্যে ৭২টি, ২৯টি কলেজের মধ্যে ১৫টি, ৬২টি মাদ্রাসার মধ্যে ১০টি এবং ২০টি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১৩টিতে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব রয়েছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মোট শিক্ষার্থী ১ লাখ ৯৭ হাজার ২৬৪ জন। এর মধ্যে হাইস্কুলে ৯৮ হাজার ৮২৩ জন, স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৪২ হাজার ৪১৩জন এবং মাদ্রাসায় ৩২ হাজার ৪৪৫ জন। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকের সংখ্যা ৩ হাজার ৯৯১ জন। মোট তিন হাজার ৫৬০টি শ্রেণিকক্ষের মধ্যে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ রয়েছে ৩৭২টি। এর মধ্যে ৯১টি অর্থাৎ ২৫ শতাংশই অনুপযোগী।

সরেজমিনে কয়েকটি স্কুলের ল্যাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় দেখা গেছে, একটি কম্পিউটার বা ল্যাপটপের সামনে একজন শিক্ষার্থী চেয়ারে বসার সুযোগ পেলেও বাকিরা দাঁড়িয়ে তা দেখছেন। আইসিটি শিক্ষায় ব্যবহারিক ক্লাস গুরুত্বপূর্ণ হলেও ব্যবহারিক ক্লাস করার সুযোগ নেই বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।

স্কুল শিক্ষার্থী পলি বলেন, 'কম্পিউটারের সামনে বসাও অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার।'

হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র নাবিল বলেন, 'এখন পর্যন্ত ল্যাবে ক্লাস করার সুযোগ হয়নি।'

শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা মুখস্থ করেই আইসিটি পরীক্ষা দিচ্ছেন। আর ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর নির্ভর করে শিক্ষকের মর্জির ওপর।

এদিকে কম্পিউটার থাকলেও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক নেই। অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে কোনোভাবে পাঠদান চলছে বলে জানা গেছে।

হবিগঞ্জের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কতজন আইসিটি শিক্ষক আছেন বা কতটি পদ খালি রয়েছে তা জানাতে পারেনি জেলা শিক্ষা অফিস।

তবে স্কুলগুলোতে শিক্ষক স্বল্পতার বিষয়টি স্বীকার করে জেলা শিক্ষা অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি হাই স্কুলগুলোতে আইসিটি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বিজ্ঞান বা অংকের শিক্ষকেরা সাধারণত এ বিষয়টির দায়িত্ব নিয়ে থাকেন।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রুহুলুল্লাহ বলেন, 'আইসিটি শিক্ষক সম্পর্কে আলাদাভাবে কোনো হিসাব নেওয়া হয়নি।'

যা বলছেন কর্মকর্তারা

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, 'শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব চালুর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছ থেকে আইসিটি শিক্ষক আছে কিনা জেনে নেওয়া হয়। তারপরেও কিছু হেরফের হতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ল্যাব ফি নিয়ে থাকে। ওই অর্থ দিয়ে কম্পিউটার মেরামত হয়ে যাওয়ার কথা।'

শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক (যুগ্মসচিব) মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বলেন, 'এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৩৯০ কোটি ব্যয় হয়েছে। চলমান দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৩০ কোটি টাকা। এ ছাড়া 'শেখ রাসেল স্কুল অব ফিউচার' পাইলট প্রকল্পে ৩০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নেওয়া হয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হবে। অংক ও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে (সেলফ লার্নিং) আত্মশিক্ষা লাভ করতে পারে সেজন্য জাপানের কুমন মডেল আনার চেষ্টা করছি।'

কম্পিউটার নষ্ট হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'কী পরিমাণ কম্পিউটার নষ্ট হয়েছে এর তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি। অচল হয়ে যাওয়া কম্পিউটারগুলোর পরিবর্তে নতুন কম্পিউটার দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।'

কম্পিউটার মেরামতের জন্য ওয়ালটনের সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের চুক্তি আছে বলেও জানান রেজাউল মাকছুদ জাহেদী। তিনি বলেন, 'যেসব প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব রয়েছে সেখানে একজন আইটিসি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।'

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, 'হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, এমপিও এবং ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে।'

'সারাদেশে ৭০০টি সরকারি স্কুলে আইসিটি শিক্ষক নেই' উল্লেখ করে উপমন্ত্রী বলেন, 'আইসিটি শিক্ষক না থাকলেও অন্য বিষয়ের শিক্ষকেরা পড়াচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাশও করছে। ৩০ হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যায়ক্রমে এনটিআরসির মাধ্যমে আইসিটি শিক্ষকের পদ পূরণ করা হবে।'

Comments