নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত বিমানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ইলেকট্রিশিয়ান, মেকানিক, ওয়েল্ডার, পেইন্টার, অপারেটর ও টেইলার্সের জন্য ১০টি পদে নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল গত ২১ অক্টোবর। পরীক্ষা শুরু হওয়ার প্রায় ২ ঘণ্টা তা স্থগিত করা হয়। কারণ, ফাঁস হয়েছে প্রশ্নপত্র।

এ সম্পর্কিত তথ্য বলছে, প্রশ্নফাঁসের ঘটনাটির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির নিচের পদের কেউ জড়িত ছিলেন না। বরং, বিমানের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের কয়েক মাসের পরিকল্পনায় এটি হয়ে থাকতে পারে।

কাকতালীয় মনে হলেও এই কাজের সুবিধার্থে প্রশ্নপত্র তৈরির কমিটিতে রাখার জন্য অন্তত ৩ জনকে সন্দেহজনক বদলি করা হয়েছে।

তাদের একজন মেজর তাইজ ইবনে আনোয়ার। তিনি গ্রাউন্ড সার্ভিস ইকুইপমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এবং নিরাপত্তা বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার। প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।

তাইজ এবং বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. যাহিদ হোসেন উভয়েই প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে তাদের যোগসূত্রের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

বিমানের মোটর ট্রান্সপোর্ট অপারেটর জাহাঙ্গীর আলম, মো. মাসুদ এবং মাহবুব আলী এই প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন, তাইজ এই ঘটনায় জড়িত।

তাইজের গাড়িচালক মাসুদ তার স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, নিয়োগ পরীক্ষার আগের দিন ২০ অক্টোবর বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে তাইজ নিজেই তাকে এক সেট প্রশ্নপত্র দিয়েছিলেন।

বিমানের এমডি যাহিদ হোসেনের গাড়িচালক মাহবুব আলী তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, 'পরীক্ষার ২ দিন আগে ১৯ অক্টোবর আনুমানিক বিকাল ৫টা থেকে ৬টার দিকে মাসুদ ফোন করে বলে, সে মেজর স্যারের কাছ থেকে প্রশ্ন পেয়েছে এবং পরের দিন তার কাছ থেকে প্রশ্ন নিতে বলে। ২০ অক্টোবর দুপুর ১২টা থেকে ১টার দিকে মাসুদ আমাকে কল করে। মাসুদ আমাকে তার বাসায় গিয়ে দেখা করতে বলে এবং আমি ডলিপাড়ার তার বাসায় যাই। তার একটি প্রিন্টার ছিল এবং সে প্রশ্নপত্রের দুটি কপি প্রিন্ট করেছিল।'

১ লাখ টাকা দেওয়ার শর্তে মাসুদের কাছ থেকে মাহবুব প্রশ্নপত্র নেয়।

মাহবুব বলেন, 'সেই রাতে আমি তার বাড়ির সামনে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সে আমাকে মেজর স্যারের বাড়ির সামনে যেতে বলে। মাঝরাতে মেজর স্যার নিচে নেমে তার ড্রাইভার মাসুদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। মেজর স্যার আমাকে দেখেছিলেন। মাসুদ আমাকে এমডি স্যারের গাড়ির চালক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়।'

তিনি বলেন, 'মেজর স্যার তার গাড়িচালককে প্রশ্নপত্রের ছবিসহ হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজটি দেখাতে বলেন এবং তার ব্যাগে থাকা একটি হার্ড কপির সঙ্গে সেটা মিলিয়ে দেখেন।'

এরপর বাকি টাকা পরে দেওয়ার কথা বলে মাসুদকে ২০ হাজার টাকা দেন মাহবুব।

জাহাঙ্গীর তার স্বীকারোক্তিতে বলেছিলেন, তিনি ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে ২টি বিভাগের গাড়িচালককে দেওযার জন্য প্রশ্নপত্রের একটি সেট ফটোকপি করেছিলেন। এর অর্ধেক মেজর তাইজকে দেওয়ার কথা ছিল।

বিমানের একটি তদন্তেও প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় মেজর তাইজের দিকে অভিযোগ উঠেছে। যদিও বিমানের এমডির বিরুদ্ধে তদন্ত করেনি কমিটি। এমনকি এমডিকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি।

দ্য ডেইলি স্টার সম্প্রতি বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনটির একটি অনুলিপি পেয়েছে।

মেজর তাইজকে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে আনতে ৮ মাস ধরে তৎপরতা চলেছে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ২০২০ সালের ২ মার্চ প্রকাশিত একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, তাইজকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোর থেকে ডিজিএম (নিরাপত্তা) হিসেবে বিমান বাংলাদেশে আনা হয়। ৩ মার্চ তিনি নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ২ মাস আগে ৭ জুলাই তাকে বিমানের গ্রাউন্ড সার্ভিস ইকুইপমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপকের পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তাকে এই দায়িত্ব দিতে অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক এস কে এম রেজাকে প্রশাসন বিভাগের 'অ্যাটাচমেন্ট ডিরেক্টর' করা হয়।

'অ্যাটাচমেন্ট ডিরেক্টর' পদ সম্পর্কে এক কর্মকর্তা বলেন, 'আপনার কোনো রুম নেই, টেবিল নেই, চেয়ার নেই, অফিস নেই। আপনাকে প্রতিদিন সকালে অফিসে রিপোর্ট করতে হবে, বায়োমেট্রিক ডিভাইসে সাইন ইন করতে হবে এবং তারপর দিনের বাকি সময় ভিজিটিং রুমে চেয়ারে বসে কাটাতে হবে।'

৩৫ বছর চাকরি করার পর অবসরের ঠিক আগে রেজাকে এই অপমানজনক পদ দেওয়া হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হন মাত্র ২ বছর আগে বিমানে যোগ দেওয়া তাইজ।

গত ১৬ অক্টোবর গ্রাউন্ড সার্ভিস ইকুইপমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণের ৩ মাস পর তাইজকে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য করা হয়।

অফিস আদেশ অনুযায়ী, প্রশাসন বিভাগের পরিচালক, বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ট্রেনিং সেন্টারের (বিএটিসি) অধ্যক্ষ এবং প্রশাসন বিভাগের মহাব্যবস্থাপককে নিয়ে ২০২০ সালের ১০ মার্চ প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি করা হয়।

আদেশে বলা হয়, এই কমিটি বিমানের যেকোনো কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞকে কমিটিতে সংযুক্ত করতে পারবে।

পরীক্ষার ঠিক ৪ দিন আগে এই কমিটিতে ২ জনকে সংযুক্ত করা হয়। তাদের একজন মেজর তাইজ এবং অপরজন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্রোডাকশনের প্রধান প্রকৌশলী।

নথি অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট বিভাগ গত ১৩ অক্টোবর সভা করে তাইজকে কমিটির সদস্য করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সূত্র জানায়, প্রশ্নপত্রটি ১৮ অক্টোবর কমিটির কাছে জমা দেওয়ার কথা ছিল এবং জুনিয়র অপারেটর (জিএসই) পদে পরীক্ষার জন্য সদ্য অন্তর্ভুক্ত সদস্য তাইজকে ৫০টির মতো প্রশ্ন তৈরি করে জমা দিতে হয়।

চার দিন পর দুই গাড়ি চালকের কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। তবে, তাইজ সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

তিনি বলেন, 'আমি মাসুদ ও জাহাঙ্গীরের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পড়েছি। তারা আমার সম্পর্কে যা বলেছে সেগুলো মিথ্যা।'

তিনি বলেন, 'আমি গাড়িতে থাকাকালীন তাকে মোবাইলে বাইরের কারো সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু সেসব কথায় কান দেইনি। এমডি আমাকে পছন্দ করেন এবং আমি সেনাবাহিনী থেকে এসেছি। এই ২টি বিষয় মাথায় রেখে তারা হয়তো ভেবেছে যে আমার নাম বললে তারা কিছু সুবিধা পেতে পারে। এ জন্যই হয়তো আমার নাম তারা বলেছে।'

বিমানের এমডি মো. যাহিদ হোসেন জানান, এস কে এম রেজা অসুস্থ থাকায় তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি অসুস্থ থাকতেন এবং কাজ করতে পারতেন না। তাই আমরা তাইজকে তার জায়গায় দায়িত্ব দেই।

নাজমুল হুদাকে বিএটিসির অধ্যক্ষ করার জন্য আপাতদৃষ্টিতে আরেকটি সন্দেহজনক বদলি হয়েছিল।

২০১৯ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে শাহনূর আহমেদ বিএটিসির ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন অনুষদের মহাব্যবস্থাপক ছিলেন।

তিনি ছাড়া সংস্থাটিতে আরও একজন মহাব্যবস্থাপক (গ্রাহক পরিষেবায়) ছিলেন। জানা যায়, অধ্যক্ষ হতে জ্যেষ্ঠতা অনুসারে তার সিরিয়াল ছিল শাহনূরের পরেই।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর শাহনূরকে বিমানের মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগে পাঠানো হয়। এই বিভাগটি বিমানে পরিচিত শাস্তিমূলক পদায়নের জন্য।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর শাহনূরকে বদলির ১৩ দিন পর নাজমুল হুদাকে প্রশিক্ষণ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক থেকে সরাসরি অধ্যক্ষ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে নাজমুল জানান, তিনি কোনো কিছুর সঙ্গেই জড়িত নন। তার পদায়নের বিষয়ে ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত ছিল।

তিনি বলেন, 'আমি এই পদের জন্য কাউকে কিছু বলিনি। ম্যানেজমেন্ট আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে।'

প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এরপর আছেন স্বয়ং বিমানের এমডি। তিনি বিমানের এমডি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হওয়ার পাশাপাশি বিপণন ও বিক্রয় পরিচালক এবং প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন।

বদলির রেকর্ড অনুযায়ী, মন্ত্রণালয় একজন কর্মকর্তাকে বিমানে পাঠিয়েছিল এমডির হাতে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে থাকা এসব খালি পদ পূরণের জন্য। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই কর্মকর্তাকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি।

যাহিদ প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক থাকাকালীন গত ১৩ জুলাই এমডি ও সিইও পদে পদোন্নতি পান। কিন্তু নতুন কাউকে পদায়ন না করায় তিনি প্রশাসন ও মানবসম্পদ পরিচালক পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন।

প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালকই প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির সভাপতি।

'ফৌজদারি অপরাধ'

গত ২১ আগস্ট কামরুল হাসান নামে একজন যুগ্ম সচিবকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে পাঠানো হয় বিমানের পরিচালক হিসাবে যোগদানের জন্য। তিনি ১২ সেপ্টেম্বর বিমানে যোগদান করতে পারবেন বলে রিপোর্ট করেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রধান সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করার পর গত ৯ নভেম্বর তিনি বিমানে যোগ দিতে পেরেছেন।

এই পদে অন্তত দেড় মাস আগে কামরুল যোগ দেওয়ার জন্য তৈরি থাকলেও পদ ছাড়েননি যাহিদ। কেননা, ওই পদে থাকলেই কেবল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব।

কামরুল যোগ দেওয়ার পর গ্রাহক পরিষেবা বিভাগের পরিচালককে প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক করা হয় এবং কামরুলকে গ্রাহক পরিষেবা বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন বিমানের এমডি।

কামরুলের বিষয়ে তিনি বলেন, 'কামরুলকে মন্ত্রণালয় নিয়োগ দেওয়ার পর তাকে পদায়নের জন্য বোর্ড মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। মন্ত্রণালয় তাকে পাঠানোর পর বিষয়টি পরবর্তী বোর্ড মিটিংয়ে উত্থাপিত হয়।'

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব বিমানের বোর্ডের চেয়ারম্যান সাজ্জাদুল হাসান জানান, বোর্ড নিয়োগ ও বদলি করে না। এটা করে বিমানের ম্যানেজমেন্ট।

তিনি বলেন, 'তারা কেবল বোর্ডকে জানিয়ে দেয়। কেউ বিমানে যোগ দিলে রিপোর্ট করে এমডিকে।'

যোগদানের তারিখ এমডি ঠিক করেন কি না, জানতে চাইলে তিনি হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। তিনি আরও জানান, আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে একাধিক বোর্ড মিটিং হয়েছে।

গত ২৬ এপ্রিল বিমানের এসডির সই করা একটি প্রশাসনিক আদেশ অনুসারে, নিয়োগ কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা থাকার কথা ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ নথি, উপস্থিতি শীট, কমিটির সভার কার্য বিবরণীসহ অফিসিয়াল কোনো রেকর্ডে মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার উল্লেখ নেই।

বেসামরিক বিমান পরিবহন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও অভ্যন্তরীণ এ বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, 'প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি অপরাধ। অপরাধের সঙ্গে জড়িত কাউকে আমরা ছাড় দেবো না।'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

5h ago