অব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিতে সমতলের চা শিল্পের বিকাশ

চা পাতা তুলতে ব্যস্ত শ্রমিক। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

মাত্র ৩ দশক আগেও উত্তরের একটা দারিদ্রপীড়িত জেলা ছিল পঞ্চগড়। আখ, ধান আর কিছু মৌসুমি শাক-সবজিই ছিল এই অঞ্চলের মানুষের জীবিকার প্রধান উৎসাহ। যে সময় খেতে ফসল থাকতো না, সেই সময় বেকার বসে দিন কাটাতে হতো অনেকের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১৬ সালেও রংপুরের জেলাগুলোতে দারিদ্রের হাড় ছিল ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ। বর্তমানে রংপুরের অন্য জেলাগুলোতে দারিদ্রের হার খুব একটা না কমলেও, পঞ্চগড়ে তা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।

নদী বা মাটি থেকে পাথর উত্তোলন এবং ক্রমাগত চা-বাগান বৃদ্ধি, পর্যটন শিল্পের হাতছানির ফলে এই জেলায় এখন শ্রমিক সংকট তৈরি হয়েছে। কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে অনেক মানুষের।

বর্তমানে শুধু পাথর সংগ্রহ, বাছাই, গুঁড়ো করা এবং চা-বাগানগুলোতে নিয়মিত ১ লাখেরও বেশি নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যাদের দৈনিক আয় ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা।

২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলের ৫টি জেলায় প্রায় ১১ হাজার ৪৩৩ একর সমতল ভূমিতে চা-বাগান গড়ে উঠেছে। এই সব বাগানে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হলেও, আরও সমপরিমাণ শ্রমিকের সংকট আছে বলে জানিয়েছেন পঞ্চগড়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের আঞ্চলিক কর্মকর্তারা।

প্রথম দিকে সমতল ভূমির এই চা শিল্প সবার জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিলেও, বর্তমানে এই শিল্পে দেখা দিয়েছে নানা রকমের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম। এর মধ্যে প্রধান সমস্যা দেখা দিয়েছে চা পাতার উপযুক্ত দাম না পাওয়া। এসব অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দ্রুত দূর করতে না পারলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে উত্তরের এই বিকাশমান চা শিল্প।

২০০০ সাল থেকে পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। এই সময় চা-বাগান করে উদ্যোক্তা হিসেবে সরকারের কাছে থেকে পুরস্কার পান তেঁতুলিয়ার শালবাগান এলাকার চা-বাগান মালিক মোশারফ হোসেন। সেই সময় কাছাকাছি চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা না থাকায় নিজেই চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা গড়ে তোলেন।

এর কয়েক বছর পরে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন মোশারফ। তিনি অভিযোগ করেন, শত চেষ্টা করেও ব্যাংক থেকে ঋণ পাননি।

চা বোর্ডের তথ্য মতে, সমতল ভূমিতে ১ কেজি চা পাতা উৎপাদনে খরচ হয় ৮ থেকে ১০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি চা পাতা কৃষক বিক্রি করতে পারছেন মাত্র ১৪ থেকে ১৬ টাকা দামে।

কৃষকের অভিযোগ কারখানা মালিকদের কাছে ১০০ কেজি (১ কুইন্টাল) চা পাতা বিক্রি করলে সেখানে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পাতা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মালিকরা নানা অজুহাতে (ভেজা, নিম্নমানের, চা বিক্রি হচ্ছে না) কর্তন করে।

প্রতি কেজি চা পাতা তোলার জন্য শ্রমিকদের দিতে হয় ৩ টাকা। সে হিসাবে ১০০ কেজি চা পাতা উত্তোলনে খরচ ৩০০ টাকা। ১০০ কেজি চা উৎপাদন খরচ ১ হাজার টাকা।

কৃষক যদি ১০০ কেজি চা পাতা ১৫ টাকা দরে বিক্রি করেন, এর মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু সেখানে কৃষক পান গড়ে ৮০ কেজির মূল্য ১ হাজার ২০০ টাকা। সেখান থেকে শ্রমিক ও উৎপাদন খরচ ১ হাজার ৩০০ টাকা এবং পরিবহন খরচ ১০০ টাকা বাদ দিলে প্রতি ১০০ কেজিতে কৃষকের ক্ষতি ২০০ টাকা।

চা বোর্ডের কর্মকর্তা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে চা পাতা ভেজা থাকলে কারখানা মালিকরা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ (১০০ কেজিতে ১০ কেজি) কর্তন করতে পারবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কারখানা মালিকরা ২০ শতাংশের বেশি কর্তন করছেন, যা অনৈতিক। অতিরিক্ত কর্তন বন্ধে কারখানাগুলোতে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয় বলে জানান কর্মকর্তারা।

কৃষকের অভিযোগ, শুধু বর্ষা মৌসুমে নয়। সারা বছর কারখানা মালিকরা ২০ থেকে ৪০ শতাংশ কর্তন করেন এবং এই বিষয়ে চা বোর্ড বা স্থানীয় প্রশাসন উদাসীন ভূমিকা পালন করে। চা পাতার দাম বাড়ানোর জন্য কৃষক মাঝে মাঝেই রাস্তা অবরোধ, আন্দোলন করলেও কিছুই হচ্ছে না।

বেসরকারি এসব কোম্পানির শোষণ থেকে বাঁচতে কৃষকরা দীর্ঘদিন যাবৎ এই এলাকায় একটা সরকারি কারখানা স্থাপনের দাবি জানাচ্ছেন। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে কোনো নিলামকেন্দ্র না থাকায় এখনে উৎপাদিত চা চট্টগ্রামে বা সিলেটে নিয়ে নিলাম করতে হচ্ছে। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, ফলে কৃষক কম দাম পাচ্ছেন।

এ বছর জেলা প্রশাসন প্রতি কেজি চা পাতার দাম ১৮ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও, সেই দামে চা কিনছে না কারখানা মালিকরা। তারা নিজেরা  সিন্ডিকেট তৈরি করে পিক টাইমে চা পাতা কিনতে চায় না বলে অভিযোগ কৃষকের। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, লাভবান হচ্ছে কারখানা মালিকরা। অনেকে ভালো দাম না পেয়ে চা-বাগানের মধ্যে আম বাগান করেছেন। গত ৫-১০ বছরে মধ্যে যেসব কৃষক চা-বাগান করেছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ এখনো লাভের মুখ দেখেননি বলে জানিয়েছেন।

উত্তরাঞ্চলে চা পাতা তোলা হয় কাস্তে দিয়ে। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

কৃষক বলছেন, একটি জমিতে চা-বাগান করা হয় ৫০ থেকে ৬০ বছরের জন্য। ১ বিঘা জমিতে বাগান করতে প্রায় ৭ হাজার চারা লাগে, যার বাজার মূল্য প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। প্রথম ৪ বছর তেমন ফলন পাওয়া যায় না। গাছের বয়স ৫ বছর হলে, ১ বিঘা বাগান থেকে বছরে ৪ থেকে ৫ হাজার কেজি চা পাতা পাওয়া যায়। তবে বাগান করার পরে ১ বিঘা জমির চা দেখ-ভাল করতে প্রতি বছরে খরচ হয় ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা।

কারখানা মালিকরা বলছেন, চা পাতা ভেজা থাকায় তারা কর্তন করেন। তা না হলে লোকসানে পড়বেন। যেখানে চা পাতা তোলার নিয়ম হাত দিয়ে, সেখানে এই অঞ্চলে চা তোলা হয় কাস্তে দিয়ে। বাগান থেকে চা পাতা  সংগ্রহ করার নিয়ম প্রতি রাউন্ড ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে। সেখানে এই এলাকায় চা পাতা উত্তোলন করা হয় প্রতি রাউন্ড ৩০ থেকে ৪০ দিন পরে। এতে করে চায়ের পাতা পোক্ত হয়ে যায়। ভালো চা উৎপাদন করতে ২টি পাতা, একটি কুঁড়ি তুলতে হয়। কিন্তু, কাস্তে দিয়ে কাটার ফলে অনেক সময়  ডালসহ একটি কুঁড়ি ১০টি পাতা তোলা হয়। ফলে চায়ের মান খারাপ হয়।  এ ছাড়া, নিলামে চায়ের দাম কম হওয়ায় তারা কৃষকদের ভালো দাম দিতে পারছেন না।

পঞ্চগড়ে চা শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা। এই এলাকার কৃষক চা বোর্ড উদ্ভাবিত ২৩টি ভালো মানের চা চাষ না করে তুলনামূলক দ্রুত বর্ধনশীল নিম্নমানের ভারতীয় প্রজাতির চা চাষ করছেন দ্রুত ফলন পাওয়ার আশায়। এই এলাকায় চা চাষের ধরন সিলেট বা চট্টগ্রামের মতো নয়। অধিক লাভের আশায় তেঁতুলিয়াসহ পঞ্চগড়ের অন্যায় উপজেলায় প্রান্তিক কৃষক বসতবাড়ির আশেপাশে, আবাদি জমিতে চায়ের বাগান করছেন, যাদের চা চাষে পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ফলে, তারা নিজেদের ইচ্ছে মতো জমিতে সার দিচ্ছেন। এতে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, উত্তরাঞ্চলের মাটিতে আগে থেকেই অম্লতার পরিমাণ বেশি। এ জন্য দীর্ঘদিন মাটিতে বেশি মাত্রায় সার ব্যবহার করলে দিন দিন জমির উর্বরতা কমে যাবে বলে জানিয়েছেন মৃত্তিকা গবেষকরা। মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সার প্রয়োগ করলে চা উৎপাদনের খরচ আরও কমানো যাবে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য মতে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও দিনাজপুরে বড় চা-বাগান আছে ৩০টি। তার মধ্যে ৯টি নিবন্ধিত এবং ২১টি অনিবন্ধিত। ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগান আছে ৮ হাজার ৬৭টি। এর মধ্যে ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক চা চাষির সংখ্যা ৭ হাজারের বেশি।

গত বছর উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো থেকে চা (ফিনিশ গুড) উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪৫ লাখ কেজির বেশি, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ২২৫ কোটি টাকা। সরকার চা-বাগানের কল্যাণে গত অর্থবছরে ৩৪ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। চা বোর্ডও পেয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা।

উত্তরাঞ্চলে ২০২০ সালের তুলনায় চা-বাগান বেড়েছে প্রায় ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং উৎপাদন বেড়েছে ৪১ শতাংশ। বর্তমানে দেশের মোট উৎপাদনের ১৫ শতাংশ যোগান দিচ্ছে সমতলের এই চা-বাগানগুলো।

এই অঞ্চলে চা চাষ এবং উৎপাদন বাড়ছে। এর থেকে সরকার, চা বোর্ড ও কারখানার মালিকরা লাভবান হলেও বছরের পর বছর লোকসান গুনছেন কৃষক।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য মতে, ২০২০ সালে দেশে উৎপাদিত চায়ের পরিমাণ ৮৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন কেজি। যার মধ্যে ৬টি কোম্পানি ২২টি দেশে মাত্র ২ দশমিক ১৭ মিলিয়ন কেজি রপ্তানি করতে পেরেছে। রপ্তানি উৎসাহিত করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কেবলমাত্র ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া শুরু করেছে। প্রণোদনার পরিমাণ আরও বাড়াতে পারলে এই খাত থেকে যেমন কৃষক লাভবান হবে, তেমনি লাভবান হবে চা উৎপাদন কারখানাগুলো।

চা শিল্প উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার দারিদ্রপীড়িত মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। কিন্তু সরকারি নজরদারি এবং নানা অব্যবস্থাপনায় ক্ষতির সম্মুখীন এই শিল্প।

এই শিল্পের উন্নয়নে সরকারকে এখনই নিতে হবে যথাযথ ব্যবস্থা। কৃষক যেন ফসলের ন্যায্যমূল্য পান এবং কারখানাগুলো লাভ করতে পারে, সেই দিকে নজর দিতে হবে। কৃষকের হাতে প্রযুক্তি দিতে হবে। তাদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কম খরচে উৎপাদন করতে পারেন।

শ্রমিক সংকট নিরসনে পাশের জেলাগুলো থেকে শ্রমিক নিয়োগ করা যেতে পারে। কৃষকের দাবির সঙ্গে একমত হয়ে পঞ্চগড়ে দ্রুত নিলাম কেন্দ্র খুললে পরিবহন খরচ অনেক কমবে। এতে কৃষক ও কারখানা মালিকরা লাভবান হবেন। পাশাপাশি কৃষক ও কারখানা মালিকরাও যেন এই শিল্প উন্নয়নের স্বার্থে সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে ঋণ পান সেই দিকটাও দেখতে হবে।

সমতলের বিকাশমান এই শিল্পের অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনা দূর করতে না পারলে অচিরেই তার মূল্য দিতে হতে পারে।

মোস্তফা সবুজ: নিজস্ব সংবাদদাতা,বগুড়া, দ্য ডেইলি স্টার

 

 

Comments

The Daily Star  | English

Iran to begin Uranium enrichment with advanced centrifuges: UN watchdog

Iran plans to begin uranium enrichment using thousands of advanced centrifuges at its key nuclear facilities, Fordo and Natanz, the United Nations' International Atomic Energy Agency (IAEA) reported on Friday

1h ago