উত্তরা ফাইন্যান্সের বিনিয়োগকারীরা অন্ধকারে, চলছে ‘অপ্রয়োজনীয়’ খরচ
আর্থিক রেকর্ডে অসঙ্গতি, বোর্ড পুনর্গঠন ও গত পাঁচ বছরে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দিলেও উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস এ বছর প্রচুর টাকা খরচ করেছে 'অপ্রয়োজনীয়' খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালে এই ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির (এনবিএফআই) আর্থিক প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে। কেপিএমজি বাংলাদেশের মাধ্যমে ২০২০ সালে নিরীক্ষা চালানো হয়। এতে পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক অসঙ্গতি পাওয়া যায়।
এরপর ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উত্তরার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ করে পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নতুন বোর্ড গঠন করে। তবে দৃশ্যত এর তেমন প্রভাব পড়েনি কোম্পানির পরিস্থিতি উন্নয়নে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য বলছে, ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও তা অনুমোদন করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত পাঁচ বছর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের লভ্যাংশ পাননি। বর্তমান আর্থিক অবস্থা সম্পর্কেও ধারণা নেই যেহেতু আর্থিক প্রতিবেদনই আর প্রকাশ করা হচ্ছে না।
এর আগে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তারা ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ পেয়েছিল। ২০১৮ সালে তা ছিল ২০ শতাংশ।
এদিকে গত পাঁচ বছরে উত্তরার শেয়ারের ব্যাপক দরপতন দেখেছেন বিনিয়োগকারীরা। ২০১৯ সালে যা ছিল ৫৫ টাকা, গত সোমবার তা হয় ১৫ টাকা ৮০ পয়সা।
প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ বিনিয়োগকারী, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আট কোটি নয় লাখ শেয়ার আছে। এটি মোট শেয়ারের প্রায় ৬১ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
এক শেয়ার বিনিয়োগকারী আব্দুল মান্নান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিষ্ঠানটির ভালো ট্র্যাক রেকর্ডের জন্য আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু গত কয়েকবছরে কোন লভ্যাংশ পাইনি। পাশাপাশি শেয়ারের দামও কমে গেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে আসলে কী চলছে তা নিয়ে অন্ধকারে আছি।'
গত মার্চে উত্তরার পরিচালনা পর্ষদ চলতি বছর এক কোটি ৫৪ লাখ টাকায় দুটি হোন্ডা সিআর-ভি ১.৫ টার্বো বা স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি) কেনার অনুমোদন দেয়।
প্রতিষ্ঠানটি শীর্ষ ব্যবস্থাপনা ও বোর্ড থেকে ২৫ কর্মকর্তাকে কক্সবাজারে নিয়ে আসে। গত ৭ থেকে ৯ মার্চ 'কৌশলগত ব্যবসায়িক বৈঠকের' জন্য তাদেরকে ব্যয়বহুল হোটেলে রাখতে ১৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা খরচ করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির সৌজন্যে কয়েকজন বোর্ড সদস্যের সঙ্গে তাদের সহধর্মিণীরাও ছিলেন। তাদেরকেও উপহার দেওয়া হয়।
গত শনিবার এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টার বলেন, 'একাধিক বার আর্থিক প্রতিবেদন জমা দেয়া হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা গ্রহণ করেনি। কারণ সেই রিপোর্ট কেপিএমজির অনুসন্ধান বিবেচনায় নেয়নি।'
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বোর্ডের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনেই আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করবে, কিন্তু তারা তা করেনি।
তিনি আরও বলেন, 'প্রধান আর্থিক কর্মকর্তাদের (সিএফও) কাছ থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন পাইনি। ফলে কয়েকবার সিএফও পরিবর্তন করতে হয়েছিল।'
তার ভাষ্য, প্রতিবেদন তৈরিতে তারা 'অহেতুক' দেরি করেছে। তা ছাড়াও, প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক তথ্য কাগজে ছিল কিন্তু ডিজিটালাইজড ছিল না। এ কারণে এটি সংকলন করা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয় ছিল বলে তিনি দাবি করেন।
মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান আরও বলেন, '২০০৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আর্থিক হিসাব যাচাইয়ের জন্য অডিট ফার্ম নিয়োগ করা হয়েছে। আগামী মাসে নতুন সিএফও যোগ দেবেন। আশা করছি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।'
'বাংলাদেশ ব্যাংক এটি অনুমোদন দিলে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পরের বছরগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। প্রতিষ্ঠানটি তখন লভ্যাংশ দিতে পারবে।'
'বোর্ড অনেক অভ্যন্তরীণ নীতি তৈরি করেছে' উল্লেখ করে তিনি জানান, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ 'অন্যায়কারীদের' বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি ১৭০ কোটি টাকারও বেশি উদ্ধার করেছে যা আগে চিহ্নিতই করা যায়নি। এক সাবেক পরিচালক প্রায় ৪২০ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছেন বলে জানান মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান।
গাড়ি কেনার বিষয়ে তার বক্তব্য—উত্তরার ছয়টি গাড়ি 'অনেক পুরোনো'। এর জন্য বোর্ড এগুলো বিক্রি করে নতুন গাড়ি কেনার অনুমোদন দেয়। গাড়ি কেনায় কোনো অসদুপায় অবলম্বন করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
কক্সবাজার বৈঠক প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, তিনি ও আরেকজন পরিচালক ওই অনুষ্ঠানে যাননি। এছাড়া অধিকাংশ পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তারা এতে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, 'আসলে ম্যানেজমেন্ট প্রস্তাব দিয়েছে... এ ধরনের আয়োজনের কথা প্রকাশিত হলে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি উন্নত হবে বলে তারা যুক্তি দিয়েছেন। তাই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছি।'
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটসের মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই খরচ অগ্রহণযোগ্য। এটি করপোরেট সুশাসনের চরম লঙ্ঘন।'
তার মতে, 'নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা। উত্তরার প্রকৃত আর্থিক অবস্থা চিহ্নিত করা।'
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আর্থিক প্রতিবেদন দাখিল ও বার্ষিক সাধারণ সভা আয়োজনে উত্তরার গাফিলতি করেছে কিনা, তা খতিয়ে দেখবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।'
Comments