বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান
চলমান ভয়াবহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট জনজীবন, কর্মসংস্থান ও সার্বিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় তৈরি করেছে। সরকার বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে খরুচে প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি কমিয়েছে।
গত ৯ অক্টোবর ৩৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ ছিল, ৩৬টি কেন্দ্র সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করা হয় এবং ৬২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র আংশিক উৎপাদনে ছিল। রাতের পিক-আওয়ারে লোডশেডিং থাকছে প্রায় পৌনে ২ হাজার মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে সরকারের উদ্যোগ হচ্ছে, রিজার্ভ বাঁচাতে আমদানি নির্ভর প্রাথমিক জ্বালানি কম কিনে, বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে পরিকল্পিত লোডশেডিং করা এবং নাগরিকদের বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানানো। কিন্তু 'ডলার ড্রেইনের' প্রধানতম খাতগুলো খোলা রেখে এমন চেষ্টা কি আদৌ টেকসই?
২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ ছিল প্রতি ঘণ্টায় ৫১২ কিলোওয়াট। ভারত মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের এই ল্যান্ডমার্ক অতিক্রম করেছে ২০ বছর আগে। ভারতের বর্তমান মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১ হাজার ২৫০ কিলোওয়াট। বাংলাদেশের মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার ভারতের গড় ব্যবহারের ৪০ শতাংশ এবং বৈশ্বিক গড়ের মাত্র ১৭ শতাংশ। নিম্ন মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের দেশে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিপর্যায়ের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের সুযোগটা একবারেই সীমিত।
তাহলে উপায় কী?
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সমন্বিত ইকোসিস্টেম তৈরি
স্বল্পমেয়াদে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও ধনিক শ্রেণীর ব্যক্তিগত গাড়ির বদলে গণপরিবহণ বাড়াতে হবে, গণপরিবহনের টিকিট সস্তা করতে হবে, দূরপাল্লার বাসের বদলে ট্রেন বাড়তে হবে। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে শহরে-নগরে ট্রাম, রেল বা মেট্রো পরিকল্পনা প্রয়োজন। শিল্পে ও ব্যবসায় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উৎসাহ ও শুল্কায়ন সুবিধা প্রয়োজন। এসি, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, ফ্রিজ, লিফট ইত্যাদিতে এনার্জি সেভিং যন্ত্র ব্যবহারে শুল্ক প্রণোদনা দিতে হবে, কম বিদ্যুৎ ব্যবহারে কম বিল, বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারে বেশি বিলের পরিবেশ বান্ধব পলিসি সাজাতে হবে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করতে হবে। পলিসি ছাড়া মৌখিক আহ্বানে বিদ্যুৎ সাশ্রয় অসম্ভব।
'ডলার ড্রেনিং' ক্যাপাসিটি চার্জ বন্ধ
১৪ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা 'ডলারে' গচ্ছা গেছে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে। ভর্তুকির চক্র থেকে বিদ্যুৎখাতকে বের করার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দরকার। ক্যাপাসিটি চার্জ না থাকলে বিনিয়োগ আসবে না বিদ্যুৎখাতে, এমন মিথ্যা থামাতে হবে। বেসরকারি উৎপাদনকারীরা স্থানভেদে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বর্ধিত দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবেন, সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে নূন্যতম এক-চতুর্থাংশ বা অর্ধেক (এমপিপি কাঠামো) বিদ্যুৎ কেনার নিশ্চয়তা দেবে— এই ২ শর্তই যথেষ্ট। সঙ্গে সহজ ব্যাংক ঋণের বিষয়টি থাকবে।
ক্যাপাসিটি চার্জ লুটেরা মডেল। স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে ওভারহোলিং চার্জ। অর্থাৎ যতটুকু সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উৎপাদনে থাকতে পারবে না (সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ), সেসময়ের জন্যও একটা চার্জ দেওয়া, যাতে বিনিয়োগ সুরক্ষিত হয়। কিন্তু মাসের পর মাস উৎপাদনে অক্ষম, অথচ ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া বাজেট ড্রেনিং অপচুক্তি।
ডলারে পেমেন্ট করা আইপিপি চুক্তি বিদ্যুৎখাতের প্রধানতম সংকটের জায়গা। 'সরকারের সঙ্গে করা চুক্তি' ব্যাংক ঋণের কোলেটার্যাল বলে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ডলার নয় বরং টাকায় পেমেন্ট দিতে হবে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশীয়, তাদেরকে ফরেন কারেন্সি পেমেন্ট দেওয়া অযৌক্তিক। ইউনিট প্রতি উচ্চমূল্য, ক্যাপাসিটি ও ওভারহোলিং চার্জ, স্বল্পমূল্যে জ্বালানি ও জমি, সহজ ব্যাংক ঋণ, শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা ইত্যাদি 'বাজেট ড্রেনিং' গ্যারান্টি বন্ধ না করলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ফান্ড সংকটের সমাধান নেই।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য মতে, গত ১২ বছরে পিডিবি লোকসান গুনেছে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। বিপরীতে চলমান ও আগামী এই ২ অর্থবছরেই পিডিবি লোকসান গুনবে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিগত ১২ বছরে বিদ্যুৎখাতে সরকার মোট যা লোকসান করেছে, শুধুমাত্র আগামী ২ বছরেরই তারচেয়ে বেশি লোকসান করবে।
আগে পিডিবি বছরে যে পরিমাণ লোকসান গুনত, এখন ২ মাসেই তার কাছাকাছি পরিমাণ লোকসান হচ্ছে। ক্যাপাসিটি চার্জ ও জ্বালানি আমদানি মূল্য মূলত ডলার পেমেন্ট বলে ক্যাপাসিটি চার্জের বর্তমান মডেল কোনোভাবেই টেকসই নয়।
দায়মুক্তি আইন বিদ্যুৎখাতে রাষ্ট্রীয় বাজেট লুট, অপচুক্তি ও দুর্নীতির রক্ষাকবচ
২০১০ সালে 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি' নামক বিশেষ আইন করেছে সরকার। আইনটির বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২৬ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। আইনটির ৯ ধারা, 'এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।'
'সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ' উপশিরোনামে ১০ ধারায় বলা হয়েছে, 'এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যেও জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।'
১৪ ধারায় বলা হয়েছে, 'এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে যেন এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি।'
দায়মুক্তির আইনের বলে বিদ্যুৎখাতের ইউনিট প্রতি ক্রয়মূল্য ও খরচের মডেল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জসহ হিসেবে দেখা যায়, কিছু আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিট প্রতি বাৎসরিক গড় মূল্য ১০০ টাকাও ছাড়িয়েছে। ডলারে পেমেন্ট বলে এতে পিডিবির লোকসান থামানো যাচ্ছে না। এই দুর্বিত্তায়ন থামানো জরুরি।
নিম্ন জ্বালানি দক্ষতা ও নিম্ন প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ
কয়েক ডজন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি দক্ষতা ৩০ শতাংশের কম, অর্থাৎ অনেক বেশি জ্বালানি পুড়ে এরা খুব কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এতে আমদানি নির্ভর জ্বালানি সরবরাহের চাপ বাড়ে। বহু বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্ল্যান্ট-ফ্যাক্টর কম বলে একটানা সচল থাকতে পারে না। বড় সমস্যা ক্যাপটিভের কয়েক হাজার বিদ্যুৎকেন্দ্র। সার্টিফিকেট ওরিজিন নকল করে মিথ্যা ঘোষণায় বিদেশ থেকে আনা মেয়াদোত্তীর্ণ ও চরম জ্বালানি অদক্ষ এসব প্ল্যান্ট বিদ্যুৎখাতের গলার ফাঁস। দেশে লোডশেডিং যত বাড়বে, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র ততবেশি চলবে, ততই জ্বালানি অপচয়ের সমস্যাও প্রকট হবে।
৩৮টি বন্ধ ও ৯৮টি আংশিক সচল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে যেগুলোর তাপীয় দক্ষতা ভালো, সরকারি কিংবা বেসরকারি যাইহোক, সেগুলো সচল রাখার পরিকল্পনা দরকার। ৪০ শতাংশের বেশি জ্বালানি দক্ষতা এবং ৬০ শতাংশের বেশি প্ল্যান্ট-ফ্যাক্টর রয়েছে এমন কেন্দ্রকে প্রাধান্য দিলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি অপচয় থামানো যাবে।
শিল্প বিদ্যুতের বিল কমিয়ে জ্বালানি অবান্ধব ক্যাপটিভ থামানো
শিল্প বিদ্যুতের দাম বেশি বলে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা নেই বলে (হঠাৎ লোডশেডিং হয়, যা শিল্পের জন্য বিপর্যয়কর) ক্যাপটিভে চলে গেছে মাঝারি থেকে বড় শিল্প। শিল্প-মালিকরা দাবী করেন, নিজস্ব গ্যাস জেনারেটরে উৎপাদন খরচ সরকারি মূল্যের মাত্র ৩ ভাগের ১ ভাগ পড়ে (অবশ্য এখানে গ্যাসের মিটার ইউনিট চুরি ও ঘুষের বিষয় জড়িত আছে)। সরকারি শিল্প বিদ্যুতের উচ্চমূল্যে একদিকে শিল্প-পণ্য উৎপাদনের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে ক্যাপটিভের নিম্ন দক্ষতার জেনারেটরে বেশি জ্বালানি পুড়ে কম বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় বলে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সেইসঙ্গে বেশি জ্বালানি আমদানিতে ডলার ড্রেইনও হচ্ছে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ স্থায়ীভাবে বন্ধের জন্য সুস্পষ্ট 'শিল্প বিদ্যুৎ' সঞ্চালন, বিতরণ ও শিল্প সহায়ক সাশ্রয়ী বিলিং নীতিমালা প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তেলে সিস্টেম লস থামানো
২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিদ্যুতের সিস্টেম লস দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। কারিগরি খাত বলে দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনের লস ছাড়া অপরাপর সিস্টেম লস অগ্রহণযোগ্য। ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশে লস সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ হতে পারে। ৩ শতাংশের বেশি যেকোনো সিস্টেম লস মানেই বিদ্যুৎ চুরি। এভাবে গ্যাস বিতরণ ও তেল পরিবহণ খাতেও রয়েছে অযৌক্তিক সিস্টেম লস। কাঠামোগত সিস্টেম লসের 'চুরি ও দুর্নীতি' থামিয়ে জ্বালানি সাশ্রয়ের স্বচ্ছ পরিকল্পনা কই?
সবুজ বিদ্যুৎ রোডম্যাপ বাস্তবায়ন
স্রেডা ও ইউএনডিপির তত্ত্বাবধানে তৈরি 'ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১' মতে, জমি স্বল্পতা সত্ত্বেও সৌর বিদ্যুতায়নের মধ্যমানের কৌশলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ২০ হাজার মেগাওয়াট সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। অন্যদিকে নদী অববাহিকা উন্নয়নের ৫ শতাংশ ভূমি, শিল্পাঞ্চলের রুফটপ ১৫ শতাংশ ভূমি প্রভৃতি নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সৌর স্থাপনা মডেলে এই সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছানো সম্ভব।
জ্বালানি আমদানির নির্ভরতা থেকে বের হতে চাইলে সরকারকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতি মুক্ত বাস্তবায়নে 'ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১'কে আলোর পথে নিতে হবে। বিদ্যুতের মাস্টার প্ল্যান পিএসএমপি-২০১৬ মতে, ২০২১ সালের মধ্যেই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ মোট সক্ষমতার অন্তত ১০ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এসডিজি-৭ মতে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১২ শতাংশ নবায়নযোগ্য করার শর্ত আছে। বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের শক্তিশালী প্রার্থী বলে ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য রাখার শর্ত মানা উচিত, যা নিম্ন মধ্যআয়ের দেশের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের বর্তমান অবস্থান (মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ) অগ্রহণযোগ্য।
'সোলার হোম' পলিসি সংস্কার করে ব্যক্তিখাতে বিদ্যুৎ বিক্রির বৈধতা
বিদ্যুৎ বিতরণকারী ডেসা-ডেসকো-পল্লী বিদ্যুতের মতো কোম্পানিকে সৌরবিদ্যুৎ বিক্রির অনুমতি ও অবকাঠামো সহযোগিতা দিতে হবে। ব্যক্তি নিজস্ব বিনিয়োগে উৎপাদিত সরকারি সৌরবিদ্যুৎ স্টোর করবেন, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করবেন। এ জন্য বিতরণ ব্যবস্থাকে স্মার্ট করতে হবে।
প্রত্যন্ত অঞ্চল ও দ্বীপ এলাকায় খরুচে সঞ্চালন প্রকল্পে বিদ্যুৎ না নিয়ে বরং সেখানে নবায়নযোগ্য সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার ও প্রণোদনা দরকার। দরকার ব্যক্তি বিনিয়োগে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রির উপযোগী কমিউনিটি গ্রিড। সবুজ বিদ্যুতের সোলার প্যানেল, ডিসি বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ও ব্যাটারিতে শুল্ক উঠিয়ে দেওয়া দরকার।
সোলার বিনিয়োগের ব্যাংক ঋণের মডেল দরকার, দরকার ব্যাটারি রিসাইকেল ব্যবস্থাকে পরিবেশবান্ধব করা। সবুজ বিদ্যুৎ বাড়লে ডলার সাশ্রয় হবে। ভূমি স্বল্পতার বাংলাদেশে মানসম্পন্ন স্টোরেজসহ শহুরে ও গ্রামীণ সোলার হোমের ব্যাপক বিকাশ দরকার।
উৎপাদন ও সঞ্চালনের সঙ্গে শিল্প ও নগর বিকাশ পরিকল্পনা সমন্বিত করা
অনেকগুলো পরিকল্পিত অর্থনৈতিক অঞ্চল আছে, যেগুলো নন-ফাংশনাল, কিন্তু সেখানে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ আছে। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর ফিজিবল না, রামপাল ও পায়রায় বিদ্যুৎকেন্দ্র করে খরুচে সঞ্চালন টানা হয়েছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহারে আসতে বহু সময় লাগবে বলে সেখানকার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বল্প ব্যবহৃত থাকবে। রূপপুরও লোডসেন্টার থেকে বহু দূরে বলে সঞ্চালন লাইনের পেছনে বিশাল বিনিয়োগ চলে যাবে। অর্থাৎ বিশাল বিশাল বিনিয়োগের রিটার্ন নগণ্য, কারণ উৎপাদন ও সঞ্চালন পরিকল্পনার সঙ্গে শিল্প পরিকল্পনার সমন্বয় নেই। এসব ঠিক করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট মোকাবিলায় স্থলভাগের গ্যাসকূপ সংস্কার করে উৎপাদন বাড়াতে হবে, সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে। স্পট মার্কেট আমদানি প্রীতি বন্ধ করে ওপেক সদস্য দেশ থেকে বড় বড় পরিসরে নিরবচ্ছিন্ন তেল-গ্যাস-কয়লা আমদানির স্থায়ী চুক্তি জন্য জোরালো কূটনীতি করতে হবে। দেশীয় কয়লা ব্যবহারের জন্য কয়লা নীতি চূড়ান্ত করতে হবে।
দুর্নীতি বান্ধব ক্রয় প্রক্রিয়ায় সংস্কার
কারিগরি জ্ঞানহীন, অভিজ্ঞতাহীন একদল দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থাপক (মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, কেন্দ্রীয় ক্রয় কমিটি, সিপিটিইউ) ভুল ও অদূরদর্শী পিপিএ/পিপিআর নামক আইনি প্রক্রিয়ার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতকে অযোগ্য (মূলত চীনা ও ভারতীয়) সরবরাহকারীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছে।
উন্মুক্ত দরপত্রের সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়ার নাম করে, বিদ্যুৎখাতে যাবতীয় নিম্নমান যন্ত্রপাতি, খুচরা যন্ত্রাংশ, নিশ্চয়তাহীন মেশিন ঢুকে গেছে। খুচরা যন্ত্রাংশ ও সাপোর্ট সিস্টেমের নামে ব্যালেন্স অব প্ল্যান্ট (বিওপি) খাতে খরচ হয়ে যাচ্ছে শত কোটি ডলার, বিওপি বিদ্যুৎ বাজেট অপচয়ের আরেকটা বড় খাত।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের বড় সমস্যা দক্ষ জনবল এবং অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের বদলির ভুল পলিসি। বড় সমস্যা স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম না থাকা (স্ক্যাডা)। বহু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বয়ংক্রিয় কন্ট্রোল করার জন্য অটোমেটিক জেনারেশান কন্ট্রোল (এজিসি) কিংবা ফ্রি গভর্নর মুড অপারেশন (এফজিএমও) বাস্তবায়ন নেই। রাজনৈতিক লবিং, সরকারি সিদ্ধান্তহীনতা এবং অযোগ্য ভেন্ডরের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কারণে (গ্যারান্টিহীন এফজিএমও) বড় ধরনের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণে 'আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি রিলে' (এএফআর) বাস্তবায়ন না থাকায় ডিস্ট্রিবিউশনের লোডও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কন্ট্রোল করা সম্ভব হয় না স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
পাওয়ার গ্রিড আধুনিকায়ন এবং এনএলডিসি আধুনিকায়নের ওপরে যেসব কনসাল্টিং প্রজেক্ট আছে, সেসব কনসাল্টিং পার্টির মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যেমন: গ্রিড আধুনিকায়নের জন্য পিজিসি আইএল এবং এনএলডিসি আধুনিকায়নের জন্য মোনেন কো। এগুলোকে যোগ্য কোম্পানি বলা যাবে না। ধীরগতির সঞ্চালন নেটওয়ার্ক প্রকল্পের কাজও ব্যাহত করছে বিদ্যুৎ বিতরণকে।
সবমিলিয়ে বিদ্যুৎখাত বহুবিধ সমস্যার মুখোমুখি। সমাধানে দরকার মেধাবী, দূরদর্শী, ভবিষ্যতমুখী স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: তড়িৎ প্রকৌশলী, বুয়েট; টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক; গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য
faiz.taiyeb@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments